তাহরির পারেনি, শাহবাগ পেরেছে

শাহবাগ বিপ্লব
শাহবাগ বিপ্লব

দুই বছর আগের চিত্র। তাহরিরে আরব বসন্ত কেবল আপাত সাফল্য পেয়েছে। ৩২ বছরের মোবারক শাসন অপস্রিয়মাণ। ঢাকায় মাল্টিন্যাশনালে কর্মরত এক শীর্ষ মিসরীয় কর্মকর্তা সান্ধ্য আড্ডায় জানাচ্ছেন, উত্তেজনা ধরে না রাখতে পেরে কাউকে কিছু না জানিয়ে উইকএন্ডেই চলে গিয়েছিলেন তাহরিরে। নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকার পোশাক কারখানায় তৈরি কয়েক শ টি-শার্ট। তাহরিরের বিপ্লবী যোদ্ধাদের গায়ে বাংলাদেশি টি-শার্ট চড়িয়ে সেই বিপ্লবের সঙ্গে বাংলাদেশকে একাত্ম করার কৃতিত্ব নিচ্ছিলেন তিনি।
কয়েক মাস পরে ওয়াশিংটনে গণমাধ্যম নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সব ছাপিয়ে আরব বসন্ত, সোশ্যাল মিডিয়ার দাপট। কায়রো আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা তরতর করে তুলে ধরছেন তাহরিরের বিস্ময়কর চিত্র। সফল বিপ্লবের যোদ্ধার অহংকার ছিটকে পড়ছিল তাঁর চোখ-মুখে।
আনুষ্ঠানিক বক্তব্য শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে হাত তুললাম, খুব সহজ ভাষায় জানতে চাইলাম বিপ্লব থেকে তাঁদের অর্জনটা কী, কীভাবেই বা এই বিপ্লব ভবিষ্যৎ পথ ধরে এগোবে। জবাব যেন ঠোঁটের আগায়: বিপ্লবের অর্জন হলো ৩২ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান, বিদায় নিয়েছেন হোসনি মোবারক। আর ভবিষ্যৎ হলো, মিসর এখন এগোবে গণতান্ত্রিক পথে। এর মধ্যেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে কাউন্সিল দায়িত্ব নিয়েছে এবং সেনাবাহিনীই মিসরে প্রতিষ্ঠা করবে গণতান্ত্রিক ধারা! জবাবের শেষ অংশ শুনে আঁতকে উঠলাম। পাশে বসা পাকিস্তানি আর নাইজেরীয় সাংবাদিক বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে দেখি, তাঁদের চোখও কপালে উঠেছে। সেনাশাসন কীভাবে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয় বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর নাইজেরিয়ার চেয়ে আর কার সেই অভিজ্ঞতা আছে!
সেই আরব বসন্তের দুই বছর পূর্তিতে ২৫ জানুয়ারি (২০১৪) তাহরির স্কয়ার সরব, উৎসবমুখর। সব প্রবেশপথে সেনাপ্রহরা, নিরাপত্তার কারণে এক-একজন করে ঢোকানো হচ্ছে। দিনের উত্তপ্ত কায়রোর পথে পা বাড়িয়েও গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা চলছে। কায়রোর বন্ধুরা পরামর্শ দিলেন—সন্ধ্যায় বের হও, তখন তাহরিরমুখী মানুষের ঢলের কাছে সব ধুয়েমুছে যাবে। ঘটলও তা-ই, সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত গড়িয়ে তাহরিরের ভিন্ন রূপ।
কিন্তু এবার ২৫ জানুয়ারির গোটা তাহরির যেন অন্য রকম। তরুণদের চেয়ে বেশি মাঝবয়সীরা, মহিলাদের অংশগ্রহণ ব্যাপক। গোটা তাহরির ছেয়ে গেছে সেনাপ্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল সিসির ছবি, পোস্টার, ব্যানারে। বিক্রি হচ্ছে জেনারেল সিসির মুখোশ, কোটপিন। প্রায় সবার মাথায় সিসি ছবির ক্যাপ, পট্টি। আর শিশু-কিশোরদের ভুভুজেলায় কেবল টানা সিসি, সিসি। ব্যাখ্যা করলেন মিসরীয় গণমাধ্যম কর্মী, বললেন, গণতন্ত্রের একটু ঝলকে ব্রাদারহুড নামক যে ঝড় মিসরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে, তাতে আতঙ্কিত মিসরের সাধারণ মানুষ।
ব্রাদারহুড নেতাদের বিচার হচ্ছে। আরব বসন্তের হতাশ সৈনিকেরা গণতন্ত্র চাইছে কিন্তু বিপ্লবের পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাবে তেমন নেতা বা সংগঠন নেই। ফলে আবার সেই সেনাবাহিনীই ভরসা। বিশেষ করে এবার তাহরিরের বেশির ভাগজুড়ে যে মাঝ বয়সীদের অবস্থান, তাঁরা চান আধুনিক মিসর চালাতে পারেন এমন একজন দৃঢ় শাসক। সেই দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে আসবে এমন কোনো রাজনৈতিক সংগঠনই নেই। ফলে একমাত্র ভরসা সেনাবাহিনী। আর সেই শক্তি নিয়েই মঞ্চে জেনারেল সিসি। ঘোষণা দিয়েছেন, সেনাবাহিনী সমর্থন দিলে আর জনগণ চাইলে তাঁর প্রেসিডেন্ট হতে আপত্তি নেই!! সেনাবাহিনী সমর্থন দিয়েছে, বিপ্লবের দ্বিতীয় বার্ষিকী উদ্যাপনের এক দিন পর তিনি হয়েছেন ফিল্ড মার্শাল আর তাহরিরের জনস্রোত তো এখন তাঁরই পক্ষে। কাজেই অপেক্ষা কেবল ঘোষণার।
এবার খোদ কায়রোতেই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকার কিছুটা শুকনো সুর, বড় নিঃশ্বাস ফেলে মন্তব্য, ‘আমরা বিপ্লব করতে পারি কিন্তু তা ধরে রাখতে পারি না।’ সময় লাগবে। কত দিন? স্পষ্ট জবাব তাঁর কাছে নেই। কায়রোতে পরের তিন-চার দিনে কি সাংবাদিক, কি মন্ত্রী, কি আইনজীবী, কি কফিশপের সাধারণ মানুষ—কেউই এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি।
দেশে ফিরেই দেখছি উদ্যাপিত হচ্ছে শাহবাগ বিপ্লবের, গণজাগরণের প্রথম বার্ষিকী। তাহরির এবং শাহবাগকে হয়তো অতিসরলীকরণ করে একসঙ্গে মেলানো যাবে না। অর্জন এবং সাফল্য-ব্যর্থতাও হয়তো একই নিক্তিতে তোলা যাবে না। তবে একটি জায়গায় অসাধারণ মিল, তা হচ্ছে নতুন প্রজন্মের হাত ধরে ইতিহাসের নতুন পাট উন্মোচন। তাহরিরের তরুণদের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির মেলবন্ধন হয়নি। কারণ, সেখানে রাজনীতি ছিল না, কিন্তু তাঁরা যে পরিবর্তনটি চেয়েছিলেন তা ছিল রাজনৈতিক। একটি রাজনৈতিক প্রত্যাশা পূরণে রাজনৈতিক নেতৃত্বই প্রয়োজন।
কিন্তু শাহবাগের যে কিছুটা সাফল্য তার কারণ তাদের প্রত্যাশাটি যেমন রাজনৈতিক, তেমনি সেই প্রত্যাশা পূরণের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিও দৃশ্যমান। কথা উঠেছে, শাহবাগ কি একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি? সহজ কথায় বোধ করি জবাব হবে—না, প্রচলিত ধারার রাজনীতির বিকল্প নয় শাহবাগ। শাহবাগ নিজেই তার স্বকীয়তা নিয়ে ইতিমধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এমন একটি শক্তিতে, যা প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের মূলধারা। প্রচলিত রাজনৈতিক শক্তি যে ভুল-বিভ্রান্তি আর আপসকামিতার মরীচিকায় পথ হাতড়ায়, সেখানে শাহবাগের অবস্থান স্পষ্ট।
তাহরিরের সহজ তরুণদের বিপুল প্রত্যাশার স্বপ্ন যেমন গ্রাস করেছিল মিসরের ধর্মের লেবাসধারী অপরাজনীতি, তেমনি শাহবাগের প্রবল উত্থানে বাংলাদেশেও সেই ধারার শক্তি তাদের রক্তখেকো দাঁত-মুখ-নখ দৃশ্যমান করে মাঠে নেমেছে। প্রকাশ্যে এদের দেখলেও শাহবাগের সমীকরণ আমাদের রাজনীতিকে সতর্ক করেছে সেই অপরাজনীতির শক্তির নেপথ্য নায়কদের সম্পর্কে, যাঁরা নানা পেশায়, নানা পরিচয়ে এই স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস করেও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব মুছে ফেলার চক্রান্তের নকশা আঁকছেন প্রতিনিয়ত।
আমাদের প্রচলিত রাজনীতির অনেক অসম্পূর্ণতা পূর্ণাঙ্গ করতে, অথবা পূর্ণাঙ্গ করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হতে এই যে সতর্কবাণী আকাশভেদী কণ্ঠে উচ্চারণ করল শাহবাগ, তা-ই বা কম কিসে? জন্মের মাত্র তিন বছরের মাথায় যে বাংলাদেশ তাঁর পথ হারিয়ে ফেলেছিল, সেই বাংলাদেশকে মূলধারায় ফেরাতে শাহবাগ যে প্রবল দাপটে জেগে রইল, সে যেন পিতৃপুরুষদের ভুল ও বিভ্রান্তির দায় শোধ করার জন্যই। এই তরুণদের উত্থানে বাংলাদেশ যেন স্বস্তি এবং শান্তি পেল।
দেশমাতৃকাকে এই শান্তি ও স্বস্তি দিতে শাহবাগের সূর্য তরুণদের যে উজ্জ্বলতা, তা ম্লান করতে কত কালিমাই না তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলো! ধর্মের নামে, সামাজিকতার নামে কতই না অপবাদ! কতই না অপপ্রচার! কতই না হুমকি! কিন্তু কোনো কিছুই কি তাদের আটকাতে পারল? পারল না, কারণ চূড়ান্ত বিচারে সবকিছুই নষ্ট-ভ্রষ্টদের হাতে চলে যায় না। রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজনীতির ভাষাতেই কথা বলতে হবে, পথ চলতে হয় রাজনীতির ব্যাকরণ মেনেই, নিজেদের উজ্জ্বলতা দিয়েই দূর করতে হয় সমমনা রাজনীতির সীমাবদ্ধতাটুকু। তাহরিরের সঙ্গে শাহবাগের পার্থক্য এখানেই।
তাহরিরের তরুণেরা দুই বছর আগে দুনিয়াকে জানান দিয়েছিলেন তাঁদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার, কিন্তু সমমনা রাজনৈতিক শক্তি সেই ধারাটিকে ধরে এগোতে পারেনি। আর শাহবাগে উচ্চারিত রাজনৈতিক প্রত্যাশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের শতকোটি মানুষের প্রত্যাশা। শুধু ধর্মের আবরণে তাকে পৃথক করে ফেলা যায়নি। বরং যাঁরা পৃথক করতে চেয়েছিলেন, তাঁরাই পৃথক হয়ে গেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধস্পর্শী রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তি যত স্পষ্টভাবে শাহবাগের সেই মৌল চেতনাটি ধারণ করতে পারবে, ততই নিশ্চিন্ত হবে বাংলাদেশ।

মনজুরুল আহসান বুলবুল, সাংবাদিক।