সড়ক দুর্ঘটনা: মৃত্যুমিছিলের শেষ কোথায়?

২০১৮ সালে রাজধানীতে চালকের বেপরোয়া গতির শিকার হয়ে প্রাণ হারায় দুই স্কুলশিক্ষার্থী। দেশজুড়ে শুরু হয় নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, যার নেতৃত্বে ছিল শিক্ষার্থীরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় বিদ্যমান আইন সংশোধনে এবং প্রণীত হয় ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ এবং ২২ অক্টোবরকে ঘোষণা করা হয় ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে।

প্রতিবছর নানান কার্যক্রমের মাধ্যমে দিবসটিকে উদ্‌যাপন করা হয়। নানান আনুষ্ঠানিকতায় দিবস পালিত হলেও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কমছে না। সড়কের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হলেও ফিটনেসবিহীন গাড়ি এখনো সড়কে নির্বিঘ্নে চলাচল করছে।

বিআরটিএর সূত্রমতে, দেশে প্রায় ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন গাড়ি রয়েছে, যার প্রায় ৭০ শতাংশই রাস্তায় নিয়মিত যাত্রী পরিবহন করছে। সংশোধিত আইন কঠোর হলেও এর যথাযথ প্রয়োগ মিলছে না কোথাও। গাড়ির ফিটনেসের দশার সঙ্গে সঙ্গে অদক্ষ চালকের সংখ্যাও অনেক। চালকের অদক্ষতা ও ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে অহরহ।

গত বছর প্রায় ২৮৯ জন পেশাদার চালকের চোখ পরীক্ষা করে বিআরটিএ, যাঁদের মধ্যে ১৬৪ জনের গুরুতর সমস্যা এবং ৫৯ জনের অন্যান্য সমস্যা ধরা পড়ে। ত্রুটিপূর্ণ যান ও চালকের জন্য সড়ক এখন রীতিমতো মৃত্যুফাঁদ। সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ জন বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।

সংশোধিত সড়ক আইন ২০১৮–এর পর মানুষ যখন আশা করেছিলেন, সড়কে চলাচল জনসাধারণের জন্য আরও নিরাপদ হবে, তখন তার সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। বিদায়ী বছর ২০২২–এ সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার ছিল সর্বোচ্চ। গত বছর প্রায় সাড়ে ৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৫৩৩ জনের। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। এ নিয়ে দফায় দফায় আন্দোলন করেও দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না।

গত ১৫ মে জাতিসংঘের রোড সেফটি সপ্তাহ উপলক্ষে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা মোর্চা রোড সেফটি কোয়ালিশন। সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন নিরাপদ সড়ক চাই-এর (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। তাতে বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের বৈজ্ঞানিক ও স্বীকৃত কোনো পদ্ধতি বাংলাদেশে নেই। এর ফলে দুর্ঘটনার তথ্য নিয়ে ভিন্নতা দেখা যায়। বাংলাদেশ পুলিশের দেওয়া দুর্ঘটনার তথ্যের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে পার্থক্য থাকে প্রায় পাঁচ গুণ।

প্রবন্ধে বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনার ফলে দেশের স্বাস্থ্য খাতে চাপ বাড়ছে এবং অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশ সফলভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মৃত্যুহার কমিয়েছে, কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও সড়কে প্রতিনিয়ত মানুষের মৃত্যু ঘটছে। নিরাপদ সড়কের জন্য জাতিসংঘ স্বীকৃত পাঁচটি স্তম্ভ—নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ মোটরযান, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী এবং দুর্ঘটনা-পরবর্তী চিকিৎসা। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত একটি নতুন আইন করতে হবে।

রাস্তায় অবৈধ গাড়ির সঙ্গে বাড়ছে লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ চালকের সংখ্যা, পথচারীদের অসতর্কতাও বাড়াচ্ছে দুর্ঘটনা। আদরের সন্তান বা পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। মৃত্যুবরণ না করলেও অনেককে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করতে হচ্ছে। কুঁড়িতেই বিনষ্ট হচ্ছে অনেক সম্ভাবনা।

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর এই ব্যাপক হারের জন্য বলা হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মহামারি। আজ ২২ অক্টোবর ২০২৩ সপ্তমবারের মতো পালিত হবে ‘নিরাপদ সড়ক দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য—আইন মেনে সড়কে চলি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি। শুধু জাঁকজমকপূর্ণভাবে দিবস পালন নয়, প্রণীত আইন সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে সড়কে যাতে সত্যিকার অর্থে নিরাপত্তা ফিরে আসে, তা–ই জনসাধারণের একমাত্র চাওয়া।

সুমাইয়া তাসনিম তানজিলা
শিক্ষার্থী
শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: [email protected]