আদালতে ঘুরছে জাতীয় পার্টি

হাইকোর্টের আদেশ ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত চেম্বার আদালতে। এ সময়ে জি এম কাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।

রওশন এরশাদের সঙ্গে গত মঙ্গলবার সকালে গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরের সাক্ষাতের পর জাতীয় পার্টিতে (জাপা) আওয়াজ ওঠে ঐক্যের। একই দিন হাইকোর্টের আদেশে জাপা চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের দায়িত্ব পালনে বাধা কাটে। কিন্তু গতকাল বুধবার পাল্টে যায় সে ঐক্যের হিসাব। জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের দায়িত্ব পালন নিয়ে হাইকোর্ট যে আদেশ দিয়েছিলেন, তা ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কার্যত এক মাস ধরে জাপার নেতৃত্ব নিয়ে করা মামলা ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে চলছিল। এই আদালতের এক অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞায় এক মাস ধরে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে বিরত আছেন দলীয় প্রধান জি এম কাদের। এর ফলে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রমও থমকে গেছে। এ অবস্থায় দলটির নেতা-কর্মীরা আশায় ছিলেন যে উচ্চ আদালতে এর প্রতিকার পাবেন। কিন্তু হাইকোর্টের আদেশ গতকাল চেম্বার আদালতে স্থগিত হয়ে যায়। এতে জি এম কাদেরের দায়িত্ব পালন আপাতত আটকে যায়। এখন নেতা-কর্মীদের মধ্যে জোর আলোচনা যে আরও লম্বা সময়ের জন্য জাপা আইনি মারপ্যাঁচে পড়ল কি না।

আরও পড়ুন

গতকাল জাপার বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, গত মঙ্গলবার রওশন এরশাদের সঙ্গে জি এম কাদেরের সাক্ষাতের পর ভাবা হচ্ছিল, দলের সম্মেলন আহ্বানকে কেন্দ্র করে দুজনের মধ্যে যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে, তা মিটে যাবে। কারণ, জাপার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দায়িত্ব পালনে জি এম কাদেরের ওপর নিম্ন আদালত গত ৩০ অক্টোবর যে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন, তা আগামী ৩ জানুয়ারি ২০২৩ সাল পর্যন্ত স্থগিত করেন হাইকোর্ট। এতে দলের ঐক্য নিয়ে নেতা-কর্মীরা আশাবাদী হয়ে ওঠেন। কিন্তু গতকাল পরিস্থিতি পাল্টে যায় রওশন এরশাদের অনুসারী জিয়াউল হকের এক আবেদনে। তিনি হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হাইকোর্টের আদেশ ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেন। ফলে এ সময়ে জি এম কাদের জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী।

মামলার পেছনে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের উৎসাহ আছে বলে জাপার ভেতরে আলোচনা রয়েছে।

রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের
আরও পড়ুন

জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে একটি মামলার বাদী জাপা থেকে অব্যাহতি পাওয়া দলের সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান (রাঙ্গা)। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জজ কোর্ট যদি সরকারের হয়, তাহলে সরকারের ইন্ধনে মামলা হতে পারে। আমি একটি মামলার বাদী। তবে উনি (জি এম কাদের) আমাকে দল থেকে বাদ দিয়েছেন, আমি সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করতে পারব না? আমার মনে হয় না, প্রধানমন্ত্রী এসবে আগ্রহী। উনি এখন অনেক পরিপক্ব রাজনীতিক।’

জাপার নেতা-কর্মীদের অনেকে মনে করেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দলে ঐক্য স্থাপনের পরিবর্তে রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরকে ঘিরে বিভক্তি আরও বাড়তে পারে। এর সুযোগ নিতে পারেন দলের নেতাদের একটি অংশ, যাঁরা দুজনের মধ্যে বিরোধ জিইয়ে রেখে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে তৎপর রয়েছেন। মূলত দুজনকে ঘিরে থাকা গুটিকয় নেতা রওশন ও জি এম কাদেরের মধ্যে মিলমিশ চান না।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রওশনের অনুসারী নেতারা কেউ কেউ মনে করছেন, তাঁর পক্ষে থাকলে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়াসহ সরকারের আনুকূল্য পাওয়া যাবে। আবার জি এম কাদেরের পক্ষে কিছু নেতা আছেন, যাঁরা একই উদ্দেশ্যে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রেখেছেন। আবার কিছুদিন ধরে নেতা-কর্মীদের অনেকের মধ্যে এমন আলোচনাও আছে যে প্রভাবশালী নেতাদের কেউ কেউ জি এম কাদেরকে বেকায়দায় ফেলে দলের শীর্ষ পদটি কবজায় নেওয়ার পাঁয়তারা করছেন। যদিও জি এম কাদের এমনটি মনে করেন না বলে জানান। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কারও কাছে মাথা নত করবেন না।

জাপার সূত্র জানায়, সম্প্রতি মহলবিশেষের ইন্ধনে ব্যাংকক থেকে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে রওশন এরশাদ হঠাৎ জাপার কেন্দ্রীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। এর রেশ ধরে রওশনকে বাদ দিয়ে জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করার সিদ্ধান্ত নেয় জাপার সংসদীয় দল। এ নিয়ে পরে দলে বিভক্তি প্রকাশ পায়। রওশনের পক্ষ নেন তাঁর রাজনৈতিক সচিবসহ কিছু বহিষ্কৃত এবং দলের সাবেক নেতা। তাঁদের সঙ্গে রওশন এরশাদের ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ হাত মেলান বলে গুঞ্জন আছে।

৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত

জি এম কাদেরের করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার হাইকোর্ট রুল দিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনে নিম্ন আদালতের দেওয়া অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ স্থগিত করেন। এ আদেশ স্থগিত চেয়ে জাপা থেকে বহিষ্কৃত নেতা দলটির সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা আপিল বিভাগে আবেদন করেন, যা গতকাল চেম্বার আদালতে ওঠে। চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম শুনানি নিয়ে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাইকোর্টের ওই আদেশ স্থগিত করেন। আদালতে জিয়াউল হকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ সাঈদ আহমেদ, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মো. আবদুল্লাহ আল মামুন। জি এম কাদেরের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী শেখ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম।

পরে আইনজীবী মোহাম্মদ সাঈদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টের আদেশ ৫ ডিসেম্বর (আগামী সোমবার) পর্যন্ত স্থগিত করেছেন চেম্বার আদালত। আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য ৫ ডিসেম্বর দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এ সময়ে জি এম কাদের দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না।

জিয়াউল হক মৃধা গত ৪ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে একটি মামলা করেন, যেখানে জি এম কাদেরকে জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে অবৈধ ঘোষণার ডিক্রি চাওয়া হয়। বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩০ অক্টোবর আদালত গঠনতন্ত্রের আলোকে জি এম কাদেরকে জাপার কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেন।

নিম্ন আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে জি এম কাদের উচ্চ আদালতে যান। হাইকোর্ট গত ৩০ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের দেওয়া অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত করেন। ফলে জি এম কাদেরের দায়িত্ব পালনের পথ খোলে। হাইকোর্টের আদেশ গতকাল স্থগিত হলো।

জি এম কাদেরের আইনজীবী শেখ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও জেলা জজের আদেশ অযৌক্তিক ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী এবং হাইকোর্টের আদেশ যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত বলে শুনানিতে বলেছি। চেম্বার আদালত হাইকোর্টের আদেশ ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেছেন।’

এ বিষয়ে জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হক গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহিষ্কৃত হয়ে যাঁরা মামলা করেছেন, তাঁরা ভেবেছিলেন আমরা তাঁদের ডেকে দলে আনব। এর কোনো সুযোগ নেই।’

দলের দায়িত্বশীল নেতারা জানান, দৃশ্যত সম্মেলন আহ্বানকে কেন্দ্র করে জাপার বিভক্তি প্রকাশ পেলেও কার্যত এর মূলে রয়েছে জি এম কাদেরের সরকারবিরোধী ভূমিকা। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে সরকারের দুর্নীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের দুর্বলতা নিয়ে শক্তভাবে কথা বলছিলেন, যা সরকারের উচ্চপর্যায়ের মনঃপূত হচ্ছিল না। মূলত এ কারণেই রওশনকে দিয়ে সম্মেলন আহ্বান করানো হয়।

রাজনীতিবিষয়ক লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, অনেক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে বশে রাখতে চেষ্টা করে। আগামী সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে অস্বস্তি আছে। হতে পারে জি এম কাদের আওয়ামী লীগের অতটা অনুগত নন। তাঁর কথাবার্তা ও আচরণে আওয়ামী লীগের সন্দেহ আছে।