এক পাইলট আর কিছু চকলেট

সিঙ্গাপুরের এক সামরিক বিমানঘাঁটিতে একদিন কাজ করছিলাম। সেদিনের কাজটি ছিল পাইলটদের বড়সড় এক বিশ্রামকক্ষে। কয়েকজন পাইলট ছিলেন, সেটা খেয়াল করা হয়নি। সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলতে দেখে একজন পাইলট ডেকে নিলেন আমাকে। কাছে যেতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী করো এখানে?’ বিনীতভাবে উত্তর দিলাম, ‘এয়ারকন কন্ট্রাক্টর। শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছি। কিছু ত্রুটি আছে।’

আরও দু-এক কথায় যখন বললাম, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তখনই বিস্ময়ের শুরু। তিনি জানালেন, কিছুদিন আগে পরিবারসহ বাংলাদেশ ঘুরে এসেছেন। আরও জানালেন, তাঁর দাদা চীনা বংশোদ্ভূত দাদিকে বিয়ে করে সিঙ্গাপুরেই থিতু হয়েছিলেন। বংশপরম্পরায় তাই তিনিও দেখতে অনেকটা চীনাদের মতো। তখন বুঝলাম, বাংলাদেশের প্রতি তাঁর আলাদা টান আছে। বিদায়ের সময় তো আমার ইংরেজির প্রশংসা করে কিছু চকলেট হাতে ধরিয়ে দিলেন। 

সিঙ্গাপুরে এসে এমন সুখকর অনুভূতির যেমন অনুভব পেয়েছি, তেমনি কষ্টেরও। আমার বয়সী আরও দশটা তরুণের মতো দেশে তখন আমুদে জীবন চলছিল। সে সময়ই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল বিদেশে পাড়ি জমানোর। পরিবার আর দেশ ছেড়ে বিদেশে আসার ইচ্ছে হয়তো ছিল না, কিন্তু মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সেটাই করতে হয়েছিল।

২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে সিঙ্গাপুরের একটি প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানের সহকারী টেকনিশিয়ান পদে নিয়োগ হয়েছিল আমার। জুলাইয়ে চলে আসি। ঢাকার হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে যখন সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে নামি, তখনই মনে হয়েছিল, জীবনটা নতুন এক মোড় নিয়েছে।

এ এক ভিন্ন জীবন, অচেনা পৃথিবী! দিন কাটতে থাকল। প্রবাসের জীবন তিলে তিলে বুঝতে থাকলাম। পদে পদে চ্যালেঞ্জ আর কঠোর পরিশ্রমের দিন সব। স্বাবলম্বী হতে হলো প্রতিটি কাজে। একসময় সবই মানিয়ে নিলাম।

এখন তো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে কাজ করছি, প্রতিনিয়ত শিখছি। তবে বিদেশে বসেও সর্বদা চেষ্টা করেছি দেশের মানুষের জন্য কিছু করার। এসডিআই একাডেমি থেকে আমরা অভিবাসী বাঙালিদের ইংরেজি শেখাতে সাহায্য করি। এ বছরের শুরুতে এক স্থানীয় জাপানিজ বন্ধুর সঙ্গে প্রবাসীদের নিয়ে একটা আন্দোলন করেছি, যেখানে বাঙালি শ্রমিকদের প্রতিভার কথা আমরা স্থানীয় লোকজনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। বিদেশি ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্কের সৃষ্টি করতে কাজ করছি। আমাদের বাঙালি ভাইদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও সুস্থ রাখতে কাজের পাশাপাশি একটা কমিউনিটি ক্লিনিকে স্থানীয় বন্ধুদের সঙ্গে কাজ করছি, প্রতি শনিবার তাদের নামমাত্র মূল্য খরচে ভালো স্বাস্থ্যসেবায় নিশ্চিতে সহযোগিতা করছি।

দেশে বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজ করতাম বলেই সিঙ্গাপুরে এসেও এত সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছি। সংগঠনের সঙ্গে থেকে জীবনযুদ্ধ সহজ করে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রোজ খাটাখাটুনির দিন কাটালেও সপ্তাহ শেষে যখন বাঙালি ভাইদের দেখি, তাদের নিয়ে কাজ করি, তখন সারা সপ্তাহের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সবার সঙ্গে মিশলে মনে হয়, বুকের মধ্যে আসলে দেশটাই। 

তাসরিফ আহমেদ

উডল্যান্ডস, সিঙ্গাপুর।