খালেদা জিয়াকে কেন আপসহীন বলা হয়

খালেদা জিয়া, বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, যিনি নির্বাচনে হারেননি কখনোফাইল ছবি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়াকে আলাদা করে চেনা যায় তাঁর সিদ্ধান্তের দৃঢ়তায়। স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদের অধীন ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনা অংশ নিলেও খালেদা জিয়া সে পথে যাননি। আপসের বদলে সংগ্রামকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। সময়ই তাঁর সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণ করে। ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন ঘটে আর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। পরবর্তী জীবনে কারাবরণ ও রাজনৈতিক নিপীড়ন তাঁকে বারবার পরীক্ষায় ফেলেছে; কিন্তু আপস করেননি, যা খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে ‘আপসহীন’ নেত্রীর অভিধা জুড়ে দেয়।

রাজনীতিতে নামার পর ১৯৮২ সালে প্রথম সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন খালেদা জিয়া
ছবি: মো. লুৎফর রহমান বীনু

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্যের গুলিতে শহীদ হন। তাঁর গঠন করা বিএনপির তখন টালমাটাল অবস্থা। গৃহবধূ খালেদা জিয়া ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ সদস্য হিসেবে বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৮৩ সালের মার্চে দলের ভাইস চেয়ারপারসন এবং ১৯৮৪ সালের আগস্টে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

আরও পড়ুন

মূল নেতৃত্ব হাতে পাওয়ার দুই বছরের মাথায় স্বৈরশাসনের অধীন নির্বাচন না করার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে খালেদা জিয়া স্পষ্ট করেন—তিনি দীর্ঘ লড়াইয়ের ভার বইতে চান। এরশাদের পতনের আন্দোলন বেগবান করতে সাতদলীয় জোট নিয়ে রাজপথে নামেন তিনি। এ সময় তাঁর দল থেকে একের পর এক নেতা ভাগিয়ে নেন এরশাদ। খালেদা জিয়া কয়েকবার সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আটক হয়েছেন, পুলিশি হামলার শিকার হন বহুবার। এরশাদ সরকার ৮৫ দিন গৃহবন্দী করে রাখেন তাঁকে। অন্যদিকে আন্দোলন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আটদলীয় জোট ও বামপন্থী দলগুলোর পাঁচদলীয় জোট। শেখ হাসিনাকেও এরশাদ সরকার গৃহবন্দী করে। এর পরও এরশাদের অধীন ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। বিএনপি এটিকে ‘নীলনকশার’ নির্বাচন আখ্যা দেয়।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ছিল তিন জোটের ঢাকা অবরোধ। তার পরদিন রাজধানীর হোটেল পূর্বাণী থেকে খালেদা জিয়াকে আটক করে পুলিশ
ছবি: মো. লুৎফর রহমান বীনু

খালেদা জিয়াকে নিয়ে লেখা ‘খালেদা’ বইয়ে লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ লেখেন, ‘খালেদা চরিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো তার আপসহীন ভাবমূর্তি। তিনি একাধিকবার গ্রেপ্তার কিংবা অন্তরিণ হয়েছেন। তাঁকে কখনো আপস করতে দেখা যায়নি। রাজনীতিতে তিনি একটি মানদণ্ড তৈরি করে দিয়েছেন।’

আরও পড়ুন

আপসহীন ধারা ধরে রাখেন পরেও

এরশাদ পতনের পর দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকে প্রায় দেড় দশক। ২০০৭ সালে আসে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যা এক-এগারোর সরকার নামে পরিচিতি পায়। ওই সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই সরকার শেখ হাসিনাকেও কারাগারে পাঠিয়েছিল। প্রায় এক বছর আট দিন জেলে থাকার পর ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কারাগার থেকে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০০৮ সালের ৩ জুলাই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করা হয়।

২০০১ সালে সরকার গঠনের পর জাতীয় সংসদে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া
ছবি: মো. লুৎফর রহমান বীনু

২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন শেখ হাসিনা। এক-এগারোর সরকারের সময় করা শেখ হাসিনার সব মামলা বাতিল হয়; কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা মামলা বেগবান করে শেখ হাসিনার সরকার।

২০০৮ সালের ১১ জুন শেখ হাসিনা মুক্তি পান। পরদিনই তিনি চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। তখনো খালেদা জিয়া কারাগারে ছিলেন। রাজনৈতিক মহলে আলোচনা ছিল যে শেখ হাসিনা বিদেশে যাওয়ার পর খালেদা জিয়াকেও বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল তৎকালীন সেনাসমর্থিত সরকার। কিন্তু তাতে রাজি হননি খালেদা জিয়া। পরে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানকে বিদেশে পাঠানো হয় এবং খালেদা জিয়া মুক্ত হন। এরপর ৬ নভেম্বর শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। খালেদা জিয়ার আপসহীন মনোভাবের কারণেই দুই নেত্রীকে ‘মাইনাস’ করার চিন্তা থেকে সরে আসে তখনকার সরকার।

আরও পড়ুন

গণতান্ত্রিক সরকার আমলে প্রথম কারাবন্দী

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা জোরদার হলে বিএনপির নেতারা বলতে থাকেন যে, এর মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হতে পারে—এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন বিএনপির নেতারা।

মামলার রায় যখন ঘনিয়ে আসে, এর আগে ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই চোখ ও পায়ের চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। খালেদা বিরোধীরা প্রচার করতে থাকে যে সাজা এড়াতে খালেদা জিয়া বিদেশ গেছেন। তিনি হয়তো আর ফিরবেন না। তবে প্রায় দেড় মাসের মতো লন্ডনে থেকে দেশে ফিরে মামলা মোকাবিলা করেন খালেদা জিয়া।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি আদালতের পথে খালেদা জিয়া। সেদিন দুর্নীতির মামলায় রায়ের পর তাঁকে কারাগারে নেওয়া হয়েছিল
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ জজ আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেন। ওই দিনই তাঁকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ কোভিড মহামারির সময় শর্তসাপেক্ষে তার সাজা স্থগিত করে সরকার। যাতে তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে পারেন। তবে এটি পূর্ণ মুক্তি ছিল না; তিনি আসলে বন্দীই ছিলেন। ছাত্র গণ–অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পূর্ণ মুক্ত হন খালেদা জিয়া।

আরও পড়ুন

প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও অনড়

এক-এগারোর পরবর্তী সময়ে রাজনীতি পুনরুদ্ধারের পরও খালেদা জিয়া আপসের পথে হাঁটেননি। চাপ থাকার পরও তিনি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেন। কারণ, তিনি প্রকাশ্যেই বলতেন, শেখ হাসিনার অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এ জন্য তিনি ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সরকারের বৈধতা দিতে রাজি ছিলেন না।

২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসার সামনে বালুর ট্রাক রেখে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল তাঁকে
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

চার দশকের বেশি সময়জুড়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে অনড় থাকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন খালেদা জিয়া। এর জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও তাঁর দল বিএনপিকে মূল্যও দিতে হয়েছে। তবে শেষ বিচারে তাঁর দৃঢ়চেতা মনোভাব তাঁকে আপসহীন নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি এমন এক নেত্রী, যাঁর জীবন ও রাজনীতি বারবার প্রমাণ করেছে—সব আপস রাজনৈতিক লাভ আনে না, আর সব অনমনীয়তাও পরাজয় নয়।