স্বজনদের প্রার্থী করছেন সংসদ সদস্যরা

প্রথম ধাপে আগামী ৮ মে ১৫২টি উপজেলায় এবং দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে ১৬১টি উপজেলায় ভোট হবে।

নির্বাচনপ্রতীকী ছবি

আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে প্রার্থী না দিলেও দলটির সংসদ সদস্য, মন্ত্রী ও স্থানীয় নেতারা নিজেদের নিকটাত্মীয় ও স্বজনদের প্রার্থী করছেন। অন্তত ১৪টি উপজেলায় এ ধরনের তৎপরতা দেখা গেছে। এর মধ্যে একজন প্রতিমন্ত্রী ও ১২ সংসদ সদস্যের নিকটাত্মীয়রা প্রার্থী হচ্ছেন।

এবারের ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হবে চারটি ধাপে। প্রথম ধাপে আগামী ৮ মে ১৫২টি উপজেলায় এবং দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে ১৬১টি উপজেলায় ভোট হবে। আগে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন ছিল নির্দলীয়।

আরও পড়ুন
সাহাদারা মান্নান নিজেই সংসদ সদস্য। দলের বিভিন্ন কমিটিতে তাঁর স্বজনদের পদ দিয়েছেন। এখন ছেলেকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করার ঘোষণা দিয়েছেন। এতে দলীয় নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ।
রেজাউল করিম, সভাপতি, সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগ

২০১৫ সালে আইন সংশোধন করে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে প্রার্থী দেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

এখনো আইনে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বিধান আছে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের মতো আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি দলীয়ভাবে এই নির্বাচনেও অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করতে ক্ষমতাসীনেরা দলীয় প্রতীকে প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে এবার নির্বাচন হচ্ছে অনেকটা আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে।

বিএনপি ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বর্জন করায় ওই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে উৎসাহ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তখন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে বিরোধ তৈরি হয়েছিল। এর মাস তিনেকের মাথায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের পছন্দের ব্যক্তিদের প্রার্থী করা নিয়ে দলীয় বিরোধ আরও বেড়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলা নিয়ে গঠিত বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সাহাদারা মান্নান। এই দুই উপজেলার মধ্যে সারিয়াকান্দিতে সাহাদারা মান্নান তাঁর ছেলে সাখাওয়াত হোসেনকে এবং সোনাতলায় ছোট ভাই মিনহাদুজ্জামানকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর এই ঘোষণায় স্থানীয় নেতাদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ।

সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, সাহাদারা মান্নান নিজেই সংসদ সদস্য। দলের বিভিন্ন কমিটিতে তাঁর স্বজনদের পদ দিয়েছেন। এখন ছেলেকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করার ঘোষণা দিয়েছেন। এতে দলীয় নেতা-কর্মীরা ক্ষুব্ধ।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাহাদারা মান্নানের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

আরও পড়ুন

নাটোরের সিংড়া উপজেলায় লুৎফুল হাবীবকে (রুবেল) ‘একক প্রার্থী’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদের শ্যালক। দলীয় সূত্র জানায়, এখানে লুৎফুলসহ তিনজন নির্বাচনে দাঁড়াতে ইচ্ছুক ছিলেন। গত শুক্রবার প্রতিমন্ত্রীর ঢাকার বাসায় স্থানীয় নেতাদের কয়েকজন বৈঠক করেন। সেখানে লুৎফুলকে একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জান্নাতুল ফেরদৌস প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ভোটকে কেন্দ্র করে এলাকার শান্তিশৃঙ্খলার কথা বিবেচনা করে অন্য প্রার্থীরা ভোট করতে না চাওয়ায় লুৎফুল হাবীবকে একক প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, এবার দলীয় প্রার্থী মনোনীত করার সুযোগ নেই। প্রতিমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক করে একক প্রার্থী করা হয়েছে কি না, তা তাঁর জানা নেই। তবে এটা করা হলে নৈতিকতার দিক থেকে ঠিক হয়নি।

মাদারীপুর সদর উপজেলায় নিজের ছেলে মো. আসিবুর রহমান খানকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শাজাহান খান। আসিবুর জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য।

সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলায় সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য এম এ মান্নানের ছেলে সাদাত মান্নান চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে গণসংযোগ করছেন। এম এ মান্নান নিজেও বিভিন্ন আয়োজনে ছেলেকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক খায়রুল হুদা এবারও প্রার্থী। তাঁর বড় ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। একই উপজেলায় সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুন্নাহার বেগমের ছেলে যুবলীগের নেতা ফজলে রাব্বী চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে প্রচার চালাচ্ছেন।

আরও পড়ুন

মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় প্রার্থী হচ্ছেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইসরাফিল হোসেন। তিনি মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ফুফাতো ভাই। ইসরাফিল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিগত সময়ে তাঁর প্রতি সংসদ সদস্য জাহিদ মালেকের সমর্থন ছিল। এবারও সেই সমর্থন আছে।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান বর্তমান চেয়ারম্যান। তিনি এবারও নির্বাচন করবেন।

নোয়াখালীর হাতিয়ায় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশীক আলীর নাম। সুবর্ণচর উপজেলায় নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী প্রার্থী হিসেবে তাঁর ছেলে আতাহার ইশরাক শাবাব চৌধুরীর নাম ঘোষণা করেছেন।

টাঙ্গাইল-১ (ধনবাড়ী-মধুপুর) আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক তাঁর নির্বাচনী এলাকার দুই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে দুজন প্রার্থী মনোনীত করেছেন। এর মধ্যে ধনবাড়ী উপজেলায় বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ একজন। তিনি সংসদ সদস্যের খালাতো ভাই।

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হচ্ছেন পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিমের ছোট ভাই নূর ই আলম। অবশ্য সংসদ সদস্য ভাইয়ের পক্ষে প্রকাশ্যে নামেননি। পিরোজপুর সদর উপজেলায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের ছোট ভাই বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান আবারও চেয়ারম্যান প্রার্থী হবেন। ভান্ডারিয়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে পিরোজপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মহিউদ্দীন মহারাজের ছোট ভাই বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মিরাজুর ইসলাম এবারও প্রার্থী হচ্ছেন। পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শামীম শাহনেওয়াজের ছোট ভাই বর্তমান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন আহমেদও আবার প্রার্থী হচ্ছেন।

বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সেরনিয়াবাত আশিক আবদুল্লাহর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছোট ছেলে। বরিশালের গৌরনদীতে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর একান্ত সহযোগী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারিছুর রহমানকে প্রার্থী করা হচ্ছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

দলীয় প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্তের পরও এভাবে সংসদ সদস্যদের পছন্দের ব্যক্তিদের প্রার্থী ঘোষণা করায় বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় কোন্দল আরও বাড়ছে। কোন্দল নিরসনে আওয়ামী লীগ পৃথকভাবে প্রতিটি বিভাগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছে। সেখানে নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতেও অবৈধ হস্তক্ষেপ না করতে দলীয় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের নির্দেশনা দেওয়ার কথা জানানো হয়।

বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বিনষ্ট করার কর্মকাণ্ডে জড়িত না থাকার জন্য মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্য ও নেতা-কর্মীদের সাংগঠনিক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এখানে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকবে না।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা]