বাংলাদেশের বাস্তবতায় রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের প্রয়োজন অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সেই আইন এমন হওয়া উচিত নয়, যাতে অধিকাংশ সক্রিয় দল নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থাকে। বর্তমান আইন অনুযায়ী একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন নিতে ২২টি জেলা কমিটি এবং ১০০টি উপজেলা কমিটি থাকতে হয়। আবার শুধু কমিটি থাকলে হবে না, সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলায় দলের অফিস থাকতে হবে এবং উপজেলা পর্যায়ের কমিটিতে অন্যূন ২০০ সদস্য থাকতে হবে। নিবন্ধনের জন্য এই শর্ত অত্যন্ত কঠিন বলেই বিবেচনা করতে হচ্ছে।

একটি দলের নিবন্ধনের আগেই দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জেলায় অফিস বা কমিটি করার যে বিধান জারি আছে, সেটি মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। বেশির ভাগ সক্রিয় রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে হলে নির্বাচন কমিশনকে বর্তমান বিধান পুনর্বিবেচনা করতে হবে। অন্যথায় বর্তমানে যে ৪০টি নিবন্ধিত দল আছে, সেগুলোর বাইরে কোনো দল নির্বাচন করতে পারবে না।

উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশনের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ৭৬টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেগুলোর কোনোটিই অনুমোদন পায়নি। শর্তের কড়াকড়ির কারণে এমনটি হয়েছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে গঠনতন্ত্রের কারণেও সেটি হতে পারে। আগে নিবন্ধনের জন্য ১০টি জেলা ও ৫০টি উপজেলা কমিটি থাকার বাধ্যবাধকতা ছিল। সেটি বাড়ানোর কী প্রয়োজন ছিল?

নির্বাচন কমিশনকে মনে রাখতে হবে, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নিবন্ধন নয়, নিবন্ধন হলো নির্বাচনী রাজনীতি যাতে একটি নিয়মকানুনের মধ্যে পরিচালিত হয়, সেটি নিশ্চিত করা। নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কমিটির সংখ্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র তথা রাজনৈতিক কর্মসূচি ও দর্শনকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি বলে মনে করি। যেসব দল বাংলাদেশের সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে, তাদের প্রত্যেকের অধিকার আছে নিবন্ধিত হয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার। এখানে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের প্রসঙ্গটিও এসে যায়। সংবিধানের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক বলেই কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে। বর্তমানে নিবন্ধিত অন্য কোনো দলের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

বেশ কয়েকটি দল সংবাদ সম্মেলন করে নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করার দাবি জানিয়েছে। তারা বলেছে, যেসব দলের কেন্দ্রীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও গঠনতন্ত্র আছে, তাদেরই নিবন্ধিত করা হোক। রাজনীতি জনসেবা হলেও অতীতে অনেকে রাজনৈতিক দলের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে ব্যক্তিগত ফায়দা নিতে সচেষ্ট থেকেছে। সামরিক শাসনামলেই এটি বেশি হয়েছে। এরশাদের আমলে প্রায় সব বিরোধী দল ১৯৮৮ সালের নির্বাচন বর্জন করলে ৭০টির বেশি দল নিয়ে একটি জোট গঠন করা হয়েছিল, যার বেশির ভাগই ছিল প্যাডসর্বস্ব। আমরা প্যাডসর্বস্ব বা বিবৃতিনির্ভর রাজনৈতিক দল চাই না, আবার আইনের কড়াকড়ির কারণে জনগণের কল্যাণে রাজনীতি করে এমন দল নিবন্ধনের বাইরে থাকুক, সেটাও কাম্য নয়। আর নিবন্ধনের কাজটিও কেন নির্বাচন কাছে এলে করতে হবে—সব সময়ের জন্যই এই সুযোগ অবারিত হওয়া উচিত।

দেশে বর্তমানে ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোট ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটভুক্ত দলের সংখ্যাই বেশি। এই নিবন্ধনের বাইরেও অনেক দল আছে, যারা সক্রিয় এবং নিয়মিত রাজনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের যে অংশ বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের নামে নিবন্ধনের দরখাস্ত করেছে, সেই দলের তিনজন সাংসদ আছেন। দলটিকে নিবন্ধন না দিলে সেই সাংসদেরাও দলীয় পরিচয় হারিয়ে ফেলবেন।

তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করে অধিকসংখ্যক রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা।