খালেদা জিয়ার জানাজায় জনতার ঢল কী বার্তা দিয়ে গেল

খালেদা জিয়ার জানাজায় যোগ দিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে মানুষের ঢল।ছবি: প্রথম আলো

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের আকাশ তখন ভারী। শুধু শোকের ভারে নয়, ইতিহাসের ভারেও। বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জানাজা শুরু হয় ৩টা ৩ মিনিটে। দুই মিনিট পর, ৩টা ৫ মিনিটে জানাজা শেষ।

কিন্তু সেই দুই মিনিটে যা ঘটল, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহু দশকের জন্য অনুরণিত হয়ে থাকবে।

মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ তখন কেবল একটি সড়ক নয়। সেটি হয়ে উঠেছিল একটি জনসমুদ্র। বিজয় সরণি, খামারবাড়ি, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, শাহবাগ, মোহাম্মদপুর—সব দিক থেকে মানুষ এসে মিশে ছিল এক বিন্দুতে।

কেউ গুনতে পারেনি কত মানুষ ছিল। কেউ বলেছে ২০ লাখ, কেউ বলেছে ৩০ লাখ, কেউ বলেছে তারও বেশি।

কিন্তু সংখ্যার হিসাব এখানে গৌণ। নিশ্চিত সত্য একটাই—এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব জানাজা। এমনকি বৈশ্বিক পরিসরে প্রয়াত মুসলিম নেতাদের জানাজার ভিড়ের তালিকায়ও এটি বিরল।

১৯৮৯ সালের জুনে মারা যান ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি। তাঁর জানাজায় এক কোটির বেশি মানুষ অংশ নিয়েছিলেন।
ছবি: সংগৃহীত

এই দৃশ্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ১৯৮৯ সালের তেহরানকে। মনে করিয়ে দেয় আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির জানাজার কথা। সেখানে ছিল কোটি মানুষের উপস্থিতি। সেই জনসমুদ্র কোনো দলের কর্মী ছিল না। ছিল একটি রাজনৈতিক জীবনের প্রতি জনগণের শেষ উচ্চারণ।

আবার স্মরণে আসে মিসরের গামাল আবদেল নাসের, ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা—যাঁদের জানাজা বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় মানুষ এসেছিল কেবল শোক জানাতে নয়, ইতিহাসের সঙ্গে নিজের অবস্থান জানাতে।

খালেদা জিয়ার জানাজাও তেমন এক মুহূর্ত। এটি কেবল এক নেত্রীর বিদায় নয়, এটি ছিল একটি প্রশ্নের জবাব—বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনতার হৃদয় কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?

দীর্ঘদিন ধরে খালেদা জিয়া ছিলেন ক্ষমতার বাইরে। কারাবন্দী, অসুস্থ, নীরব। রাষ্ট্রীয় ভাষ্য তাঁকে প্রায় অদৃশ্য করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এই জানাজা প্রমাণ করল, রাজনীতিতে দৃশ্যমানতা সব সময় ক্ষমতার সঙ্গে আসে না। কখনো কখনো তা আসে ভোগান্তির মধ্য দিয়ে, নীরবতার ভেতর দিয়ে। জনতা দেখিয়েছে, তারা ভুলে যায়নি।

আরও পড়ুন

এই জন–উপস্থিতি বিএনপির জন্য কেবল শোকের নয়, উজ্জীবনেরও বার্তা। দীর্ঘদিন নিপীড়ন, বিভাজন, ভাঙনের মধ্য দিয়ে যাওয়া একটি দল হঠাৎ আবিষ্কার করল—তার সামাজিক শিকড় এখনো অটুট।

এই জানাজা বিএনপিকে নতুন করে আত্মবিশ্বাস দিল যে রাজনীতি শুধু প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে চলে না, মানুষের অনুভূতিও একে চালায়।

একই সঙ্গে এই দৃশ্য আওয়ামী লীগের জন্য গভীর চিন্তার বিষয়। কারণ, ক্ষমতার দীর্ঘ মেয়াদ সত্ত্বেও এমন স্বতঃস্ফূর্ত জনসমাবেশ তারা দীর্ঘদিন দেখাতে পারেনি। এটি মনে করিয়ে দেয়—রাষ্ট্র আর সমাজ এক নয়। প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ থাকলেও সামাজিক বৈধতা চিরস্থায়ী নয়।

এই জনসমুদ্রের অভিঘাত কেবল দেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আন্তর্জাতিক রাজনীতির সূক্ষ্ম রাডারেও এটি ধরা পড়েছে। ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে শীতল।

তবু এমন এক মুহূর্তে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সাক্ষাৎ করেছেন এবং সেখানে তিনি তারেক রহমানের হাতে ভারতের শোকবার্তা হস্তান্তর করেছেন। বলা হচ্ছে, সৌজন্য ও সমবেদনার সাক্ষাৎ।

আমরা জানি, রাজনীতিতে সৌজন্য কখনোই অর্থহীন, বার্তাহীন বা নিরীহ কিছু নয়। কূটনীতির ভাষায় সৌজন্য মানে প্রায়ই পরিস্থিতি স্বীকার করে নেওয়া, আর কখনো কখনো ভবিষ্যতের দরজা খোলা রাখা।

তারেক রহমানের হাতে ভারতের শোকবার্তা হস্তান্তর করছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
ছবি: দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার রিয়াজ হামিদুল্লাহর এক্স থেকে

সেই বিবেচনায় জয়শঙ্করের মাধ্যমে শোকবার্তা পৌঁছে দেওয়া এবং তা তারেক রহমানের হাতে তুলে দেওয়াকে একটি সাধারণ প্রটোকলমাত্র বলে ধরে নেওয়া কঠিন।

প্রশ্নটি তাই স্বাভাবিকভাবেই ওঠে—এটি কি মোদি সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপির প্রতি একটি নরম ইঙ্গিত?

এ বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। কারণ, কূটনীতি কখনো সরল বাক্যে কথা বলে না। কিন্তু এটুকু বলা যায়, ভারত বাস্তবতা পড়তে জানে। আর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের এই জনসমুদ্রের বাস্তবতা ভারতের কূটনৈতিক দৃষ্টির বাইরে থাকার কথা নয়।

অতীতে বিএনপির সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ছিল দূরত্বপূর্ণ, কখনো বৈরীও। কিন্তু রাজনীতি চিরস্থায়ী শত্রু বা মিত্র চেনে না। চেনে কেবল সম্ভাবনা।

খালেদা জিয়ার জানাজা সেই সম্ভাবনাকে দৃশ্যমান করেছে। আর সেই দৃশ্যমান বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই জয়শঙ্করের এই শোকবার্তাকে পড়তে হয়।

আরও পড়ুন

এই পরিপ্রেক্ষিতকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার সরদার আইয়াজ সাদিকের তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও সহমর্মিতা প্রকাশ।

কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পাকিস্তানের প্রতীকী উপস্থিতি সব সময়ই অর্থবহ। এটি কেবল দ্বিপক্ষীয় সৌজন্য নয়; এটি আঞ্চলিক ভারসাম্যের ভাষা।

একই সঙ্গে ভুটান, মালদ্বীপ ও নেপালের সরকারি প্রতিনিধিদের উপস্থিতি এবং বহু দেশের কূটনীতিকদের অংশগ্রহণ—সব মিলিয়ে একটি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের ছবি সামনে আনে।

এটি স্পষ্ট যে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতি এখন আর কেবল অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এটি আঞ্চলিক শক্তিগুলোর হিসাবেও ঢুকে পড়েছে।

এই উপস্থিতিগুলো ইঙ্গিত দেয়, আঞ্চলিক শক্তিগুলো বিএনপিকে আর শুধু অতীতের একটি অধ্যায় হিসেবে দেখছে না। তারা দলটিকে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ হিসেবেও বিবেচনায় নিতে শুরু করেছে।

রাষ্ট্র যখন নিজের শক্তিকে কেবল কাঠামোতে সীমাবদ্ধ করে ফেলে, তখন সে ভুলে যায়, ইতিহাস শেষ পর্যন্ত লিখিত হয় মানুষের অনুভূতিতে, নথিতে নয়। এই জানাজায় যে জনসমুদ্র আছড়ে পড়েছিল, তা ছিল সেই জন–অনুভূতির দৃশ্যমান রূপ। রাষ্ট্র যখন মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে চায়, মানুষ তখন ভাষা বদলায়। তারা স্লোগান দেয় না, ব্যানার তোলে না—তারা ইতিহাসের ভাষায় কথা বলে। জানাজা তখন আর ধর্মীয় আচার থাকে না; তা হয়ে ওঠে নীরব গণভোট।

এই জানাজা আমাদের সামনে যে সত্যটি উন্মোচন করে, তা কেবল রাজনীতির নয়, এটি রাষ্ট্রচিন্তার গভীরতম স্তরের সত্যকেও তুলে ধরে। এই জানাজা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ক্ষমতা কখনোই শুধু প্রশাসনের দখলে থাকা কোনো যন্ত্র নয়।

পুলিশ, আইন, নির্দেশনা কিংবা দপ্তরের সিলমোহর দিয়ে ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা যায় না। ক্ষমতার আসল বাসস্থান মানুষের চেতনায়—স্মৃতির স্তরে, আবেগের গভীরে, ন্যায়-অন্যায়ের বোধে।

রাষ্ট্র যখন নিজের শক্তিকে কেবল কাঠামোতে সীমাবদ্ধ করে ফেলে, তখন সে ভুলে যায়, ইতিহাস শেষ পর্যন্ত লিখিত হয় মানুষের অনুভূতিতে, নথিতে নয়। এই জানাজায় যে জনসমুদ্র আছড়ে পড়েছিল, তা ছিল সেই জন–অনুভূতির দৃশ্যমান রূপ।

রাষ্ট্র যখন মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করতে চায়, মানুষ তখন ভাষা বদলায়। তারা স্লোগান দেয় না, ব্যানার তোলে না—তারা ইতিহাসের ভাষায় কথা বলে। জানাজা তখন আর ধর্মীয় আচার থাকে না; তা হয়ে ওঠে নীরব গণভোট।

তবে এই জনসমুদ্রকে কোনো চূড়ান্ত রায় হিসেবে পড়লে ভুল হবে। কারণ, ইতিহাস কখনো এক দিনে শেষ কথা বলে না।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    ই–মেইল: [email protected]

    *মতামত লেখকের নিজস্ব