বিএনপি এগোতে চায় ‘অহিংস’ থেকেই

ফাইল ছবি

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন সংসদ নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবির পর এবার রাষ্ট্র সংস্কারের ঘোষণা দেবে বিএনপি। এরপর অহিংস পথেই সরকারবিরোধী বৃহত্তর যুগপৎ আন্দোলনের সূচনা করতে চাইছে দলটি।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ক্ষমতায় গেলে বিএনপি ও তাদের সঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে তারা রাষ্ট্রের কী ধরনের মৌলিক সংস্কার আনবে—সে ঘোষণা দেওয়া হবে শিগগির। এতে সংবিধান সংশোধনের জন্য একটি ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন’ গঠন করাসহ ক্ষমতায় গেলে ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ প্রতিষ্ঠার ২৭টি অঙ্গীকার রয়েছে।

আরও পড়ুন
কেবল মৌলিক সংস্কারের মাধ্যমেই উঠে দাঁড়াতে পারবে দেশ। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব ঘোষণা করব।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপি

ইতিমধ্যে বিএনপির সঙ্গে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে একমত হয়েছে সাতদলীয় রাজনৈতিক জোট ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’। এই জোট ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ দফা দাবিতে ২৪ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সব মহানগর ও জেলা সদরে ‘গণমিছিল’ কর্মসূচি দিয়ে যে যুগপৎ আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, এ লক্ষ্যে শিগগিরই একটি লিয়াজোঁ (সমন্বয়) কমিটি গঠন করা হবে। ইতিমধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে সাতজনের নামের তালিকা বিএনপিকে দেওয়া হয়েছে। আজকালের মধ্যে বিএনপিও তাদের নাম চূড়ান্ত করবে। ১০ দফা দাবি এবং রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে অপরাপর রাজনৈতিক দলের কাছেও যাবে বিএনপি। সরকারের বাইরে থাকা দলগুলোকে এতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাদের (ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ) চরম দলীয়করণ, দুর্নীতি এবং দুঃশাসনে দেশ যে গর্তে পড়েছে, সেখান থেকে বের করে আনতে বড় ধরনের রূপান্তর ব্যতীত দেশ দাঁড়াতে পারবে না। কেবল মৌলিক সংস্কারের মাধ্যমেই উঠে দাঁড়াতে পারবে দেশ। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব ঘোষণা করব।’

আরও পড়ুন

তবে বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ২৪ ডিসেম্বরের গণমিছিলের কর্মসূচিতে সামান্য পরিবর্তন আসতে পারে। ওই দিন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন রয়েছে। সে জন্য ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার গণমিছিল স্থগিত রেখে অন্যান্য মহানগর ও জেলা সদরে বহাল রাখা হতে পারে। এ বিষয়ে গতকাল দলের স্থায়ী কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।

অনেক অঘটন ও বাধাবিপত্তির মধ্যে গত দুই মাসে বিএনপি সারা দেশে ১০টি গণসমাবেশ করেছে। দলটির নেতারা মনে করছেন, যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করে বিএনপি সারা দেশে এসব গণসমাবেশের কর্মসূচি নিয়েছিল, তার চেয়ে বেশি অর্জন হয়েছে। নেতারা বলছেন, হামলা–মামলাসহ নানা বৈরী পরিস্থিতির মুখে দলের নেতা-কর্মীরা ১৫ বছর ধরে অনেকটা গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলেন। সভা-সমাবেশ করার সুযোগ পাননি। বহুদিন পর এবার বিভাগীয় সমাবেশগুলোকে কেন্দ্র করে নেতা-কর্মীরা রাস্তায় নামার সুযোগ পান এবং অনেকটা মরিয়া হয়ে অংশ নেন।

আরও পড়ুন

আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ‘নেতা-কর্মীরা একের পর এক জীবন দিয়ে যাচ্ছে। এত বাধা, গুম, খুন, আক্রমণের মুখেও সাধারণ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমাবেশে এসেছে। এ ধরনের ত্যাগ স্বীকার আমার জীবনে আর কখনো দেখিনি। সবাই জাতিকে মুক্ত করার সংগ্রামে নেমেছে, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারে না।’

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, পুলিশ ও সরকারি দলের এত বাধা, হামলা, গ্রেপ্তার এবং গুলিতে নেতা-কর্মী নিহত হওয়াসহ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও প্রতিটি গণসমাবেশে ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। সমাবেশে নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, যা এ কর্মসূচির একটি বড় প্রাপ্তি। এ কর্মসূচি ঘিরে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর আস্থা পেয়েছে। নেতারা মনে করেন, এত বাধার মধ্যেও আরেকটি বড় অর্জন হচ্ছে উসকানির মধ্যেও ধৈর্যের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ থাকা। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি যে অহিংস আন্দোলন করছে এবং সরকারি দল যে সহিংসতার পথে হাঁটছে, সেটি এখন মানুষের কাছে স্পষ্ট করা গেছে। সামনে দিনগুলোতেও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনেই থাকতে চায় বিএনপি।

আরও পড়ুন

ঢাকার গণসমাবেশ নিয়ে বিএনপি নেতাদের মূল্যায়ন হলো, সরকার নয়াপল্টনে হামলা, প্রাণহানি ও দলীয় কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল কর্মসূচি বানচাল করা। পরে মহাসচিবসহ চার শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে আতঙ্কের সৃষ্টি করা হয়, যাতে গণসমাবেশে উপস্থিতি কম হয়। এত বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেও ঢাকার গণসমাবেশে যে পরিমাণ জনসমাগম হয়েছে, তাতে সরকারের রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে বলে মনে করেন বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর নেতারাও।

এ বিষয়ে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গী গণতন্ত্র মঞ্চের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলছেন, জামায়াতসহ জোটের কারও সহযোগিতা না নিয়েই বিএনপি এককভাবে যে এত বড় গণসমাবেশ করল, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। আরেকটি দিক হচ্ছে বিএনপি সরকারের উসকানির ফাঁদে পা দেয়নি। আর এত দিন জামায়াত-বিএনপির সম্পর্কের রং লাগিয়ে ক্ষমতাসীনদের যে রাজনৈতিক প্রচার ছিল, সেটিও এখন ভেঙে গেছে।

বিএনপির ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, এখন বিএনপির সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তাঁদের এ জনসমর্থনের আরও বিস্তার ঘটানো। তাঁরা মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের একটা বৈশ্বিক বিস্তার ঘটছে। তারই ধারাবাহিকতায় রাজতন্ত্র, একনায়ক সমাজতন্ত্র এবং স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের মিলন বিশ্বে কর্তৃত্ববাদের প্রভাব আরও বাড়ার আভাস লক্ষণীয়। এসব বিষয়ও তাদের নজরে রাখতে হবে।

এ পরিস্থিতির আলোকে জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে পর্যবেক্ষকদের অনেকে বলছেন, কর্তৃত্ববাদ বনাম গণতন্ত্র—এ বৈশ্বিক বিতর্কে বাংলাদেশ একটি ‘ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্র’ হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে। এতে বাংলাদেশ একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের মডেলে পড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোর যে অবস্থান দৃশ্যমান, তার বিপরীতে কর্তৃত্ববাদীদের পাল্টা অবস্থানও ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। এখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার সেখান থেকে সমর্থন বা আশীর্বাদ আদায়ের চেষ্টা করবে।

বিএনপির নেতারা বলছেন, এখন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব যদি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে ‘কর্তৃত্ববাদ ও গণতন্ত্র’—এ দুই পক্ষকে বিবেচনায় নিয়ে আন্দোলন এগিয়ে নিতে পারেন, তাহলে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায় করা সম্ভব হতে পারে। তা না হলে জনসমর্থন যতই থাকুক, আন্দোলন ব্যর্থ হতে পারে এবং দেশ আবারও দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরতন্ত্রের কবলে পড়ে যেতে পারে।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান দিলারা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ২০১৪ সালে একটা কথা বলেছিলাম, বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন আর আমাদের হাতে নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম বিভক্তি ও রেষারেষি থাকায় বহিঃশক্তিগুলো এর সুযোগ নেয়। এখন বিএনপি যে জনসমর্থন দেখিয়েছে, সামনে সরকারবিরোধী জোট আরও ভারী হচ্ছে। তাতে জনসমর্থন আরও বৃহত্তর রূপ নিলে জনগণের পক্ষে থাকা বাইরের শক্তির কাছ থেকে সুবিধা পাবে বিএনপি।’

যদিও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ বলছেন, এখন বিএনপির নেতৃত্ব তাদের জনমতকে জীবন্ত রাখতে এবং মাঠে নেতা-কর্মীদের সচল রাখতে কতটা সক্ষম হন, সেটি দেখার বিষয়।