‘চাপে’ পড়ে পুরোনোদের ফেরাচ্ছে হেফাজত

হেফাজতের সরকারঘেঁষা কর্মকাণ্ডে মাঠপর্যায়ের কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন। তাঁদের একটি অংশ নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার উপায় খুঁজছিল।

তৃণমূলের চাপেই বিলুপ্ত কমিটির সদস্যদের কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করছে হেফাজতে ইসলাম। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই চাপের অন্যতম কারণ, বিলুপ্ত কমিটির অনেকে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে মামুনুল হকসহ সংগঠনটির বেশ কয়েকজন নেতা দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে বন্দী রয়েছেন। কার্যত এই অংশের চাপেই হঠাৎ কমিটি পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

বিলুপ্ত কমিটির সদস্যদের অনেকে মনে করেন, কারাবন্দীদের মুক্তি এবং নেতা-কর্মীদের মামলার খড়্গ থেকে মুক্ত করতে হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্ব কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। উপরন্তু সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকে সরকার এবং সরকারি মহলের সঙ্গে সখ্য রেখে চলছেন।

এর বাইরে গিয়ে সংগঠন নিয়ে তাঁদের কোনো দৃশ্যমান ভাবনা বা পরিকল্পনা নেই। এমন প্রেক্ষাপটে হেফাজতের নেতৃত্বের ওপর সরকারবিরোধী অংশটি রুষ্ট হয়ে ওঠে। এই অংশের সঙ্গে হেফাজতের ভেতর থেকেও চাপ তৈরি হয় পুরোনোদের অন্তর্ভুক্ত করে কমিটি পুনর্গঠনের।

কোনো চাপ না, আমরা নিজে থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভাবলাম, মুরব্বিরা যে কমিটি করে গেছেন, সেটি সর্বসম্মতভাবে হয়েছিল। আমরা সেই কমিটির সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে নিলাম। এর মধ্যে যাঁরা মারা গেছেন এবং স্বেচ্ছায় চলে গেছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে নতুন করে পদবিন্যাস করা হবে।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হেফাজতের ভেতর থেকে একটি অংশ কমিটি পুনর্গঠনে রাজি ছিল না। এর সঙ্গে এক হয় সরকারের একটি মহলও। দুই পক্ষ পাল্টা চাপ তৈরি করে বিলুপ্ত কমিটির সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত না করার। কিন্তু সংগঠনে বিভক্তির আশঙ্কায় হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্ব কমিটি পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এ অবস্থায় হেফাজতের নেতৃত্বের কাছে ১১ জনের তালিকা পাঠিয়ে শুধু তাঁদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ আসে। এর বাইরে চারজনের নাম পাঠিয়ে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত না করার নির্দেশনা দেয় ওই মহল।

হেফাজত সূত্রে জানা গেছে, যে চারজনকে নতুন করে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত না করার নির্দেশনা পেয়েছেন হেফাজত নেতৃত্ব, তাঁরা হলেন বিলুপ্ত কমিটির কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসুফী, সহকারী মহাসচিব সাখাওয়াত হোসাইন রাজি, প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়জী ও সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী।

আরও পড়ুন

এর মধ্যে আবদুর রব ইউসুফী ছাড়া বাকি তিনজন দীর্ঘদিন কারাভোগের পর সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পান। আর যাঁদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়, তাঁরা হলেন মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, হারুন ইজহার, আতাউল্লাহ আমীন, হাবিবুল্লাহ মাহমুদ কাসেমী, ফজলুল করিম কাসেমী, নাসিরুদ্দীন মুনির, জালালুদ্দিন আহমাদ, আহমদ আলী কাসেমী, মনজুরুল ইসলাম আফেন্দী ও ইনামুল হাসান ফারুকী। তাঁরা বিলুপ্ত কমিটিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। কিন্তু হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্ব বিলুপ্ত কমিটির সবাইকে কমিটিতে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নেন।

অবশ্য হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো চাপ না, আমরা নিজে থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভাবলাম, মুরব্বিরা যে কমিটি করে গেছেন, সেটি সর্বসম্মতভাবে হয়েছিল। আমরা সেই কমিটির সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে নিলাম। এর মধ্যে যাঁরা মারা গেছেন এবং স্বেচ্ছায় চলে গেছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে নতুন করে পদবিন্যাস করা হবে।’

হেফাজতে ইসলামের কারাবন্দী নেতা মামুনুল হক বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও মুনির হোসাইন কাসেমী অর্থ সম্পাদক ছিলেন। ওই কমিটি বিলুপ্তির পর নতুন কমিটিতে এ দুজনসহ কয়েকজনকে বাদ দেওয়া হয়।

২০২১ সালের ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ-সহিংসতার জেরে হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযানের প্রেক্ষাপটে ২৫ এপ্রিল রাতে এক ভিডিও বার্তায় সংগঠনের তৎকালীন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।

তখন বিক্ষোভ-সহিংসতার ঘটনায় ঢাকা, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় হেফাজতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ৭৯টি মামলা হয়। এসব মামলায় ৬৯ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার দিন পর্যন্ত সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ১৯ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই পরিস্থিতিতে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সংগঠনটির কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা দেন জুনায়েদ বাবুনগরী।

অবশ্য সে সময় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণার তিন ঘণ্টা পর জুনায়েদ বাবুনগরীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। তখন হেফাজতের কমিটিতে রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট কাউকে না রাখার জন্য চাপ ছিল। আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার দেড় মাসের মাথায় ৭ জুন জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির পদে বহাল রেখে ৩৩ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট জুনায়েদ বাবুনগরী মারা যান। নতুন আমির হন আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। এরপর কমিটিতে আরও ২৯ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি ৬২ সদস্যের।

আরও পড়ুন

বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রামে মামলার হাজিরা দিতে দিতে জীবনটাই অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। ২০২১ সালের ২৬ মার্চের এক ঘটনায় (সহিংসতা) ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬৩টি, হাটহাজারীতে ১৩টি আর ঢাকায় ৯টি মামলা হয়েছে। অথচ ওই দিন হেফাজতের কোনো কর্মসূচিই ছিল না। এ যেন এক আচানক দেশে বাস করছি।’

আজিজুল হক ইসলামাবাদীর বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা আছে। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন থানায় ১৭টি ও চট্টগ্রামে ১৩টি রয়েছে। সম্প্রতি তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা আমির ছিলেন শাহ আহমদ শফী। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুর পর সংগঠনটির একাংশের সঙ্গে বিরোধের মধ্যে সে বছরের ১৫ নভেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে ১৫১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল।

জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন এই কমিটিতে আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানি এবং তাঁর অনুসারী কাউকে রাখা হয়নি। পরে বাবুনগরীর কমিটিতে আরও ৫০ জনকে যুক্ত করে ২০১ সদস্যের করা হয়। ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে যে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল, এখন সেটির সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হেফাজতের ইসলামের বর্তমান নেতৃত্ব।

৫ আগস্ট রাজধানীর খিলগাঁওয়ের একটি মাদ্রাসায় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এ লক্ষ্যে সংগঠনের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ১২ সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। যদিও বিলুপ্ত কমিটির সদস্যদের পদায়ন বা নতুন-পুরোনোদের পদবিন্যাস করার বিষয়ে এই উপকমিটির এখন পর্যন্ত কোনো বৈঠক হয়নি।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, হেফাজতে ইসলামের সরকারঘেঁষা কর্মকাণ্ডে মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন। তাঁদের একটি অংশ হেফাজতকে এড়িয়ে নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার উপায় খুঁজছিল। এর মধ্যে গত ২২ জুলাই ঢাকায় ‘শায়খুল হাদিস পরিষদ’-এর ব্যানারে কয়েক হাজার কওমি আলেমের সম্মেলন হয়। সেখানে হেফাজতের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীসহ ইসলামপন্থী দলগুলোর প্রায় সব দলের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।

প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের ছাত্র-শিষ্য ও শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে এ সংগঠন হয়। ওই সম্মেলনে বেশির ভাগ আলোচকই সরকারি নির্যাতন-নিপীড়নের বিষয়ে জোরালো বক্তব্য দেন। এ ধরনের তৎপরতাকে হেফাজতের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে দেখেন অনেকে। তাঁরা মনে করছেন, কার্যত এসব কারণেই বিলুপ্ত কমিটির সবাইকে নিয়ে হেফাজতে ইসলামকে পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

হেফাজতে ইসলামের কারাবন্দী নেতা মামুনুল হক বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও মুনির হোসাইন কাসেমী অর্থ সম্পাদক ছিলেন। ওই কমিটি বিলুপ্তির পর নতুন কমিটিতে এ দুজনসহ কয়েকজনকে বাদ দেওয়া হয়। নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে তাঁরা আবার সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বহাল হবেন। আগামী সপ্তাহে নেতাদের পদায়নের জন্য উপকমিটির বৈঠক হবে।