পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করা

স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ তার গর্বিত উপস্থিতি ঘোষণা করে চলেছে সাড়ে চার দশক ধরে। সাড়ে চার দশকের স্বাধীন অস্তিত্ব একটি দেশের জন্য একেবারে কম কোনো কিছু নয়, বিশেষ করে সেই দেশটি যদি হয়ে থাকে খাদ্যঘাটতি আর এর ফলে দুর্ভিক্ষকবলিত। সাড়ে চার দশক আগে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব যারা দেখতে চায়নি, তারা কিন্তু শুরুর সেই দিনগুলোতে সে রকম এক বাংলাদেশকেই চেয়েছিল, যে দেশটি লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে চলে অল্প পরেই ক্লান্ত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে আর অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকার আকুতি বিশ্বজুড়ে জানাবে।
তবে আমাদের সে রকম অকল্যাণ শুরুতে যারা কামনা করেছিল, তাদের সেই বাড়া ভাতে ছাই দিয়েই কেবল বাংলাদেশ ক্লান্তির অবসাদ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায়নি, একই সঙ্গে সেই দলের অনেককেও ছাড়িয়ে গিয়ে বলিষ্ঠ পদচারণে এখন সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। ফলে এদের যে গাত্রে দাহন দেখা দেবে, তা খুবই স্বাভাবিক। পাকিস্তানের বেলায় ঠিক সে রকম একটি বিশ্লেষণই মনে হয় সবচেয়ে জুতসই বিবেচিত হবে।
আমাদের স্বাধীন অস্তিত্ব পাকিস্তানের জন্য আসলেই হচ্ছে গাত্রদাহ। কেননা, বাংলাদেশের ওপর খবরদারি হারিয়ে ফেলায় দেশটি নানাদিক থেকে হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রথমত, ইসলামি বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্রের অবস্থান থেকে এর হয়েছে স্থানচ্যুতি। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে মানসম্মান হারানোর ব্যাপারটাও পাকিস্তান কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না, যে মানসম্মান বিসর্জন যাওয়ার মধ্যে গণহত্যা চালানোর দায়ে অভিযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী এবং সবচেয়ে যুদ্ধ পারঙ্গম সামরিক বাহিনী হিসেবে নিজেদের প্রচার করে বেড়ানো সেনাসদস্যদের অভুক্ত-অর্ধাহারী এবং সাধারণ মানুষের কাতার থেকে উঠে আসা মুক্তিবাহিনীর হাতে বেদম মার খাওয়ার গ্লানিও অন্তর্ভুক্ত আছে। বিশ্বের সবচেয়ে অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর প্রাণভয়ে দিগ্বিদিক ছুটে যাওয়া, সে তো আমাদের নিজেদের চোখে দেখা।
বলা যায় পরাজয়ের আর অপমানের সেই গ্লানি থেকে বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব পাকিস্তান কখনোই মেনে নিতে পারেনি এবং সুযোগ পেলেই নানা অজুহাতে আমাদের ঘায়েল করার চেষ্টা দেশটি সব সময় করে গেছে। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর হঠাৎ করেই বাংলাদেশের বন্ধু হয়ে ওঠাও ছিল পাকিস্তানের প্রতিশোধস্পৃহারই একটি অংশ, যার নগ্ন ছাপ ইসলামাবাদ ফুটিয়ে তুলেছে নিজের স্বার্থ উদ্ধারে আমাদের ভূমি ব্যবহারের জঘন্য প্রয়াসের মধ্য দিয়ে। বলা বাহুল্য, ১৯৭৫ সালের পর দীর্ঘ একটি সময় ধরে আমাদের দেশে যারা ক্ষমতার রজ্জু হাতে নিয়ে বসে ছিল, তাদের দেশপ্রেমের ঘাটতির পুরো সুযোগ পাকিস্তান কাজে লাগিয়েছিল তার নিজের স্বার্থ উদ্ধারে। সেই দিনগুলোতে অনেকেই যখন হয়তো ভেবেছিলেন যে পাকিস্তান সম্ভবত অতীতের গ্লানি ভুলে গিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাংলাদেশের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে, তাদের সেই হিসাব এ কারণে ভুল ছিল যে পাকিস্তান কখনোই আমাদের বন্ধু হতে চায়নি বরং যা চেয়েছে তা হলো, বন্ধুত্বের মুখোশ পরে প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করা।
১৯৭১ সালে কী ঘটেছিল, পাকিস্তানের জনগণের এক বিশাল অংশ কিন্তু সাড়ে চার দশক পরেও তা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা আঁকড়ে ধরে বসে আছে। তারা মনে করে, বাংলাদেশের সেই সময়ের নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগ নিয়ে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রটিকে ভেঙে দুই টুকরো করে দিতে পেরেছে। পাকিস্তানে এই ভ্রান্ত শিক্ষার শুরু ১৯৭১ সাল থেকেই এবং পরবর্তী সময়ও এর কোনো রকম ব্যত্যয় ঘটেনি। দেশটির স্কুল পাঠ্যপুস্তকে অনেকটা সে রকম শিক্ষাই নতুন প্রজন্মকে এখনো দেওয়া হচ্ছে। ফলে একালের পাকিস্তানিদের মধ্যেও অনেকেই মনে করে বাংলাদেশিরা হচ্ছে গাদ্দার ও ইসলামের শত্রু। জুলফিকার আলী ভুট্টো তো বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কখনোই মেনে নিতে পারেননি, যদিও এটা বাস্তব সত্য যে সেই বিচ্ছিন্নতার পেছনে তার গোঁয়ার্তুমি আর ক্ষমতার লোভ বড় ভূমিকা রেখেছিল। পাকিস্তানের অন্য আর কোনো অংশ যেন সেই সাহস আর না দেখাতে পারে, সে জন্য ঘাস খেয়েও পাকিস্তানের জন্য আণবিক বোমা তিনি বানিয়ে দিয়ে গেছেন। আর তাঁর মেয়ে বেনজির বাবার চেয়ে আরও এক কাঠি ওপরে উঠে নিজের আত্মজীবনীতে ১৯৭০ সালের নির্বাচন–পরবর্তী ঘটনার জন্য অন্যায়ভাবে বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করতেও লজ্জা বোধ করেননি।
সাড়ে চার দশক ধরে এ রকম সব নেতৃত্বই কিন্তু পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন, তা সে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই হোক কিংবা হোক তা সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে। বাংলাদেশ যেন এদের সবার জন্য গলায় আটকে থাকা মাছের কাঁটা, দেশটিকে পরোক্ষভাবে বশংবদ রাখার মধ্য দিয়েই যে কাঁটার যন্ত্রণাদায়ক উপস্থিতি তাদের পক্ষে ভুলে থাকা সম্ভব। আর সে রকম মনোবাসনা থেকেই ইচ্ছা করে বাংলাদেশের সঙ্গে ঝগড়া বাধাতে এতটা উদ্গ্রীব পাকিস্তানের নেতৃত্ব।
এর বাইরে আবার ইদানীং যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশকে নিয়ে এদের মধ্যে দেখা দেওয়া হিংসার বোধ। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির সব রকম মাপকাঠিতেই বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানকে ছেড়ে জোর কদমে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। গাদ্দারদের এই বুক ফুলিয়ে এগিয়ে যাওয়া কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? সে রকম দৃষ্টিকোণ থেকেই আমাদের নানা রকম অগ্রযাত্রা যেভাবে পারা যায় ঠেকিয়ে রাখতে এরা তৎপর। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে আমাদের এগিয়ে চলার আরেকটি দৃষ্টান্ত। অতীতকে অস্বীকার করে কোনো জাতি দায়মুক্ত হতে পারে না এবং সামনে এগিয়ে যাওয়াও সেই জাতির পক্ষে সম্ভব নয়। ১৯৭৫-পরবর্তী বিস্মরণের কালো অধ্যায় আমরা পার হতে পেরেছি বলেই আমাদের অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়ে উঠছে।
অন্ধকারকে পুরোপুরি দূর করতে হলে আরও যা প্রয়োজন তা হলো আমাদের আগামী প্রজন্মকে ইতিহাসের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে অন্ধকার দূর করার চলমান সেই প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। বিচারে দণ্ডের মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক কিংবা অনাহূত কিছু নয়। যত দিন পর্যন্ত আমরা সম্মিলিতভাবে মৃত্যুদণ্ডকে আসলেই দানবীয় আচরণ হিসেবে আখ্যায়িত না করি, তত দিন পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে কথা বলে গেলেও বিচারের রায়কে অন্যায় আখ্যায়িত করা অযৌক্তিক। পাকিস্তান কিন্তু সে রকম অবস্থান থেকে আমাদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সমালোচনায় লিপ্ত হয়নি। বরং ১৯৭১ সালের সাফাই গেয়ে নিজেদের বন্ধুদের মৃত্যুদণ্ড রদের জন্য মাতম তোলা পাকিস্তানের নির্বুদ্ধিতারই পরিচয় তুলে ধরে।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করে বলতে হয় যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে বাংলাদেশ কিন্তু কখনোই নাক গলায়নি, যদিও আমাদের বেলায় সে রকম নাক গলানো এ কারণে অনেক বেশি যুক্তিসংগত শোনাতে পারত যে সম্পদের ন্যায়সংগত প্রাপ্য ভাগ-বাঁটোয়ারার কিছুই পাকিস্তান আমাদের কখনোই দেয়নি। সে রকম অবস্থায় আমাদের করণীয় কী হতে পারে?
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক।