ষড়যন্ত্র ঠেকাতে ঐক্যবদ্ধ থাকতে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে দলগুলোর সাড়া
জুলাই অভ্যুত্থানের মুখ শরিফ ওসমান বিন হাদির ওপর হামলার প্রেক্ষাপটে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের ডেকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষমতাচ্যুত শক্তি নির্বাচন বানচাল করতে চাইছে বলে দলগুলোকে সতর্ক করেছেন তিনি। দলগুলোর নেতারাও প্রধান উপদেষ্টাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ষড়যন্ত্র ঠেকাতে তাঁরা দ্বন্দ্ব ভুলে এক থাকবেন।
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক এবং ঢাকা–৮ আসনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ওসমান হাদির ওপর হামলার পরদিন আজ শনিবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে আলোচনার বিষয়বস্তু জানানো হয়।
১২ ফেব্রুয়ারি ভোট গ্রহণের দিন রেখে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পরদিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর সড়কে গুলি করা হয় ওসমান হাদিকে। মাথায় গুলিবিদ্ধ হাদি এখন আশঙ্কাজনক অবস্থায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
ওসমান হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে প্রশ্ন ওঠার পর তিনটি দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন অধ্যাপক ইউনূস। এই বৈঠকের আগে ওসমান হাদির পরিবারের সদস্যদেরও সাক্ষাৎ দেন তিনি।
বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাফিজ উদ্দিন আহমদ, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও দলের দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ অংশ নেন। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, ইনকিলাব মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবেরও বৈঠকে ছিলেন।
‘তারা প্রশিক্ষিত শুটার নিয়ে মাঠে নেমেছে’
ওসমান হাদির ওপর হামলা একটি সতর্কবার্তা হিসেবে নিতে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই হামলা পূর্বপরিকল্পিত ও গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ; এর পেছনে বিরাট শক্তি কাজ করছে। ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য হচ্ছে নির্বাচনটি না হতে দেওয়া। এই আক্রমণটি খুবই ‘সিম্বলিক’।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে মনে হচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছে। তারা প্রশিক্ষিত শুটার নিয়ে মাঠে নেমেছে।’
সরকারের পাশাপাশি দলগুলোকেও শক্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তারা তাদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায়, নির্বাচনের সব আয়োজন ভেস্তে দিতে চায়। এগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তিগুলোর মধ্যে নির্বাচনের আগে এখন যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, তা থেকে সরে আসতে দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘নিজেদের মধ্যে যেন দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাজনৈতিক বক্তব্য থাকবে, কিন্তু কাউকে শত্রু ভাবা বা আক্রমণ করার সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে হবে। নির্বাচনের সময় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তবে মাথায় রাখতে হবে—এটি যেন একটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে নিয়ন্ত্রণে থাকে।’
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক করে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হানাহানি শুরু হওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়েছে। আপনাদের শুধু দলীয় স্বার্থ নয়, জাতীয় স্বার্থের বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে।
‘ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারলে কোনো নিরাপত্তাই কাজে আসবে না’
বৈঠকে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা ঐক্য ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। তা না হলে পতিত আওয়ামী লীগের ফিরে আসার পথই সুগম হবে বলে উপলব্ধি প্রকাশ করেন তাঁরা।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে আমাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। যেকোনো অবস্থাতেই পরস্পরের দোষারোপ থেকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের মধ্যে যতই রাজনৈতিক বক্তব্যের বিরোধিতা থাকুক না কেন, জাতির স্বার্থে এবং জুলাইয়ের স্বার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতেই হবে।’
অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করার পরামর্শ দেন বিএনপির এই নেতা।
জামায়াত নেতা মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের নানা বক্তব্য একে অন্যকে দোষারোপ করার প্রবণতা বাড়িয়েছে, যার ফলে আমাদের বিরোধীরা সুযোগ পেয়েছে। ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে আমরা একে অন্যকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছি। জাতিকে বিভক্ত করে এমন কথা আমরা কেন বলব? আমাদের পূর্বের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সব দলকে তাদের কমিটমেন্ট ঠিক করতে হবে।’
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জুলাই অভ্যুত্থানবিরোধী প্রচারের দিকটি দেখিয়ে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন ন্যারেটিভ তৈরি করা হচ্ছে, যাতে মনে হয় যারা অভ্যুত্থান করেছে, তারা অপরাধ করেছে।’
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে ‘নরমালাইজড’ করতে নানা চেষ্টা চলছে দাবি করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘টিভি টক শোতে তারা নিয়মিত অংশ নিচ্ছে, প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় বৈঠক করছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মিলিত হচ্ছে এবং আদালত প্রাঙ্গণে স্লোগান দিচ্ছে।’
‘বুদ্ধিজীবী বেশে, সাংস্কৃতিক কর্মী বেশে’ থাকা আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নকারীদের থামাতে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান নাহিদ।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘জুলাইকে সবাই মিলে ওউন করতে হবে। জুলাইকে কে কী বলবে—এই টানাপোড়েনে আমরা জুলাইকে শেষ করে দিচ্ছি। ষড়যন্ত্রকারীরা আমাদের অনৈক্যকে আমাদের পরাজয় হিসেবে দেখছে। তারা ভারতে বসে যা ইচ্ছা তা-ই করছে, আর আমরা কিছুই করতে পারছি না।’
নিজেদের জন্য বিশেষ কোনো নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই মন্তব্য করে নাহিদ বলেন, তাঁরা এটা নেবেনও না।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা নিজেরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারলে কোনো নিরাপত্তাই আমাদের কাজে আসবে না।’