‘কমলা রঙের বিশ্বে নারী বাধার পথ দেবেই পাড়ি’

‘যে পাখির ডানা সুন্দর ও কণ্ঠস্বর মধুর, তাকে খাঁচায় বন্দী করে মানুষ গর্ব অনুভব করে; তার সৌন্দর্য সমস্ত অরণ্যভূমির, এ কথা সম্পত্তি লোলুপরা ভুলে যায়। মেয়েদের হৃদয় মাধুর্য ও সেবা-নৈপুণ্যকে পুরুষ সুদীর্ঘকাল আপন ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে কড়া পাহারায় বেড়া দিয়ে রেখেছে।’ [নারী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৩৩]

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ (২৫ নভেম্বর—১০ ডিসেম্বর) পালিত হচ্ছে দেশে দেশে, সরকারি-বেসরকারি নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের নারী-পুরুষের সম্মিলিত উদ্যোগে। জাতিসংঘের উদ্যোগে ও নির্দেশনায় সব সদস্যভুক্ত রাষ্ট্র এই ‘পক্ষকাল’ পালনের কর্মসূচি নিয়েছে সভা, আলোচনা অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

জাতিসংঘ ঘোষিত এই বছরের প্রতিপাদ্য আহ্বান হচ্ছে, ‘অরেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড: ফান্ড, রেসপন্ড, প্রিভেন্ট, কালেক্ট।’

বাংলায় প্রচারিত প্রতিপাদ্য প্রতিজ্ঞা হচ্ছে:

‘কমলা রঙের বিশ্বে নারী

বাধার পথ দেবেই পাড়ি।’

অতীতকাল থেকে আজ অবধি সমাজের প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ বাধা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্য ছাড়াও ছোটখাটো অগুনতি প্রতিবন্ধকতা মেয়েদের পায়ে শিকল পরিয়ে রাখছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শহর-গ্রামভেদে কিছু ভিন্নতা বা নিপীড়নের গুরু-লঘু ভেদ ঘটলেও নারীর শৃঙ্খলিত জীবনের কাহিনি সর্বত্রই প্রায় এক।

দেশে দেশে মেয়েদের মূল্যহীনতা নিয়ে বহু প্রবচনের সূচনা হয়েছে। পল্লিগাথায় জানা যায় মেয়েদের প্রকৃত শোচনীয় অবস্থা। প্রাচীন ভিয়েতনামের পল্লিগীতিতে নারীকে বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কী করুণ নারীর ভাগ্য:

‘মেয়েরা যেন বৃষ্টি-ফোঁটা

কেউ জানে না পড়বে কোথায়

প্রাসাদে কি ক্ষেতের কাদায়।’

বাংলার মেয়েরা তো সংসারের জঞ্জাল। প্রবচনে ফুটে উঠেছে নারী জন্মের ব্যর্থতা:

...‘মেয়ের নাম ফেলি

পরে নিলেও গেলি

যমে নিলেও গেলি’

অথবা

‘মেয়েছেলে মাটির ডেলা,

টপ করে নে জলে ফেলা।’

অতীতকাল থেকে আজ অবধি সমাজের প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ বাধা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্য ছাড়াও ছোটখাটো অগুনতি প্রতিবন্ধকতা মেয়েদের পায়ে শিকল পরিয়ে রাখছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শহর-গ্রামভেদে কিছু ভিন্নতা বা নিপীড়নের গুরু-লঘু ভেদ ঘটলেও নারীর শৃঙ্খলিত জীবনের কাহিনি সর্বত্রই প্রায় এক।

এই ছড়াগুলোর ভাঙাচোরা ছন্দের মধ্যে বাংলার নারীর দুর্বিষহ যাতনাবিদ্ধ কান্না তীব্র তীক্ষ্ণ প্রশ্ন তুলে ধরেছে। ক্রীতদাসীর মতো বউ-ঝিদের যথেচ্ছ ব্যবহারের ঘটনা ফলাও করে কাগজে বের হলেও আইন যেন এখানে নাচার। শ্রেণি-ধর্ম-সম্প্রদায় ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে নারী।

নারীর দাসত্ব শৃঙ্খলিত জীবনের শুরু করে, এর গতিধারাই–বা কোন পথে চলেছে—এই প্রশ্ন সবার মনেই জাগা স্বাভাবিক। এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে সামাজিক ও ইতিহাসবিদদের গবেষণার তথ্য থেকে। আঠারো শতকের সমাজতাত্ত্বিক আউগুস্ট বেবেল তথ্য–প্রমাণাদি দিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, ‘নারীরাই প্রথম মানুষ, যারা বশ্যতা ও দাসত্বের বন্ধন স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল; নারীরা দাসপ্রথারও আগে দাসত্বের শৃঙ্খল পরেছে।’

এরপর ধীরে ধীরে নারী বিনিময় পণ্য হিসেবে, দামি সামগ্রী হিসেবে ও মূল্যবান দাসী হিসেবে সমাজে বন্দী হতে থাকল।

এরই অন্য দিকটিতে আছে পতিতাবৃত্তির সূচনা। পুরুষের ইচ্ছার দাস হিসেবে নারীর ওপর যত শোষণের সূত্রপাত, তার মধ্যে পতিতাবৃত্তিতে নারীকে বাধ্য করা হচ্ছে অন্যতম।

শিল্পবিপ্লবের ফলে উৎপাদনব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন হওয়ায় সামাজিক স্তরেও নতুন বিন্যাস ঘটল। কিন্তু সামাজিক শোষণ ও নির্যাতন অব্যাহত রইল নানা প্রক্রিয়ায়।

২০২১ সালেও বিশ্বব্যাপী নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। তবে আজকের যুগের নারী প্রতিবাদ আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে নিজ নিজ সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে অধিকার আদায়ে সক্ষম হচ্ছে।

জাতিসংঘ নারী অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করছে, নারীরা দেশে দেশে শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত হচ্ছে, সচেতনভাবে অধিকার আদায়ের জন্য সংগঠন আন্দোলন গড়ে তুলছে।

দেশে দেশে নারীরা এই একুশ শতকেও প্রশ্ন করছে কেন তারা শৃঙ্খলিত, কেন তারা বন্দিনী। একদিকে নারী শোষিত হচ্ছে, অন্যদিকে নারী জাগরণের আন্দোলন হচ্ছে। জাতিসংঘের ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস (৮ মার্চ), নারীবর্ষ, আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস (২৫ নভেম্বর) পালিত হতে হতে ২০২১ সালে ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ পালনের উদ্যোগ নিয়েছে জাতিসংঘ।

শুধুই আনুষ্ঠানিক যেন না হয় জাতিসংঘের এই উদ্যোগ ও ঘোষণা, এতেই নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কর্মসূচিগুলো সফল হবে—আমাদের প্রত্যাশা সেটাই।

মালেকা বেগম অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সোশিওলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, ঢাকা