মদিনার উপকণ্ঠেই বাস করত ইহুদি গোত্র বনু কোরাইজা। তাদের সঙ্গে নবীজির চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল এই মর্মে যে তারা মদিনার মুসলিমদের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার শত্রুতা পোষণ করবে না। তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে না এবং কখনো মদিনা আক্রান্ত হলে মুসলমানদের তারা সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করবে।
কিন্তু বনু কোরাইজা এই সব ক’টি চুক্তি ভঙ্গ করে। খন্দকের যুদ্ধে মক্কার কুরাইশেরা যখন মদিনা অবরোধ করে, তারা তাদের নানাভাবে সহায়তা করে। চুক্তির সব ক’টি ধারা অমান্য করে তারা অস্ত্র ধারণ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে।
জিবরাইল (আ.) মারফত আল্লাহ ফরমান পাঠালেন নবীজিকে, বনু কোরাইজার এই বিশ্বাসঘাতকতার সমুচিত শাস্তি দেবার জন্য। আল্লাহর আদেশ পেয়ে নবীজি (সা.) সে দিনই আসরের সময় মদিনার পার্শ্ববর্তী বনু কোরাইজার এলাকা অবরোধ করে ফেললেন।
অঝোরধারার কান্না দেখে তার আবেগের নদী আরও প্রবল বেগে উথলে ওঠে। আবেগের বশবর্তী হয়ে তিনি নবীজির গোপন পরিকল্পনার কথা তাদের কাছে ফাঁস করে দেন।
অবরোধের প্রায় ২৫ দিন পর তারা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। তবে একটি আর্জি রাখে নবীজির কাছে। তাদের অন্যতম মিত্র সাহাবি আবু লুবাবা ইবনে আবদিল মুনজিরের সঙ্গে আলাপ করে তবেই তারা অস্ত্র সমর্পণ করবে। নবীজি তাদের এই মিনতি রাখলেন। আবু লুবাবাকে পাঠালেন বনু কোরাইজার ইহুদিদের সঙ্গে আলাপ করবার জন্য।
সাহাবি আবু লুবাবা (রা.) ছিলেন নরম মনের মানুষ। বনু কোরাইজার দুর্গে প্রবেশ করতেই ইহুদি নারী-শিশুরা তার কাছে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
এমন অঝোরধারার কান্না দেখে তার আবেগের নদী আরও প্রবল বেগে উথলে ওঠে। আবেগের বশবর্তী হয়ে তিনি নবীজির গোপন পরিকল্পনার কথা তাদের কাছে ফাঁস করে দেন—’আমার পরামর্শ, তোমরা অস্ত্র সমর্পণ করো। তবে তোমরা অস্ত্র সমর্পণ করো কিংবা না করো, তোমরা কেউই বাঁচতে পারবে না৷ তোমাদের সবাইকেই হত্যা করা হবে।’
তির ছুটে গেছে হাত থেকে। তাকে আর ফেরাবার উপায় নেই। কথাটা মুখ থেকে বেরোনোর পরই আবু লুবাবার উপলব্ধ হয়—মারাত্মক ভুল করে বসেছেন তিনি। নবীজির একান্ত গোপন পরিকল্পনা ফাঁস করে দিয়েছেন শত্রুপক্ষের কাছে। নবীজি ও মুমিনদের সঙ্গে বিরাট অন্যায় করে ফেললেন তিনি।
নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হতে থাকেন আবু লুবাবা (রা.)। লজ্জায় তিনি আর নবীজির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন না। মদিনায় ফিরে মসজিদে নববির একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেলেন নিজেকে। প্রতিজ্ঞা করেন, যতক্ষণ না নবীজি তার অপরাধ মার্জনা করে নিজ হাতে খুলে দিচ্ছেন তার রশির বাঁধন, ততক্ষণ এভাবেই নিজেকে সে বেঁধে রাখবে খুঁটির সঙ্গে।
অভিযান শেষ। জয়ী হয়ে মদিনায় ফিরেছেন নবীজি। বনু কোরাইজা আত্মসমর্পণ করলে তাদের অনুরোধে তাদেরই ধর্মমতে বিচার ধার্য হয় যে তাদের পুরুষদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া করা হবে এবং বন্দি করা বে নারী ও শিশুদের।
নবীজি (সা.) জেনেছেন সব যে আবু লুবাবা নিজেকে মসজিদে নববির খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন। কিন্তু তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। তিনি অপেক্ষা করতে থাকেন ওহির আগমনের। আল্লাহ–তাআলাই ফয়সালা করবেন আবু লুবাবার৷
একজন পূর্ণ বয়স্ক ও কর্তৃত্ববান পুরুষ নিজেকে বেঁধে রেখেছেন মসজিদের খুঁটির সঙ্গে। নিজের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেবল কৃত ভুলের মার্জনার জন্য শাস্তি দিচ্ছেন নিজেই নিজেকে। এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় আর ক’টি আছে আমাদের জানা নাই। নামাজ আর প্রাকৃতিক প্রয়োজনের সময় বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। প্রয়োজন শেষে আবার তিনি নিজেকে জড়িয়ে নেন রশির শক্ত বাঁধনে—এভাবেই পেরিয়ে যায় পাঁচটি দিন।
নবীজিকে এভাবে অকস্মাৎ হেসে উঠতে দেখে তিনি কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আল্লাহ তাআলা আপনার হাসিকে অম্লান রাখুক। কী কারণে হেসে উঠলেন, জানতে পারি কি?’
ঘটনার ষষ্ঠ দিনের কথা। নবীজি (সা.) রাত যাপন করছেন উম্মে সালামার ঘরে। রাত ফুরিয়ে ভোরের আলো যখন উদ্ভাসিত হতে চলেছে, তখন নবীজির কাছে এসে পৌঁছুল আল্লাহর ফরমান। কবুল করে নিয়েছেন তিনি আবু লুবাবার তওবা। তার কৃত অপরাধ মাফ করে দিয়েছেন তিনি।
আয়াত অবতীর্ণ হলো আবু লুবাবার ক্ষমা ঘোষণায়, ’আর কিছু মানুষ আছে এমন, যারা নিজেদের পাপ স্বীকার করেছে। তারা মিশ্রিত করে ফেলেছে একটি নেক কাজ এবং অন্য একটি বদকাজ। শীঘ্রই আল্লাহ হয়তো তাদের ক্ষমা করে দেবেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহ ক্ষমাশীল করুণাময়।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ১০২)
প্রিয় সাহাবির ক্ষমা ঘোষণায় নবীজির চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মিষ্টি হাসির দোলা ছড়িয়ে পরে তাঁর অবয়ব জুড়ে। উম্মে সালামা কাছেই ছিলেন। নবীজিকে এভাবে অকস্মাৎ হেসে উঠতে দেখে তিনি কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আল্লাহ–তাআলা আপনার হাসিকে অম্লান রাখুক। কী কারণে হেসে উঠলেন, জানতে পারি কি?’
নবীজি বললেন, ‘আল্লাহ–তাআলা আবু লুবাবার তওবা কবুল করে নিয়েছেন।’
রাসুলের মুখে এ কথা উচ্চারিত হওয়ামাত্র হাসির বিচ্ছুরণে উম্মে সালামার মুখও আলোকিত হয়ে ওঠে। আবু লুবাবা ক’দিন ধরে নিজেকে যেভাবে শাস্তি দিচ্ছেন, অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে যেভাবে নিজেকে বেঁধে রেখেছেন মসজিদে নববির খুঁটির সঙ্গে—তা দেখে উম্মে সালামার মনও ভার হয়ে উঠেছিল। রাসুলকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তার তওবা কবুলের সংবাদ কি আমি বাইরে গিয়ে সবাইকে বলতে পারি?’
নবীজি (সা.) মুচকি হেসে তাঁর প্রিয়তমার অভিপ্রায়ে সম্মতি প্রকাশ করেন।
উম্মে সালামা উঠে গিয়ে তাঁর হুজরার মুখে দাঁড়িয়ে আবু লুবাবাকে সম্বোধন করে বলেন, ‘আবু লুবাবা, সুসংবাদ গ্রহণ করো। আল্লাহ তোমার তওবা কবুল করে নিয়েছেন।’ (সিরাতুন নাবাবিয়্যা, ৩/১৮৭; মাওসুয়াতু উম্মাহাতুল মুমিনিন, ১৪৬-১৪৭)
আরেক দিন। নবীজি বসে আছেন উম্মে সালামার ঘরে। হঠাৎ ওহি এল, ‘হে নবী-পরিবারের সদস্য, আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে।’ (সুরা আহজাব, আয়াত: ৩৩)
আয়াতটি অবতীর্ণ হবার পরক্ষণেই নবীজি হাসান-হুসাইনকে খবর দিয়ে আনালেন। আয়াতটি শুনিয়ে কন্যা ফাতিমা ও হাসান-হুসাইনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘এরাই আমার আহলে বাইত (পারিবার)। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করুন এবং নিজ রহমত দ্বারা তাদের ঢেকে নিন।’
রাসুলের মুখে এমন দোয়া শুনে বিষণ্ণ হয়ে পড়েন উম্মে সালামা। রাসুল বলেন, ‘তোমার কী হলো!’ উম্মে সালামা বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমি কি আপনাদের সঙ্গী নই!’ রাসুল মুচকি হেসে বলেন, ‘তুমিও আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত।’ (আল-মুজামুল কাবির, ২৩/৩৫৭)
ওহি অবতীর্ণ হবার সঙ্গে তিনি একাই বিশিষ্ট নন, উম্মে সালামারও অংশ আছে প্রতিপালকের এই বিশেষ নেয়ামতে।
আয়েশা (রা.)-এর ঘরে থাকাবস্থায় নবীজির কাছে বহুবার ওহি অবতীর্ণ হয়েছে। এটা নিয়ে আয়েশার গর্বের শেষ ছিল না এবং এটা পরম গর্বেরই। কিন্তু আয়েশার ধারণা ছিল, এমন গৌরবে আল্লাহ–তাআলা কেবল তাঁকেই গৌরবান্বিত করেছেন। নবীজি আর কারও ঘরে থাকাবস্থায় আল্লাহ–তাআলা ওহি পাঠাননি। এটাকে আয়েশা আল্লাহ–তাআলার তরফ থেকে নিজের বিশেষ এক প্রাপ্তি বলে ধারণা করতেন। যেই নিয়ামতে তিনি একাই বিশিষ্ট এবং অন্যদের কাছে তার এই বৈশিষ্ট্যের প্রকাশও করতেন বেশ তৃপ্তির সঙ্গে।
একদিনের কথা। সখীপরিবেষ্টিত বসে আছেন আয়েশা (রা.) । রাসুলের অন্যান্য স্ত্রীরাও উপস্থিত আছেন সেখানে। আয়েশা এই প্রসঙ্গটি আলোচনায় তুললেন এবং দাবি করলেন, এটা তাঁর একার বৈশিষ্ট্য। আর কারুর ঘরে আল্লাহ–তাআলা ওহি পাঠাননি।
উম্মে সালামা (রা.) পাশে বসে আয়েশার এই কথা শুনছিলেন আর হাসছিলেন। তারপর আয়েশার বলা যখন শেষ হয়, তখন তিনি আবু লুবাবার ক্ষমা ঘোষণাকেন্দ্রিক ঘটনাটি বলেন এবং বলেন, ওহি তাঁর ঘরেও অবতীর্ণ হয়েছে একাধিকবার এবং আরও স্মরণ করিয়ে দেন, তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা সেই তিনজন সাহাবির কথা। তাদের ক্ষমা ঘোষণা-সংবলিত আয়াত যখন অবতীর্ণ হয়, সে মুহূর্তেও নবীজি তাঁর ঘরেই অবস্থান করছিলেন।
সেদিন, উম্মে সালামার মুখে এ কথা শোনার পর আয়েশা (রা.)-এর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, ওহি অবতীর্ণ হবার সঙ্গে তিনি একাই বিশিষ্ট নন, উম্মে সালামারও অংশ আছে প্রতিপালকের এই বিশেষ নেয়ামতে। (মাওসুয়াতু উম্মাহাতুল মুমিনিন, ৩১৫)
আহমাদ সাব্বির : আলেম ও লেখক