আর্জেন্টিনায় গ্রিয়েসার ভুল

জুলাইয়ের ৩০ তারিখে আর্জেন্টিনার ঋণদাতাদের বন্ডের ওপর ষাণ্মাসিক সুদ পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তাঁরা সেটা পাননি।২০০১ সালে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার পর দেশটির বন্ড পুনর্গঠন করা হয়েছিল, সেটার ওপরই এই সুদ তাঁদের প্রাপ্য ছিল। আর্জেন্টিনা কিছুদিন আগে ব্যাংক অব নিউইয়র্ক মেলনে ৫৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জমা দিয়েছে। কিন্তু ব্যাংকটি এই অর্থ ঋণদাতাদের অ্যাকাউন্টে পাঠায়নি। মার্কিন ফেডারেল জজ থমাস গ্রিয়েসা নির্দেশ দিয়েছেন, আর্জেন্টিনার যে বন্ড ক্রেতারা এর পুনর্গঠন মেনে নিয়েছিলেন, তাঁদের সুদ দেওয়া যাবে না, এত দিন যাঁরা এটা গ্রহণ করেননি, তাঁদের প্রাপ্য সুদ পরিশোধ করা হচ্ছে।
ইতিহাসে সম্ভবত এটাই প্রথম ঘটনা, যখন সরকার ঋণদাতাদের সুদ পরিশোধ করতে চাইলেও বিচারকের নির্দেশের কারণে সেটা পারেনি। সংবাদমাধ্যম বলছে, এটা আর্জেন্টিনার ঋণখেলাপ। তবে টুইটারের হ্যাশট্যাগ গ্রিসফল্ট এ ব্যাপারে আরও যথাযথ। আর্জেন্টিনার সরকার তার জনগণ এবং যাঁরা এ পুনর্গঠন মেনে নিয়েছেন, তাঁদের দায় শোধ করেছে। গ্রিয়েসার রুলিংয়ের কারণে সুদের কারবারি আরও উৎসাহিত হবে, এটা আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারের জন্য হুমকিও হয়ে উঠবে। একই সঙ্গে তা পুঁজিবাদের মৌলিক মতবাদ অস্বীকারের নামান্তর: ঋণ পরিশোধে অক্ষম ঋণগ্রহীতাদের নতুন করে শুরু করার সুযোগ দিতে হয়।
নানা কারণেই সার্বভৌম বন্ডে খেলাপির পরিমাণ বেশি হয়। আর্জেন্টিনায় ২০০১ সালে যে খোলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল, তার কারণ হচ্ছে সার্বভৌম বন্ডের বিক্রি বেড়ে যাওয়া। এটা ঘটেছিল নব উদারনৈতিক ‘ওয়াশিংটন মতৈক্যের’ সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে। এই অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশটি ধনী হয়ে যাবে ভেবেছিলেন ঋণদাতারা। এই পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছিল, আর দেশটি গভীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটে পতিত হয়। ১৯৯৮ সালে মন্দা শুরু হয়ে তা ২০০২ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। শেষমেশ রেকর্ড পরিমাণ আর্জেন্টিনাবাসী দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়, এর পরিমাণ ছিল ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৮ শতাংশ।
আর্জেন্টিনা ২০০৫ ও ২০১০ সালে দুই দফায় তার ঋণ পুনর্গঠন করে। ৯২ শতাংশের অধিক ঋণদাতা এই নতুন ব্যবস্থা মেনে নেন, তাঁদের এক্সচেঞ্জড বন্ড ও জিডিপি-ইনডেক্সড বন্ড দেওয়া হয়। আর্জেন্টিনা এবং যাঁরা এটা মেনে নিয়েছিলেন, উভয়ের জন্যই এটা ভালো ফল বয়ে আনে। অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে ওঠে, জিডিপি-ইনডেক্সড বন্ড থেকেও ভালো সুদ আসে।
কিন্তু এই তথাকথিত শকুনসম বিনিয়োগকারীরা আরও লাভ করার সুযোগ খোঁজেন। তাঁরা না ছিলেন দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারী, আবার ওয়াশিংটন মতৈক্যের মাধ্যমে ভালো কিছু হবে এমন আশাও তাঁদের মধ্যে ছিল না। তাঁরা আসলে ছিলেন সুযোগসন্ধানী। ২০০১ সালের মন্দার পর আতঙ্কগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তাঁরা অভিহিত মূল্যের ভগ্নাংশ মূল্যে এসব বন্ড কিনে নেন। এরপর তাঁরা বন্ডের শতভাগ মূল্য পাওয়ার জন্য আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে মামলা করেন। হেজ ফান্ড এলিয়ট ম্যানেজমেন্টের সাবসিডিয়ারি এনএমএল ক্যাপিটাল ২০০৮ সালে বন্ড কেনায় ৪৮ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। গ্রিয়েসার রুলিংয়ের কারণে তারা এখন পাবে ৮৩২ মিলিয়ন ডলার, মানে বিনিয়োগের ১৬০০ শতাংশেরও বেশি ফেরত পেয়েছে তারা। এই ব্যক্তির কাছে তারা কৃতজ্ঞ থাকতেই পারে।
এসব অঙ্ক এত বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, এসব শকুন অতীতের সুদও পেতে চায়। কিছু সিকিউরিটির ক্ষেত্রে ঝুঁকি প্রিমিয়ামও ছিল। খেলাপের পরিমাণ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রুখতে বন্ড ছাড়া হলে সুদের হার বেশি দেওয়া হতো। গ্রিয়েসার কাছে এটা যৌক্তিক মনে হয়েছে। যদিও অর্থনৈতিকভাবে এর কোনো মানে নেই। যখন কোনো দেশ তার ঋণের ওপর ঝুঁকি প্রিমিয়াম ধার্য করে, তখন বোঝা যায় যে খেলাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু আদালত যদি বলে একটি দেশকে অবশ্যই ঋণ পরিশোধ করতে হবে, তাহলে কোনো খেলাপের ঝুঁকির ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কিছু নেই।
গ্রিয়েসার আদেশ অনুযায়ী, ঋণ পরিশোধ করতে হলে আর্জেন্টিনা পেরেশান হয়ে যাবে। এনএমএল ক্যাপিটাল ও অন্যান্য শকুনসম বিনিয়োগকারী ঋণদাতাদের মাত্র ১ শতাংশ, কিন্তু তঁারা পাবেন মোট ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। অন্যান্য ঋণদাতা (ঋণদাতাদের ৬ দশমিক ৬ শতাংশ) পাবেন ১৫ বিলিয়ন ডলার। আর ঋণ পুনর্গঠনের কারণে ঋণদাতারা এই পুনর্গঠনের বিরোধিতাকারীদের সমপরিমাণ দাবি করতে পারবেন, ফলে আর্জেন্টিনাকে হয়তো ১৪০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে।
প্রত্যেক আর্জেন্টিনাবাসীর ঘাড়ে সাড়ে তিন হাজার ডলারের বেশি পরিমাণ অর্থ পড়বে। এটা বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের এক-তৃতীয়াংশের বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ হিসাব হলে প্রত্যেক নাগরিককে মাথাপিছু ২০ হাজার ডলার শোধ করতে হতো। সেটা যেত শত শত কোটি ডলারের মালিকদের পকেট ভরাতে, যাঁরা দেশটাকে নিংড়ে সব বের করে নিচ্ছেন।
এই ৩০ জুলাইয়ের আগে এই শকুনেরা ভীতি সঞ্চার করেছে। ১৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো মন্দা সৃষ্টি হলে তা আর্জেন্টিনার জন্য হতো বড় রকমের ধাক্কা—এটা দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেলত। কিন্তু এসব থেকে ধারণা করা যায়, আর্থিক বাজারে প্রকৃত খেলাপ ও গ্রিয়েসাসৃষ্ট খেলাপের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হবে না। সৌভাগ্যজনকভাবে, সেটা হয়েছে। আর্জেন্টিনার বিভিন্ন করপোরেট ঋণের ওপর এ ঘটনার কোনো প্রভাব পড়েনি। বাস্তবে ৩০ জুলাই তারিখে ঋণ নেওয়ার খরচ বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় কম ছিল।
শেষমেশ, এই গ্রিয়েসার ভুলের কারণে আর্জেন্টিনার চেয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিই বেশি ভুগবে। বিশেষত, যে দেশগুলোর বিদেশি অর্থের প্রয়োজন রয়েছে, সে দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রও ভুগবে। দেশটির আদালতগুলো যেন একেকটি প্যারোডি। একজন পর্যবেক্ষক বলেছেন, গ্রিয়েসা কখনো এ বিষয়টির জটিলতা বুঝতেই পারেননি। মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থা সে দেশটির জনগণকে চুষে খেতে সিদ্ধহস্ত, এখন তারা সেটা বৈশ্বিক পরিসরেও শুরু করেছে। সার্বভৌম বন্ডের ক্রেতাদের মার্কিন বিচারিক ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখা উচিত হবে না। এ রকম বন্ড অন্যান্য স্থান থেকেও একসময় ছাড়া হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ: অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত; মার্টিন গুজম্যান: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ ফেলো।