শিক্ষণমূলক সমাজ গঠন

বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর মানুষেরা ভাবছেন, তাঁদের অর্থনীতির ভিত্তি হচ্ছে নতুন রীতিনীতির প্রবর্তন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই নব্য রীতি প্রবর্তনের ব্যাপারটা উন্নত বিশ্বে নতুন কিছু নয়, দুই শতাব্দী ধরে সেখানে এটা চলে আসছে। শিল্প
বিপ্লব পর্যন্ত কয়েক হাজার বছর মানুষের উপার্জন এক জায়গায় স্থির থেকেছে। তারপর মাথাপিছু আয় বাড়তে থাকে, বছরের পর বছর তা বাড়ে, মাঝেমধ্যে পৌনঃপুনিক ওঠানামা ছাড়া এর ব্যত্যয় ঘটেনি।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট সলো বলেছেন, ৬০ বছর আগে আয় বাড়ার পেছনে পুঁজির কেন্দ্রীভবনই একমাত্র কারণ নয়। প্রাযুক্তিক বিকাশ মানুষকে শিখিয়েছে কীভাবে একটি কাজ আরও ভালোভাবে করা যায়, ফলে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পেছনে নাটকীয় আবিষ্কারের ভূমিকা রয়েছে, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা ঘটেছে ছোট ছোট ও ক্রমিক পরিবর্তনের কারণে। আর সেটাই যদি হয়ে থাকে, সমাজ কীভাবে শেখে তার ওপর আলোকপাতের একটি যৌক্তিকতা আছে। এর সঙ্গে শিক্ষণ–প্রক্রিয়াকে কীভাবে ত্বরান্বিত করা যায়, এর ওপরও দৃষ্টিপাত করা যায়। কীভাবে শিখতে হয় সেটাও শিখতে হবে।
শতাব্দীকাল আগে অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিবিজ্ঞানী জোসেফ স্কুমপিটার বলেছেন, বাজার অর্থনীতির মৌলিক ব্যাপার হচ্ছে এর উদ্ভাবনী ক্ষমতা। তিনি দাবি করেন, অর্থনীতিবিদেরা যে যুগ যুগ ধরে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বাজারের ওপর জোরারোপ করেছেন, তা ঠিক ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, বাজারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা, বাজারের মধ্যে নয়। বাজারের জন্য লড়াই থাকলে নতুন নতুন উদ্ভাবন হয়। এই দৃষ্টিতে একচেটিয়াবাদের পরম্পরার কারণে ভবিষ্যতে জীবনমানের উন্নতি হবে।
স্কুমপিটারের এই মত চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়েছে। একচেটিয়া ও প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট চাইলে উদ্ভাবনের রাশ টেনে ধরতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকলে এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের একচেটিয়াত্ব বজায় রাখতে প্রতিযোগিতা-বিরোধী সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে পারে।
তদুপরি, গবেষণা ও শিক্ষণের কোন পর্যায়ে ও কোন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হবে, তা নির্ধারণে বাজারের দক্ষতা নাও থাকতে পারে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইনসেনটিভ দিলেও সামাজিক ক্ষেত্রে সেটা তেমন কোনো ফল বয়ে আনে না। ফার্মগুলো উদ্ভাবনের কারণে লাভবান হতে পারে, এটা তাদের বিপণনক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে তারা নিয়মকানুনও লঙ্ঘন করতে পারে।
কিন্তু স্কুমপিটারের মৌলিক অন্তর্দৃষ্টি হালে ভালোই পানি পেয়েছে। বিষয়টা এমন, একবার যদি দীর্ঘমেয়ািদ উদ্বাবনী ও শিক্ষণসংক্রান্ত অবস্থান নেওয়া হয়, তাহলে প্রথাগত যে নীতিমালায় স্বল্পমেয়ািদ দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া হয়, সেগুলো আর কাম্য নাও থাকতে পারে। উন্নয়নশীল দেশ ও বিকাশমান বাজারের ক্ষেত্রে এটা সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য।
নতুন অর্থনীতির জন্য শিল্পনীতির গুরুত্ব অনেক। শিল্পনীতিতে সরকার সাধারণত সম্পদ বণ্টনের রূপরেখা প্রণয়ন করে থাকে, কোন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে, সেটাও ঠিক করে থাকে। এর জন্য হয়তো কোনো এক প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষণ–প্রক্রিয়া অন্য ক্ষেত্রের তুলনায় অধিক নিবিড় হতে পারে। তখন এমন হতে পারে যে এর সুফল অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়ে—সফলতার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ প্রয়োজন হয় সেটাসহ।
এ ধরনের নীতি নেওয়া হলে তা হরদম সমালোচনার মুখে পড়ে। বলা হয়, সরকারের চেয়ে বাজার নিজেও ভালো বিচারক, সরকারের উচিত এ জায়গা বাজারকেই ছেড়ে দেওয়া।
কিন্তু এ নীতি যে খুব সফল হয়েছে তা বলা যাবে না, মুক্তবাজারের প্রবক্তারা যতই গলাবাজি করুন না কেন। আর্থিক খাতের বৈশ্বিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি খাত পুঁিজ বণ্টন ও ঝুঁিক ব্যবস্থাপনায় চরম বাজে নজির স্থাপন করেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি গবেষণা প্রকল্প থেকে সে দেশের অর্থনীতি যতটা উপকৃত হয়েছে, বেসরকারি উদ্যোগ থেকে ততটা হয়নি। কারণ হচ্ছে, সরকার গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ে যেভাবে গবেষণা পরিচালনা করে, বেসরকারি খাতে সেটা অতটা হয় না। ইন্টারনেট ও ডিএনএ আবিষ্কারের সামাজিক ফলাফল যে কী পরিমাণ, তা সহজেই অনুমেয়। এর জন্য যে গবেষণা হয়েছে তা অমূল্য।
এসব সফলতা বাদ দিলেও, শিল্পনীতির কাজ কিন্তু বিজয়ীদের খুঁজে বের করা নয়। এর কাজ হচ্ছে ইতিবাচক বহিস্থ উৎস খুঁজে বের করে, যেখানে শিক্ষণ–প্রক্রিয়া পরিচালনার মাধ্যমে অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনতে পারে।
শিক্ষণের চশমা পরে অর্থনৈতিক নীতি বিবেচনা করলে অন্যান্য ইস্যুতে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যাবে। মহান অর্থনীতিবিদ কেনেথ অ্যারো কাজের মাধ্যমে শেখার কথা বলেছিলেন। শিল্প বিকাশের জন্য কী লাগবে, তা শেখার জন্য আসলে শিল্পই প্রয়োজন। আর সেটা নিশ্চিত করতে হলে দেখতে হবে বিনিময় হার প্রতিযোগিতামূলক ও কিছু খাতের ঋণপ্রাপ্তির বিশেষাধিকার আছে কি না। পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশই সঙ্গে এ কাজটি করেছে, এটা ছিল তাদের সফল উন্নয়ন নীতির অংশ, এ সফলতা লক্ষণীয়।
শিল্প সুরক্ষার জন্য নতুন অর্থনীতির কিছু জোরালো বক্তব্য থাকে। তদুপরি, আর্থিক বাজার উদারীকরণ করলে এ দেশগুলোর নতুন নতুন দক্ষতা অর্জনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, অথচ উন্নয়নের জন্য এগুলো অপরিহার্য। এটা হচ্ছে কীভাবে সম্পদ বণ্টন করতে হয় এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা করতে হয়।
একইভাবে, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ঠিকঠাক ব্যবহৃত না হলে দুই ধারী তলোয়ারে পরিণত হতে পারে, বিশেষত শিক্ষণের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে। এর ফলে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়তে পারে। গোপনীয়তার জন্যও বরাদ্দ বাড়তে পারে। এতে শিক্ষণের জন্য যে জ্ঞান প্রবাহ দরকার, তা ব্যাহত হতে পারে। ফার্মগুলো যৌথ জ্ঞান থেকে তাদের আহরণ বাড়ানো এবং অন্যদিকে এ ক্ষেত্রে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ কমাতে উৎসাহী হতে পারে। বাস্তবে এ প্রেক্ষাপটে উদ্ভাবনের গতি হ্রাস পায়।
অন্যদিকে যেসব নীতি (বিশেষত যেগুলো নব্য উদারনীতিক ‘ওয়াশিংটন ঐকমত্য’র সঙ্গে সম্পর্কিত) চালাকি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর সম্পদ বণ্টনের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গছিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো আজ শিক্ষণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিণামে, জীবনমান আরও নিচে নেমেছে।
আসলে প্রতিটি সরকারি নীতি শিক্ষণের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ফেলে, তা ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃতই হোক। প্রভাব ইতিবাচকও হতে পারে, আবার নেতিবাচকও হতে পারে। উন্নয়নশীল দেশের নীতিপ্রণেতারা এসব জানেন, ফলে তাঁরা উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাঁদের যে জ্ঞানগত পার্থক্য রয়েছে, সে ব্যবধান ঘোচাতে চান। তবে উন্নত দেশগুলো চাইলে মাঝারি মানের ও সবচেয়ে উন্নত চর্চার মধ্যকার ব্যবধান ঘোচাতে পারে, সে সুযোগ তাদের হাতে রয়েছে। এর মাধ্যমে তারা জগতের নিশ্চলতার বিপদ থেকে রেহাই পেতে পারেন।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ: অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।