বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক পটপরিবর্তন ঘটিয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানে সশস্ত্র বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা খুবই আলোচিত। ৩ আগস্ট সেনা সদর দপ্তর থেকে তো সুস্পষ্ট ঘোষণা আসে, আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাবেন না সেনারা। এটি নিশ্চিতভাবেই আন্দোলনের গতিপথ বদলে অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র তৈরিতে বড় ভূমিকা পালন করে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সশস্ত্র বাহিনীর এই ভূমিকাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মো. মাহফুজুর রহমান: আমরা যদি আরব বসন্তের সঙ্গে আমাদের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে তুলনা করি, তাহলে দেখব যে সেখানে শুধু তিউনিসিয়া ও মিসরে গণ-অভ্যুত্থান সফল হয়েছিল। এর মূল কারণ হলো, দেশ দুটির সশস্ত্র বাহিনী আন্দোলনরত জনগণের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। ফলে তিউনিসিয়ায় বেন আলীর ২৩ বছরের এবং মিসরে হোসনি মোবারকের ৩০ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটেছিল।
আমি মনে করি, ৩ আগস্ট বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি না চালানোর সিদ্ধান্ত ছিল হাসিনার শাসনের কফিনে শেষ পেরেক মারা। তবে আমি সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ড চেইনকে সাধুবাদ জানাই দুটি কারণে। প্রথমত, তারা বাহিনীর বৃহত্তর অংশের মনোভাব অনুধাবন করতে পেরেছিল। দ্বিতীয়ত, আমাদের প্রতিরক্ষানীতির একটি স্তম্ভ হচ্ছে, বাহিনী হবে জনবান্ধব। এই দর্শনকে সশস্ত্র বাহিনী যথাযথ গুরুত্ব দিতে পেরেছিল। ফলে সশস্ত্র বাহিনী দেশের বিপদ-আপদে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করবে, এটিই তো স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিত। সশস্ত্র বাহিনী সেটিই করেছে।
বাংলাদেশে বড় বড় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনীর কোনো কোনো ভূমিকা আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখে আসছি। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত স্বৈরশাসক এরশাদের পক্ষে অবস্থান নিতে অস্বীকার করেছিল। বলা হয়, গণ-আন্দোলনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী সমর্থন প্রত্যাহার করাতেই এরশাদ আর টিকতে পারেননি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার জটিলতায় ২০০৬ সালের শেষে যে আন্দোলন ও সহিংসতা ঘটে, তার পরিণতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল এবং সেনাবাহিনী বড় ভূমিকা রাখে। পরবর্তী সময়ে যে সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে, ব্যাপকভাবে তার পরিচিতি ছিল সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর এই ধারাবাহিক ও অব্যাহত ভূমিকার বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কি?
মো. মাহফুজুর রহমান: সশস্ত্র বাহিনীর মূল দায়িত্ব হলো দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষা করা। দেশের মৌলিক মূল্যবোধ ও স্বার্থ যখন হুমকির মুখে পড়ে এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন যদি সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সফল না হয়, সে ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনী তার দায়িত্বের অংশ হিসেবে এগিয়ে আসে।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর জন্মের ইতিহাসটাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। জনগণকে ভিত্তি ও কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বাহিনীর জন্ম। আমাদের প্রতিরক্ষা ডকট্রিনে ‘জনসংখ্যার গভীরতার (পপুলেশন ডেপথ) ব্যবহার’ অন্যতম কৌশলগত (স্ট্র্যাটেজিক) বিষয়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী শেষ পর্যন্ত জনস্বার্থকে প্রাধান্য দেবে, সেটিই স্বাভাবিক।
ফলে ইতিহাসের দিকে যদি তাকান তাহলে দেখবেন, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী শেষ পর্যন্ত জনগণের পক্ষ নিয়েছে। অন্যভাবে যদি বলি, দেশে যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ আসে, সশস্ত্র বাহিনী তাদের দায়িত্বের অংশ হিসেবে এগিয়ে আসে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দুর্যোগ মাঝেমধ্যে এমন পর্যায়ে চলে আসে, যা জনগণ ও দেশের মৌলিক মূল্যবোধের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তখন সশস্ত্র বাহিনী স্বাভাবিকভাবেই জনগণের পাশে দাঁড়ায়। জুলাই অভ্যুত্থানে সশস্ত্র বাহিনী একটি পর্যায়ে এসে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে; কিন্তু ক্ষমতা থেকে তারা দূরে থেকেছে। এখানে সশস্ত্র বাহিনী বেসামরিক শাসনের প্রতি সম্মান জানিয়েছে।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে দলগুলোর মধ্যে আলোচনা, সমঝোতা ও সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা লক্ষণীয়। এই ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মো. মাহফুজুর রহমান: আমি মনে করি, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রথমত, তখন একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সরকারের আর কোনো প্রতিষ্ঠান কার্যত কোনো ভূমিকা রাখার মতো অবস্থায় ছিল না। দ্বিতীয়ত, সরকারের বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান শেষ সময় পর্যন্ত স্বৈরাচারের হয়ে কাজ করেছিল। ফলে তারা তাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিল। অন্যদিকে সশস্ত্র বাহিনী আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে এসে ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়ায় এবং তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। সেই ধারাবাহিকতাতেই সরকার গঠন বা প্রশাসন দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর ওপর সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব এসে যায়।
গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সশস্ত্র বাহিনী রাজনৈতিক ক্ষমতার অধীন। সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা জনগণ দ্বারা নির্দেশিত হয়। তবে ২০২৪ সালে আমাদের দেশের ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগী ভূমিকা ছিল। ফলে এখানে সমীকরণটা একটু ভিন্ন।
পরে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক রূপান্তরের পথে যে অন্তর্বর্তী শাসনকাল চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সম্পর্কটা কতটা কার্যকরভাবে কাজ করছে?
মো. মাহফুজুর রহমান: গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সশস্ত্র বাহিনী রাজনৈতিক ক্ষমতার অধীন। সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতা জনগণ দ্বারা নির্দেশিত হয়। তবে ২০২৪ সালে আমাদের দেশের ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগী ভূমিকা ছিল। ফলে এখানে সমীকরণটা একটু ভিন্ন। বিশেষ এই বাস্তবতায় সশস্ত্র বাহিনী কার্যত সরকারের অধীন হলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখার একটি বিষয় থাকতে পারে। তবে এটা একান্ত আমার ব্যক্তিগত ধারণা।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান প্রশ্নে সেনাপ্রধানের কিছু বক্তব্যে ভিন্নতার সুর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে দ্রুত নির্বাচন, মিয়ানমারকে মানবিক করিডর দেওয়ার ইস্যুসহ দেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে তা বোঝা গেছে। এই অবস্থানকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
মো. মাহফুজুর রহমান: বিগত সরকার গত দেড় দশকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাকেও দুর্বল করেছে। পেশাদারির বাইরে নিয়ে যাওয়ার কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। প্রশিক্ষণ, জনবল, সরঞ্জাম, মেধার মূল্যায়ন—যেগুলো বাহিনীর ভিত মজবুত রাখে, সেগুলো উপেক্ষিত থেকেছে। এ প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর বর্তমান প্রধান অবশ্যই ভালো করে জানেন যে তাঁর বাহিনীর দুর্বলতা কোথায়। আমি মনে করি, সেনাপ্রধান সম্ভবত তাঁর ঘর মানে বাহিনীকে গোছাতে চাইছেন এবং যত দ্রুত সম্ভব বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে চাইছেন। এর মানে হচ্ছে, তিনি তাঁর বাহিনীকে মৌলিক কার্যক্রমে নিয়ে যেতে চাইছেন। আর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে একটি প্রধান অংশীজন হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর মতামত থাকতেই পারে, তবে আমি সেটিকে ডিফারেন্স অব অপিনিয়ন (মতের পার্থক্য) হিসেবে দেখি।
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় অন্তর্বর্তী সরকার, ছাত্রনেতৃত্ব ও সেনাবাহিনী—এই তিন পক্ষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টিকে অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। এখানেও বিভক্তি বা ভুল-বোঝাবুঝির ব্যাপার থাকতে পারে। আবার ছাত্রনেতৃত্বের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। সেনাপ্রধানকে নিয়েও কেউ কেউ অভিযোগ তুলেছেন। এ পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
মো. মাহফুজুর রহমান: যে তিনটি পক্ষের কথা উল্লেখ করলেন, তাদের প্রত্যেকের পরস্পরের কাছ থেকে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির পার্থক্য রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য এটাকেই আমি মূলত দায়ী বলে মনে করি। কেননা, এ প্রতিটি পক্ষের কাছে আমাদের সবার প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। অথচ দেখুন, এদের কারোরই প্রাপ্ত দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। সম্মানিত উপদেষ্টাদের অনেকেরই দেশ চালানোর তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। ছাত্রদেরও জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। সামরিক বাহিনীরও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভঙ্গুর দশায় মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না।
অন্যদিকে ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন রাষ্ট্রযন্ত্রের পুরো কাঠামোটিকে অকার্যকর করে ফেলেছে। এ রকম একটি ভেঙে পড়া ব্যবস্থার মধ্যে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই পক্ষগুলো যতটুকু পারে, সেটি করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সংগত কারণেই তারা আমাদের তো বটেই, নিজেদেরও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে পুরোপুরি সফল হতে পারেনি।
সশস্ত্র বাহিনীগুলোর প্রধান এবং ডিজিএফআই ও এনএসআইপ্রধান নিয়োগ রাষ্ট্রপতি কিংবা নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকলে তেমন গুণগত পরিবর্তন আসবে না। উদাহরণ হিসেবে গত শাসনামলের দিকে তাকাতে পারি। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের হাতে যদি বাহিনীর প্রধান নিয়োগের ক্ষমতা থাকত, তা হলেও কি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া সেই নিয়োগ বাস্তবে সম্ভব ছিল?
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলছে, সেনাবাহিনীর প্রধানসহ সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্য ও বিবেচনাই অনেক সময় কাজ করে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন শুরুতে বিভিন্ন সাংবিধানিক পদসহ সামরিক বাহিনীর তিন প্রধানকে নিয়োগের ক্ষেত্রে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেছিল। রাজনৈতিক দলগুলো তা না মানায় সেই প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়। পরে তিন সশস্ত্র বাহিনীর (সেনা, নৌ ও বিমান) প্রধান এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) মহাপরিচালকসহ ১২টি প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনভাবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়ার প্রস্তাব দেয় কমিশন; কিন্তু বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সশস্ত্র বাহিনীর নিয়োগগুলো নির্বাহী বিভাগের হাতে রাখার পক্ষে। সশস্ত্র বাহিনীর এই পদগুলোতে নিয়োগ প্রশ্নে আপনার অবস্থান কী? কীভাবে তা হওয়া উচিত?
মো. মাহফুজুর রহমান: সশস্ত্র বাহিনীগুলোর প্রধান এবং ডিজিএফআই ও এনএসআইপ্রধান নিয়োগ রাষ্ট্রপতি কিংবা নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকলে তেমন গুণগত পরিবর্তন আসবে না। উদাহরণ হিসেবে গত শাসনামলের দিকে তাকাতে পারি। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের হাতে যদি বাহিনীর প্রধান নিয়োগের ক্ষমতা থাকত, তা হলেও কি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ছাড়া সেই নিয়োগ বাস্তবে সম্ভব ছিল?
আমাদের এখন প্রয়োজন সশস্ত্র বাহিনী এবং সামগ্রিকভাবে এই সেক্টরে সংস্কার করা। নিয়োগের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা। সামরিক কৌশলগত পর্যায়ে (মিলিটারি স্ট্র্যাটেজিক লেভেলে) প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানদের কমিটি (চিফস অব ডিফেন্স কমিটি) অথবা চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ সচিবালয় প্রস্তাবিত তিন বাহিনীর প্রধান নিয়োগের প্যানেল অগ্রাধিকার করে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য অথবা নির্বাহী বিভাগে প্রস্তাব পাঠাবে। ডিজিএফআই ও এনএসআইপ্রধানদের ক্ষেত্রে ফরমায়েশি নিয়োগ থেকে (টপ ডাউন অ্যাপ্রোচ) বিরত থাকতে হবে। এ দুটি পদ খালি হলে বাহিনী প্রস্তাব পাঠাবে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তিন তারকা (লে. জেনারেল) পর্যন্ত পদোন্নতি বা পদায়ন, বাহিনী সিলেকশন বোর্ডের বা বাহিনীর হাতে থাকবে। সে ক্ষেত্রে তিন তারকা পর্যন্ত কর্মকর্তা নির্বাচন মেধা, যোগ্যতা ও সুনামের ভিত্তিতে হয়ে যাবে। ফলে সশস্ত্র বাহিনীগুলোর প্রধানদের নিয়োগ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে হবে, তা যে পদ্ধতিই অনুসরণ করা হোক না কেন।
হাসিনার আমল শুধু নয়, পূর্ববর্তী সরকারগুলোর সময়েও ডিজিএফআই ও এনএসআই, ডিবির মতো সামরিক ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। হাসিনার আমলে তারা গুম ও গোপন নির্যাতন কেন্দ্র আয়নাঘরে ভিন্নমত দমনের কাজে জড়িয়ে পড়েছিল। ভবিষ্যতে এ ধরনের সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং নিজ দেশের নাগরিকদের দমন–পীড়নের কাজে ব্যবহার করা না যায়, তার জন্য কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন? জবাবদিহির কাঠামোটা কী হতে পারে?
মো. মাহফুজুর রহমান: আমি আগেই বলেছি, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা খাত সংস্কার করা প্রয়োজন। ডিজিএফআই হলো সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা। এটি শান্তি ও যুদ্ধকালীন বাহিনীর অপারেশন ও প্রশাসনসংক্রান্ত গোয়েন্দা সহায়তা দিয়ে থাকে। বিশেষ করে কমব্যাট ইন্টেলিজেন্স (যুদ্ধকালীন গোয়েন্দা তথ্য) খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিজিএফআইকে রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করার বা লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করার প্রবণতা থেকে বের করে আনতে হলে এ সংস্থাকে কমান্ড স্ট্র্যাকচারের মধ্যে রাখতে হবে। ডিজিএফআই সামরিক কৌশলগত কমান্ডের অধীন কাজ করবে; অর্থাৎ উচ্চতর প্রতিরক্ষা সংস্থা যেমন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) হেডকোয়ার্টারের অধীন থাকবে। এনএসআই যুদ্ধকালীন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের অধীন ও শান্তিকালীন নির্বাহী বিভাগের অধীন কাজ করতে পারে। তবে ডিবি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কমান্ড চ্যানেলের মধ্যে থাকবে। এসব সংস্থার দেশের নির্বাহী বিভাগ বা প্রধানমন্ত্রীর কমান্ডে কাজ করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
৫ আগস্ট থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠে নিয়োজিত আছে সশস্ত্র বাহিনী। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়েই তারা মাঠে আছে; কিন্তু গত এক বছরে নাগরিকদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের একটি জায়গা হলো নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তো তেমন বড় উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।
মো. মাহফুজুর রহমান: অভ্যুত্থানের পর সশস্ত্র বাহিনী মাঠে থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক অবস্থায় ফিরে আসেনি বলেই উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। সশস্ত্র বাহিনী অতীতে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়ক শক্তি হিসেবে মাঠে কর্মরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হতো। পুলিশ ও আনসার বাহিনী এখনো পুরো মাত্রায় কার্যকর হতে পারেনি। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
সেনাবাহিনী তাদের নিজস্ব দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ৩০ হাজারের মতো জনবল মাঠে মোতায়েন করতে পেরেছে। দুই লাখ পুলিশের কার্যকারিতা ৩০ হাজার সেনাসদস্য দিয়ে পূরণ করা কষ্টসাধ্য। গুরুতর অপরাধী বা দাগি অপরাধীদের শনাক্ত ও অপরাধের আগেই তাদের পাকড়াও করার ক্ষেত্রে পুলিশ ও র্যাবের গোয়েন্দা সংস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। মাঠে তারাও এখনো পুরো মাত্রায় সক্রিয় নয়। আমার মনে হয়, সশস্ত্র বাহিনী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ব্যবহারের বিষয়েও সম্ভবত রক্ষণশীলতা অবলম্বন করছে, যেন এই ক্ষমতার ভুল প্রয়োগ না হয়। এত সব সীমাবদ্ধতার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তুষ্টির স্তরে যেতে পারেনি। এটা সবার জন্যই একটি অস্বস্তির বিষয়।
পরপর তিনটি প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচনে দেশের নাগরিকেরা তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। এর পরিপ্রেক্ষিতে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, নাগরিকেরাও অপেক্ষা করে আছেন একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়ও ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এ মুহূর্তে পুলিশের যে সামর্থ্য, তাতে জননিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ আছে। সে ক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে সেনাবাহিনীর কতটা এবং কী ভূমিকা থাকা উচিত।
মো. মাহফুজুর রহমান: একটি সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন সবার প্রত্যাশা। বর্তমান নির্দলীয় সরকারের অধীন এবং নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থাপনায় আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা থাকবে, সবাই সেটি আশা করে। আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশনের আওতায় সশস্ত্র বাহিনী লিড সংগঠন হিসেবে সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে সুষ্ঠু একটা জননিরাপত্তা পরিবেশ তৈরি করবে। এরই মধ্যে আমরা জানতে পেরেছি, নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির জন্য সেনাবাহিনী ৮০ হাজারের মতো জনবল দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।
প্রথম আলো: বর্তমান আরপিওতে নির্বাচনকালীন ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’ বলতে যা বোঝানো হয়েছে, সেখানে সেনাবাহিনী অন্তর্ভুক্ত নয়। নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনে বর্তমানে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিধান রয়েছে, যা মূলত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী হয়ে থাকে। গত তিনটি নির্বাচনে সেনাবাহিনী কার্যত তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
প্রশ্ন হচ্ছে, সেনাবাহিনী বিগত নির্বাচনগুলোর মতো স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করলে নিরাপত্তা ও নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে নাগরিকেরা কতটা স্বস্তিতে থাকবেন? সেনাবাহিনীর সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা চাইলে তো আরপিও সংশোধন করতে হবে। আপনার মন্তব্য কী?
মো. মাহফুজুর রহমান: ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে সশস্ত্র বাহিনী ও কোস্টগার্ডকে অন্তর্ভুক্তির উদ্যোগ নিয়েছে। আমি আশা করি, ইসির এই প্রস্তাব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে। এর মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সেনাবাহিনী সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
বর্তমান সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
মো. মাহফুজুর রহমান: ২০১৬ সালে মিয়ানমারের জান্তা প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে সারা বিশ্বের ও বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করেছিল। সে সময় বাংলাদেশের ভূমিকা শুধু নালিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বুঝে যায়, বাংলাদেশের ডেটারেন্স (বাধা প্রদান) ও সক্ষমতার অভাব রয়েছে।
এরপর ২০১৭ সালে তারা পরিকল্পনামাফিক আরও সাত-আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। রাখাইনে যে আরও পাঁচ-ছয় লাখ রোহিঙ্গা আছে, ভবিষ্যতে তাদেরও বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হতে পারে। আগে তাতমাদো (মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী) আমাদের সঙ্গে গুন্ডামি করত, বর্তমানে জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি আমাদের সঙ্গে তর্জন-গর্জন করছে। এর কারণ হলো, বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধের ঘাটতি রয়েছে।
গত ১৫ বছরে অনেক ক্ষেত্রে আমরা বাহিনীতে মেধার মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছি। বাহিনীতে মেধার অভাব থাকলে আপনি আপনার প্রতিপক্ষকে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পরাস্ত করতে ব্যর্থ হবেন। আবার অনেক সময় আমাদের বাহিনীতে বিক্রেতাদের স্বার্থে কেনাকাটা হয়েছে। এটি আমাদের কাঙ্ক্ষিত সক্ষমতা অর্জনে অন্তরায় হয়েছে।
এর বিপরীত দিকটাও আছে। আমাদের বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে কাউন্টার ইনসারজেন্স অপারেশনস ও জাতিসংঘ মিশনে দক্ষতা প্রদর্শনে সক্ষমতা দেখিয়েছে। অর্থাৎ আমাদের বাহিনীর মৌলিক শক্তি ঠিক আছে। এখন বাহিনীগুলোকে অপারেশনাল ও লজিস্টিক অডিটের মাধ্যমে ‘শক্তি ও দুর্বলতা’ নিরূপণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কমান্ডের স্বাতন্ত্র্য দিয়ে বাহিনীগুলোকে প্রস্তুত করার সুযোগ দিতে হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মো. মাহফুজুর রহমান: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।