ধর্মতন্ত্র, নন্দনতত্ত্ব ও অবরোধবাসিনী

হইচই না ফেলেও দুর্দিন আসতে পারে। প্রতিবেশে, লক্ষণীয় মাত্রায় তার বিস্তার ঘটলে জনমানসে দুশ্চিন্তা ঢেউ তোলে। কারণ, দুর্দিন তখন দৃষ্টিগোচর হয়। শুধু মানুষের শরীরে নয়, প্রাণিজগতের অন্যদের শরীরেও চোখ একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। চোখ যা কিছু দেখে, তা মস্তিষ্কে গিয়ে অভিঘাত তৈরি করে, মস্তিষ্ক তখন ভাবতে শুরু করে। মস্তিষ্ক যতটা শিক্ষিত, সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত তৈরি হয়, সিদ্ধান্তটি আবার প্রায়োগিক ভূমিকায় নামে। প্রাণিজগতের অন্যরাও সহজাত প্রবৃত্তির মস্তিষ্ক ধারণ করে, মানুষও। কিন্তু মানব মস্তিষ্ক আরও একটি কাজ করে। তার নাম সচেতন ক্রিয়া।

বিজ্ঞান ইতিমধ্যেই আমাদের জানিয়েছে, এই সচেতন ক্রিয়া করার বিশিষ্টতাই মানুষকে অন্য প্রাণীদের কাছ থেকে স্বতন্ত্র করেছে। বিরুদ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে সচেতন লড়াই করতে না পারার ফলে বিশালাকৃতির ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছে। আর মানুষ চাঁদে পৌঁছেই ক্ষান্ত হয়নি, এখন সে চাইছে মঙ্গল গ্রহে যেতে। এটাই মানুষের ধর্ম। অজানাকে জানতে চাওয়া। জেনে সেই অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধি ভাবীকালের জন্য রেখে যাওয়া। এই পরম্পরার নাম সভ্যতা।

আদি পর্বে কেমন ছিল সেই সভ্যতা? রবীন্দ্রনাথের চোখ খুঁটিয়ে দেখানো যেমন করে...‘তোমার ইতিহাসের আদিপর্বে দানবের প্রতাপ ছিল দুর্জয়—/ সে পুরুষ, সে বর্বর, সে মূঢ়।/ তার অঙ্গুলি ছিল স্থূল, কলাকৌশলবর্জিত;/ গদা-হাতে মুষলহাতে লন্ডভন্ড করেছে সে সমুদ্র পর্বত;/ অগ্নিতে বাষ্পেতে দুঃস্বপ্ন ঘুলিয়ে তুলেছে আকাশে।/ জড়রাজত্বে সেদিন একাধিপতি,/ প্রাণের ’পরে ছিল তার অন্ধ ঈর্ষা।’...(পৃথিবী)।

সেই অবস্থা কাটল কী করে? ‘...দেবতা এলেন পরযুগে, মন্ত্র পড়লেন দানবদমনের—/ জড়ের ঔদ্ধত্য হল অভিভূত;/ ...নম্র হল শিকলে বাঁধা দানব,/ তবু সেই আদিম বর্বর আঁকড়ে রইল তোমার ইতিহাস।/ ব্যবস্থার মধ্যে সে হঠাৎ আনে বিশৃঙ্খলতা—/ তোমার স্বভাবের কালো গর্ত থেকে/ হঠাৎ বেরিয়ে আসে এঁকেবেঁকে!...’

অন্ধকার যুগ সব সভ্যতাতেই ছিল। ছিল বলেই সেই অন্ধকার কাটাতে আলোর মশাল হাতে সমাজসংস্কারে ব্রতী মহামানবের আগমন ঘটেছিল। ঘটে, ঘটবে। মহাপুরুষ কিংবা সাধকদের সেই সব দিকনির্দেশনা যেমন জীবনবিচ্ছিন্ন ছিল না, তেমনি ছিল না ভিন্নমতের প্রতি আক্রমণাত্মক বা প্রতিহিংসাপরায়ণ। তাঁদের অবর্তমানে তাঁদের অনুসারী-অনুগামীদের অসহিষ্ণুতা-অশিক্ষা-ভালোবাসাহীনতা মূল ভাবনা থেকে সাধক পুরুষের দিকনির্দেশনাকে বিচ্যুত করেছে। স্বেচ্ছাচারিতা ও হিংস্রতা সহোদর। ধর্মের নামে ভিন্নমত নির্মূল কতটা নৃশংস হয়ে ওঠে, এই একুশ শতকেও বাংলাদেশ তা প্রত্যক্ষ করছে। এটা ধর্ম নয়, ধর্মতন্ত্র।

রবীন্দ্রনাথ যখন এই দুইয়ের ফারাক আবিষ্কার করলেন, তখন পৃথিবী আজকের এই তমসা ও তামাশার চাদরে এতটা মুখ ঢাকেনি। বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী কিংবা জঙ্গিদের উত্থান ঘটেনি। ভারতের উত্তর প্রদেশে আদিত্যনাথ যোগী নামের উগ্র ধর্মান্ধ কেউ মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়নি। গোটা ভারতবর্ষ সাম্প্রদায়িকতার ত্রিশূল আর তলোয়ার নিয়ে এতটা ঝনঝন করে বাজেনি।

তবু রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘মনে রাখা দরকার ধর্ম ও ধর্মতন্ত্র এক জিনিস নয়। ও যেন আগুন আর ছাই। ধর্মতন্ত্রের কাছে ধর্ম যখন খাটো হয়, তখন নদীর বালি নদীর জলের ওপর শাসন করতে থাকে। তখন স্রোত চলে না, মরুভূমি ধু ধু করে।’ (কর্তার ইচ্ছায় কর্ম)

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৭১-এর অনেক আগে, ১৯৫২ সালে। যখন উর্দু ভাষার দানব তীক্ষ্ণ থাবা বাড়িয়েছিল মাতৃভাষা বাংলার ওপর, সেই থাবা রবীন্দ্রসংগীতকেও খামচে ধরেছিল। যুদ্ধকালের একটি পোস্টারের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী লিখেছিলেন, ‘বাংলার হিন্দু/ বাংলার খৃষ্টান/ বাংলার বৌদ্ধ/ বাংলার মুসলমান/ আমরা সবাই বাঙালী’ স্লোগানটি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সেদিন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা ও সমর দাসের সুরে এই অসাম্প্রদায়িক চেতনার গানটি গেয়ে গেয়ে যুদ্ধরত তরুণদের প্রেরণা জুগিয়েছে।

এই সব কথা এ দেশে কমবেশি সবাই জানেন। আমার অনুসন্ধান অন্যত্র। চারপাশের অসাম্প্রদায়িক হলাহলের সাম্প্রতিক বাড়াবাড়িকে আমি বিনা প্রতিবাদে ছাড়তে রাজি নই। অন্ধকারের এই অপশক্তিকে আমি ভয় পাই। তাই কার্যকারণ সম্পর্কে ব্যবচ্ছেদে নেমেছি।

কাজী নজরুল ইসলামও নেমেছিলেন। ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন: দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভেতরের ন্যাজকে কাটবে কে? হিন্দু-মুসলমানের কথা মনে উঠলে আমার বারে বারে গুরুদেবের ওই কথাটাই মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও উদয় হয় মনে যে এ ন্যাজ গজালো কি করে? এর আদি উদ্ভব কোথায়? এ সঙ্গে এটাও মনে হয়, ন্যাজ যাদেরই গজায়, তা ভেতরেই হোক আর বাইরেই হোক—তারাই হয়ে ওঠে পশু। যেসব ন্যাজওয়ালা পশুর হিংস্রতা সরল হয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে—শৃঙ্গরূপে, তাদের তত ভয়ের কারণ নেই, যত ভয় হয় সেই সব পশুদের দেখে—যাদের হিংস্রতা ভিতরে, যাদের শিং মাথা ফুটে বেরোয়নি। শিংওয়ালা গরু-মহিষের চেয়ে শৃঙ্গহীন ব্যাঘ্র-ভালুক জাতীয় পশুগুলো বেশী হিংস্র—বেশী ভীষণ।...ন্যাজ আর শিং দুই-ই ভেতরে থাকলে কী রকম হিংস হয়ে উঠতে হয়, তা হিন্দু-মুসলমানের ছোরা মারা না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না।’

একদম ঠিক কথা। ভারতের উত্তর প্রদেশে আদিত্যনাথ যোগী বলেছিলেন, ‘কোনো একজন হিন্দু মেয়েকে যদি কোনো মুসলিম পুরুষ বিয়ে করে, আমরা তাহলে ১০০ জন মুসলিম নারীকে তুলে আনব।’ আর বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম মিছিল ও সমাবেশ করে বলেছে, সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে স্থাপিত ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যটি যদি না সরানো হয়, তাহলে তারা তাদের শক্তি দেখিয়ে দেবে। এই দুই পক্ষের কারোরই শরীরে দৃশ্যমান শিং এবং লেজ নেই, কিন্তু তবু উচ্চারণগুলো মানবিক কি? নান্দনিক কি?

‘নন্দনতত্ত্ব’ শব্দটি নিয়ে অগ্রজ কিছু প্রিয় শিল্পীকে ইদানীং গম্ভীর মুখে মুচকি হাসতে দেখছি। রাজধানী ঢাকায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের সড়ক থেকে বেশ কয়েক বছর আগে যেদিন ‘লালন’ ভাস্কর্যটি সরানো হয়, সেদিন একজন কার্টুনিস্টকে স্বস্তির স্বরে বলতে শুনেছিলাম, ঢাকা শহর থেকে একটি খারাপ ভাস্কর্য সরেছে।

এবার যখন সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে স্থাপিত ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্য সরাতে হেফাজত সরকারকেই রাজি করিয়ে ফেলল, তখন ‘নন্দনতত্ত্ব’ বিশারদেরা আরও মৌন, অধিকতর স্বস্তির ফিসফাস। তাঁদের মনেই পড়ল না, বেশ কয়েক বছর আগে শিশুপার্কের সামনের ‘দুরন্ত’ কিংবা মতিঝিলের বাংলাদেশ বিমান কার্যালয়ের সামনে ‘বলাকা’ ভাস্কর্যের একাধিকবার আক্রান্ত হওয়ার কথা।

হেফাজতে ইসলাম কি নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে, নাকি সংস্কৃতিচেতনাবিরোধী অবস্থান থেকে? ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীকে তুষ্ট করতে গিয়ে এ কেমনতর অবস্থান শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত মানুষের?

আদিত্যনাথ যোগী, হেফাজতে ইসলাম যখন স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছে, তখন সংস্কৃতির মানুষেরা তাঁদের স্বরূপ ভুললেন কেন? তাহলে কি নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়ার কথাই ঠিক? ‘...আমরা বহুকাল হইতে অবরোধ থাকিয়া, অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি; সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের—বিশেষত আমার কিছুই নাই। মেছোনীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে “পচা মাছের দুর্গন্ধ ভালো না মন্দ?” সে কী উত্তর দিবে?’ (অবরোধ-বাসিনী)

কে পচা? আমরা? সময়? নাকি আমাদের অবরোধবাস?

মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।