ইভিএমের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়ে ব্যালটের জন্য সমঝোতা চাওয়া কেন

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল
ফাইল ছবি

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ দেড় শ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে গুরুত্ব দেয়নি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এই যন্ত্র নিয়ে বেশির ভাগ দলের সন্দেহ, অবিশ্বাসের কথা আমলে না নিয়ে নিজস্ব বিবেচনাতেই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কিন্তু সব আসনে কাগজের ব্যালটে ভোট করার জন্য কমিশন বলছে রাজনৈতিক সমঝোতার কথা। যে যন্ত্র নিয়ে বিতর্ক আছে, সেটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মত গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর দীর্ঘদিন থেকে যে ব্যালট পেপারে ভোট হয়ে আসছে, সেটার জন্য কেন রাজনৈতিক সমঝোতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল? এমন নয় যে ব্যালটে ভোট গ্রহণ নিয়ে আপত্তি উঠেছে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল গতকাল বুধবার নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক সংকট প্রকট হবে না। সংকট ইভিএম নিয়ে নয়, সেটা আরও মোটাদাগের সংকট। রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে ফয়সালা হলে সব আসনে ভোট ব্যালটে হবে।

ইভিএম প্রযুক্তিগতভাবে দুর্বল যন্ত্র। ইসি, তাদের কর্মকর্তা, কারিগরি দল, প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা ইভিএমে জালিয়াতি করতে পারেন। আর এই ইসির ওপর মানুষের আস্থা নেই। সংকটটা সেখানেই। এখানে রাজনৈতিক সংকট নেই।
বদিউল আলম মজুমদার, নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়ে গত মঙ্গলবার বিবৃতি দেন ৩৯ বিশিষ্ট নাগরিক। এ নিয়ে গতকাল সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে সিইসি এ কথা বলেন।

আরও পড়ুন

অথচ গত ৩১ জুলাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে সিইসি বলেছিলেন, ‘অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না। এর ভেতরে কী জানি একটা আছে। আমরা অনেককেই আস্থায় আনতে পারছি না। ইভিএম বিষয়ে সংকট থেকে যাবে।’

ইভিএমে ভোট করলাম কি করলাম না, সেটা নয়; নির্বাচনটা নিরপেক্ষ, সঠিক, অবাধ ও নির্বিঘ্ন হলো কি না—সেটা ইভিএমে হোক, ব্যালটে হোক, সেটা হওয়াটা বড় কথা। কাজেই বড় ধরনের সংকট ওখানে নয়, আপনারও জানেন ওই সংকট নিরসন হলে নির্বাচনটা সুন্দরভাবে উঠে আসবে।
সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল

সিইসির ওই বক্তব্যের পর ইভিএম নিয়ে অনাস্থা-সংশয় দূর করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তারা কোনো ধরনের যোগাযোগ করেছে বলে জানা যায়নি। তাহলে মাসখানেকের ব্যবধানে কেন সিইসির মনে হচ্ছে, ইভিএম নিয়ে সংকট নেই?

গত আগস্টে ইসির সংলাপে ২২টি রাজনৈতিক দল ইভিএম নিয়ে মতামত দিয়েছিল। তার মধ্যে নয়টি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়েছে। আরও পাঁচটি দল ইভিএম নিয়ে সংশয় ও সন্দেহের কথা বলেছে। কেবল আওয়ামী লীগসহ চারটি দল ইভিএমে ভোট চেয়েছে। বিএনপিসহ যে নয়টি দল ইসির সংলাপ বর্জন করেছিল, তারাও ইভিএমের বিপক্ষে।

আরও পড়ুন

এই রাজনৈতিক মতবিরোধের মধ্যেই ইভিএমে ভোটের সিদ্ধান্ত নিয়ে সিইসি বলেছিলেন, কে কী বলল, তা মুখ্য ছিল না, ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য বিবেচনায় এসেছে সুষ্ঠু ভোট।

এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, ইভিএমের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতামত আমলে নেওয়া হয়নি। তাহলে ব্যালটে ভোট নেওয়ার ক্ষেত্রে কেন রাজনৈতিক সমঝোতার প্রশ্ন আসছে? ইসি কি ৩০০ আসনে সুষ্ঠু ভোট চায় না? ইভিএমই যদি সর্বোত্তম ব্যবস্থা হয়ে থাকে, তাহলে ৩০০ আসনে কেন সেটা হবে না? ইসি বলছে, সব আসনে ইভিএমে ভোট করার মতো ইভিএম তাদের হাতে নেই। তবে প্রকৃতপক্ষে ইসির হাতে এখন যে ইভিএম আছে, তা দিয়ে একাধিক দিনে ভোট করলে এসব দিয়ে ৩০০ আসনে ভোট করা সম্ভব।

বিশিষ্টজনেরা সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ইসির এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক বিতর্ককে আরও উসকে দেবে এবং কমিশনের বর্তমান আস্থার সংকটকে আরও প্রকট করে তুলবে।

এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি গতকাল বলেন, ‘ইভিএমে ভোট করলাম কি করলাম না, সেটা নয়; নির্বাচনটা নিরপেক্ষ, সঠিক, অবাধ ও নির্বিঘ্ন হলো কি না—সেটা ইভিএমে হোক, ব্যালটে হোক, সেটা হওয়াটা বড় কথা। কাজেই বড় ধরনের সংকট ওখানে নয়, আপনারও জানেন ওই সংকট নিরসন হলে নির্বাচনটা সুন্দরভাবে উঠে আসবে।’

ইভিএম বা ব্যালট বড় কথা নয়, সঠিক নির্বাচনই বড় কথা—এমনটা বললেও গতকালের বক্তব্যে বারবার ইভিএমের পক্ষেই বলেছেন সিইসি। ইভিএমকে দুর্বল যন্ত্র আখ্যা দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় সিইসি বলেন, যন্ত্র দুর্বল কি সবল, এটা ইসির বিবেচনা করার বিষয় নয়। সবল হওয়ারও দরকার নেই, দুর্বল হওয়ারও দরকার নেই। যন্ত্র কাজ করছে কি না, এটাই আসল বিষয়। তিনি বলেন, তাঁরা দৃঢ়ভাবে বলতে চান, ইভিএমে জালিয়াতি সম্ভব নয়।

কাগজের ব্যালটে সব আসনে ভোট করতে ৭০০ থেকে ১ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে। আর কেবল দেড় শ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলে আরও প্রায় দুই লাখ ইভিএম কিনতে হবে। এর পেছনে ব্যয় হবে চার হাজার কোটি টাকার মতো। ইভিএম সংরক্ষণ, প্রশিক্ষণ মিলিয়ে নতুন ইভিএম কিনতে যে প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে, তার ব্যয় কমবেশি আট হাজার কোটি টাকা ধরা হবে বলে ইসি সূত্রে জানা গেছে।

এই ব্যয়ের বিষয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, এটা দেখার দায়িত্ব ইসির নয়। সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা লাগবে, তা ইসি বলবে। সরকার যদি বলে টাকা দিতে পারবে না, তাহলে ইসি জোরাজুরি করবে না। সুষ্ঠু ভোট ও অসুষ্ঠু ভোটের আর্থিক মূল্য বিবেচনা করলে তা ইভিএমের খরচের চেয়ে বেশি হতে পারে।

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইভিএমের বাইরে আর কিছু কি প্রয়োজন নেই? সিইসি কি সেগুলো চাইবেন? যেমন ইসির সঙ্গে সংলাপে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ১০টি দল নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ বা সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিল। আর ১২টি দল নির্বাচনকালে সরকারের ক্ষমতা সীমিত করে ইসির ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছে। আর বিএনপিসহ যে ৯টি দল সংলাপ বর্জন করেছে, তাদের কাছেও মূল বিবেচ্য বিষয় নির্বাচনকালীন সরকার।

ইভিএম ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়ে যে ৩৯ জন নাগরিক বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাঁদের একজন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইভিএম প্রযুক্তিগতভাবে দুর্বল যন্ত্র। ইসি, তাদের কর্মকর্তা, কারিগরি দল, প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা ইভিএমে জালিয়াতি করতে পারেন। আর এই ইসির ওপর মানুষের আস্থা নেই। সংকটটা সেখানেই। এখানে রাজনৈতিক সংকট নেই।

যখন ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, তখন দলগুলোর মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কেন?—প্রশ্ন রেখে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এখন রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বলে ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে। সবার কথা শুনতে চাইলে ইসির উচিত ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত এখনই বাতিল করা।