কত দিন দেখা হয়নি...

শিরোনামটি একটি জনপ্রিয় গানের কলি। তবে ভেতরের এই লাইনটির পরিবর্তে কেন জনপ্রিয়তম প্রথম কলিটুকু বেছে নেওয়া হলো না—সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। আসলে দায় আমার নয়, এ দায় করোনা মহামারির। পুরো বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও নতুন করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। আর তাতে ঠিক আগের মতো বন্ধুতে-বন্ধুতে দেখাদেখি হওয়া কঠিন হয়ে গেছে। হ্যাঁ, বলতে পারেন যে ভিডিও কলে তো চার চোখ এক হচ্ছেই। কিন্তু চর্মচক্ষুর মিলন আর ‘ভায়া ইন্টারনেট’ কি একই অনুভূতি দেয়?

না, তা দেয় না। একসঙ্গে বসে আড্ডা হলো না, হেসে কুটিপাটি হয়ে একে-অন্যের গায়ে গড়াগড়ি হলো না, চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়া হলো না, সেই চায়ের খরচ কে দেবে, তা নিয়ে কথা-কাটাকাটি হলো না—তবে কি আর বন্ধু সম্মিলনী পূর্ণতা পায়? কিন্তু নতুন স্বাভাবিকতায় সবাইকেই মানিয়ে নিতে হচ্ছে। অগত্যা ডিজিটাল পদ্ধতিতেই বাড়ছে ভরসা।

মহামারির এই দিনে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার বাধ্যবাধকতার মধ্যেই এসে যাচ্ছে বন্ধু দিবস। কেউ কেউ বিতর্ক তুলতেই পারেন এই বলে যে বন্ধুদের কথা মনে আনার জন্য কী নির্দিষ্ট দিবসের কোনো প্রয়োজন আছে? সেই তর্ক চলতেই পারে। তবে বন্ধু দিবসের প্রসঙ্গ যখন এলই, তখন এর ইতিহাস নিয়ে একটু কথা বলা যাক।

বন্ধু দিবস পৃথিবীর একেক অঞ্চলে একেক দিনে পালিত হয়। এ ক্ষেত্রে জুলাই মাস প্রাধান্য পায় বেশি। অর্থাৎ জুলাই মাসের বিভিন্ন দিনকে বন্ধু দিবস হিসেবে বেছে নেয় একেক দেশ। অনেক দেশ আবার আগস্ট মাসেও চলে যায়। যেমন: আর্জেন্টিনায় ২০ জুলাই পালিত হয় বন্ধু দিবস। যুক্তরাষ্ট্রে আবার ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। ভারত-মালয়েশিয়ায় আগস্ট মাসের প্রথম রোববার পালন করা হয় বন্ধু দিবস। বাংলাদেশেও বন্ধুত্বের এই দিনটি পালন করা হয় আগস্টের প্রথম রোববার। এই ভিন্নতার মূল কারণ হলো, একেক অঞ্চলের একেক সংস্কৃতিতে বন্ধু দিবসের আলাদা তাৎপর্য অনুযায়ী একেক দিন বেছে নেওয়া হয়েছে।

যত দূর জানা যায়, বন্ধু দিবসের শুরুটা হয়েছিল ১৯২০-এর দশকে, কার্ড কোম্পানি হলমার্কের হাত ধরে। হলমার্ক কার্ডস ইনকরপোরেটেডের প্রতিষ্ঠাতা জয়েস হল বন্ধু দিবসের গোড়াপত্তন করেছিলেন। ওই সময় এই দিবস চালুর পেছনে একটা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যও খুঁজে পাওয়া যায়। শুরুর পর অনেক বছর শুধু কার্ড আদান-প্রদানের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়ই ছিল বন্ধু দিবসের মূল কর্মকাণ্ড। সেই ঐতিহ্য এখনো আছে। বন্ধুকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য কার্ড পছন্দ করতে গিয়ে মানসিক দোলাচলে পড়ার স্মৃতি নিশ্চয়ই অনেকের মনে এখনো টোকা দেয়!

১৯৫৮ সালে বন্ধু দিবস পালনের ক্ষেত্রে একটি আনুষ্ঠানিক সংগঠনের জন্ম হয়। র‌্যামন আরতেমিও ব্রাচো নামের এক ব্যক্তি প্যারাগুয়েতে গড়ে তোলেন ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডশিপ ক্রুসেড’ নামের একটি ফাউন্ডেশন। গঠনের পর থেকেই এই ফাউন্ডেশনটি বন্ধু দিবসের একটি বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য চেষ্টা চালাতে থাকে। র‌্যামন ও তাঁর সতীর্থরা চেয়েছিলেন বন্ধুত্বের শক্তিকে উদ্‌যাপন করতে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, এর মধ্য দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংস্কৃতি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা। ওই সময় এই ফাউন্ডেশন ‘ফ্রেন্ডশিপ উইক’ আয়োজন করত। সেই বিশেষ সপ্তাহটি শেষ হতো ৩০ জুলাই।

অবশেষে দীর্ঘ ৫০ বছরের চেষ্টার পর ২০১১ সালে জাতিসংঘ প্রতিবছরের ৩০ জুলাইকে আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস (ইন্টারন্যাশনাল ডে অব ফ্রেন্ডশিপ) হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। এভাবেই বন্ধুত্ব উদ্‌যাপনের আয়োজন পায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। জাতিসংঘ বলছে, বিভিন্ন দেশ, জাতি ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টাকে অনুপ্রাণিত করতে এবং ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরিতে এই দিবস আয়োজন করা প্রয়োজন। জাতিসংঘ মনে করে, সহিংসতা ও সংঘাত পরিহার করে শান্তির পথে হাঁটাই এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।

ঢের ইতিহাস-ঐতিহ্য ঘাঁটাঘাঁটি হলো। এবার না হয় বন্ধুদের নিয়ে মেতে ওঠা যাক। তবে বন্ধুত্ব পাতানোর ক্ষেত্রে একটু বাছবিচার থাকা ভালো। মনে রাখবেন, বিপদেই বন্ধুর পরিচয়!

তথ্যসূত্র: রিপাবলিক ওয়ার্ল্ড ডট কম, নিউজএইটিন, এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস ও ইউএন ডট অরগ