ন্যায়বিচারের পথের কাঁটা যখন রাজনীতি

এইচ এম এরশাদ ও এম এ মঞ্জুর

১৫ জানুয়ারির পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মেজর জেনারেল এম এ মঞ্জুর হত্যা মামলার অভিযোগপত্র নতুন করে জমা দিয়েছে। এবার তারা এই মামলার প্রধান আসামি সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের নাম অভিযোগপত্র থেকে বাদ দিয়েছে। আবদুল লতিফ নামের আরও এক সাবেক সেনা কর্মকর্তার নামও অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যিনি জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ডের সময় ব্রিগেডিয়ার হিসেবে ঢাকায় কর্মরত ছিলেন এবং ওই হত্যাকাণ্ডের ঠিক আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন।

অভিযোগ রয়েছে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর মেজর জেনারেল মঞ্জুর আত্মগোপনে যাওয়ার পথে সপরিবার পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলে তাঁকে পুলিশের নিরাপত্তা হেফাজত থেকে সেনা হেফাজতে নিয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে গুলি করে হত্যা করার ঘটনাটি সুসম্পন্ন করার দায়িত্ব নিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার আবদুল লতিফ। ওয়াকিবহাল মহলের ভাষ্য, তাঁকে ওই ‘বিশেষ দায়িত্ব’ দিয়ে চট্টগ্রাম পাঠিয়েছিলেন সে সময়ের সেনাপ্রধান এরশাদ; যাঁর প্রবল চাপে তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার চট্টগ্রামের পুলিশ কর্তৃপক্ষকে জেনারেল মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে হস্তান্তর করার নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। বলা হয়, ব্রিগেডিয়ার লতিফ এরশাদের দেওয়া ‘বিশেষ দায়িত্ব’ সফলভাবে পালন করার পুরস্কার পেয়েছিলেন: তিনি বিডিআরের মহাপরিচালক হয়েছিলেন, মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন, ডিজিএফআইয়ের মতো শক্তিশালী সংস্থার মহাপরিচালকের পদে আসীন হয়েছিলেন।

এইচ এম এরশাদ ও আবদুল লতিফ—মঞ্জুর হত্যা মামলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ দুই আসামিকে বিচারপ্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানানো তথা অভিযোগপত্র থেকে তাঁদের নাম বাদ দেওয়ার কারণ, তাঁরা উভয়ে জীবন থেকেই অব্যাহতি পেয়েছেন। এরশাদ মারা গেছেন বছর দেড়েক আগে, ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই। আবদুল লতিফের আইনজীবীর ২০১৯ সালের ২ অক্টোবরের ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁর মক্কেলও মারা গেছেন ‘কিছুদিন আগে’। এ দেশের ফৌজদারি কার্যবিধিতে মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ বিচার করার বিধান নেই বলে মামলাটি থেকে তাঁদের অব্যাহতির আবেদন জানানো হয়েছে।

সর্বশেষ খবর হলো, সিআইডি এই মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করার পর শুনানির পরবর্তী তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে ২৫ জানুয়ারি। ধারণা করা যায়, একসময়ের চাঞ্চল্যকর এই মামলা সম্পর্কে কৌতূহলী নাগরিকদের কৌতূহল প্রধান আসামি এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে প্রায়-নিঃশেষিত হয়েছে। কিন্তু গভীর ও সূক্ষ্ম চিন্তার মানুষদের কৌতূহলের অবসান ঘটার কথা নয়। কারণ, মামলাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মেজর জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড একটি রাজনৈতিক ঘটনা, যা এই মামলার নিষ্পত্তির আগ পর্যন্ত রহস্যাবৃতই থেকে যাবে। প্রত্যক্ষদর্শীসহ বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর জবানবন্দি এবং সিআইডির তদন্তের ভিত্তিতে ১৯৯৫ সালে তৈরি অভিযোগপত্র এই হত্যাকাণ্ডে প্রধান ভূমিকা পালনকারী হিসেবে তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদের প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করে। সেনামহলের একটি বড় অংশের ধারণাও তাই বলে জানা যায়। কিন্তু এরশাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার আগ-পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে অপরাধী বলার সুযোগ নেই।

রাষ্ট্রপতি জিয়ার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তিনি নিজের বক্তব্য দেশবাসীকে জানানোর ইচ্ছা পুলিশের কাছে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁকে গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন, তাঁকে যেন কোনোভাবেই সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা না হয়, যেন কারা হেফাজতে নেওয়া হয়। কিন্তু ‘ওপরের নির্দেশে’ পুলিশ তাঁকে হত্যাকারীদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল।

তবে এ কথা বলার সুযোগ অবশ্যই আছে যে ১৯৮১ সালের ২ জুন রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ভেতরে বন্দী অবস্থায় নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন যে মেজর জেনারেল ও বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধা, তাঁর স্বজনেরা প্রায় ৪০ বছর ধরে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রাজনৈতিক কারণে। তাঁর হত্যাকাণ্ড চাপা দেওয়া হয়েছে এমন জনশ্রুতি ছড়িয়ে যে রাষ্ট্রপতি জিয়ার হত্যাকারী হিসেবে তিনি নিহত হয়েছেন বিক্ষুব্ধ সৈনিক-জনতার হাতে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তিনি নিজের বক্তব্য দেশবাসীকে জানানোর ইচ্ছা পুলিশের কাছে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁকে গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন, তাঁকে যেন কোনোভাবেই সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা না হয়, যেন কারা হেফাজতে নেওয়া হয়। কিন্তু ‘ওপরের নির্দেশে’ পুলিশ তাঁকে হত্যাকারীদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল।

এসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমেরিকান অনুসন্ধানী সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজ প্রথম আলোয় একাধিকবার ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছেন। এসব লেখালেখি, এই মামলার সাক্ষীদের জবানবন্দিসহ অন্যান্য নথিপত্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আদালতে মঞ্জুর হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ও রায়ের মধ্য দিয়ে সেসবের সত্যাসত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব। তবে মামলার চূড়ান্ত লক্ষ্য আরও বড়: তা হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। সেটা শুধু নিহত মঞ্জুরের স্বজনদের একার স্বার্থ নয়, গোটা জাতির স্বার্থ।

কিন্তু এই মামলা ২৫ বছর ধরে যেভাবে চলে আসছে, তা যারপরনাই হতাশাব্যঞ্জক ও গ্লানিকর। প্রধান আসামি এরশাদকে রক্ষা করার জন্য এই মামলার বিচারক বদল করা হয়েছে কমপক্ষে ২৪ বার। রাষ্ট্রপক্ষ ‘অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন’ বলে সময় চেয়েছে কতবার (আদালত প্রতিবারই সময় মঞ্জুর করেছেন), সেই হিসাব পাওয়া কঠিন।

কিন্তু কেন? মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে যে আসামির মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারত, তাঁকে রক্ষা করার জন্য আইন প্রয়োগের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে এমন অব্যাহতভাবে বাধাগ্রস্ত করার কী প্রয়োজন ছিল? সরকারের কী দায় ছিল সেই সাবেক স্বৈরশাসককে রক্ষা করার, যাঁকে জাতি বিপুল গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল? কারণটা স্পষ্টতই রাজনৈতিক।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ছিলেন একজন রাজনৈতিক খেলোয়াড়, যাঁকে নিয়ে বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল অবিরাম ন্যক্কারজনক খেলা খেলেছে এবং তার মধ্য দিয়ে নিজেদের অপমানিত করেছে। (স্মর্তব্য: মৃত্যুর মাস ছয়েক আগ পর্যন্ত বর্তমান সরকারের অংশ ছিলেন তিনি। তাঁর সরকারি পদ ছিল ‘প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত’।)

জেনারেল মঞ্জুর কার বা কাদের পরিকল্পনায় ও নির্দেশে, কাদের দ্বারা ও কীভাবে খুন হয়েছিলেন, এই খুনের পেছনের কারণ বা মোটিভ কী ছিল—সবকিছু জাতির জানা প্রয়োজন। কারণ, এটি আর দশটি সাধারণ হত্যাকাণ্ডের মতো নয়, এটি একটি গুরুতর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, যা বাংলাদেশের জাতীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ও সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

‘পতিত’ ও ‘জনধিক্কৃত’ স্বৈরশাসকের রাজনৈতিক পুনর্বাসন বাংলাদেশের অপ্রীতিকর রাজনৈতিক খেলাধুলার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েছে—এটা জাতির জন্য যতই দুঃখজনক ও গ্লানিকর হোক না কেন, এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় ছিল না। কিন্তু সেই রাজনীতি যখন আইন প্রয়োগের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অনড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, আইনের শাসনের চর্চাকে দৃশ্যমান তামাশায় পরিণত করে, তখন আত্মমর্যাদাশীল জাতির পক্ষে তা গ্লানিকর হয়ে ওঠে। মঞ্জুর হত্যা মামলা পরিচালনায় রাষ্ট্রপক্ষের আচরণ জাতি হিসেবে আমাদের তেমনই একটি জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা একান্ত জরুরি।

মঞ্জুর হত্যা মামলার দীর্ঘসূত্রতার অবসান ঘটানো প্রয়োজন। ফৌজদারি কার্যবিধিতে মৃত আসামির বিচারের বিধান নেই বলে এই মামলা থেকে এইচ এম এরশাদ ও আবদুল লতিফের অব্যাহতির আবেদন মঞ্জুর হলে অবশিষ্ট আসামিদের কার কী দণ্ড হতে পারে, জেনারেল মঞ্জুরের স্বজনদের কাছে সেসব দণ্ড কতটা গ্রহণযোগ্য বা অগ্রহণযোগ্য বলে মনে হতে পারে, এসব প্রশ্ন এখন জাগবে। এগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ; তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জেনারেল মঞ্জুর কার বা কাদের পরিকল্পনায় ও নির্দেশে, কাদের দ্বারা ও কীভাবে খুন হয়েছিলেন, এই খুনের পেছনের কারণ বা মোটিভ কী ছিল—সবকিছু জাতির জানা প্রয়োজন। কারণ, এটি আর দশটি সাধারণ হত্যাকাণ্ডের মতো নয়, এটি একটি গুরুতর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, যা বাংলাদেশের জাতীয় রাজনৈতিক ইতিহাস ও সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

মশিউল আলম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক

[email protected]