শহীদ হতে ব্যাকুল এক সাহাবি
মৃত্যু অমোঘ, কিন্তু সেই মৃত্যুই যখন কারও ললাটে সৌভাগ্যের তিলক এঁকে দেয়, তখন তা হয়ে ওঠে জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। ত্যাগের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ এমন কিছু ক্ষণজন্মা মানুষের জীবনে পরম পাওয়া হয়ে আসে শাহাদত; তা-ও আবার স্বয়ং আল্লাহর রাসুলের (সা.)-এর পবিত্র হাতে। এর চেয়ে পরম তৃপ্তি ও মহিমান্বিত মৃত্যু আর কী হতে পারে?
ইসলামের ইতিহাসে এমনই এক প্রোজ্জ্বল নক্ষত্র হলেন বিখ্যাত তরুণ সাহাবি আবদুল্লাহ জুল-বিজাদাইন ইবনে আবদুল উজ্জা আল-মুজানি। তিনি মুজায়না গোত্রের সন্তান এবং প্রসিদ্ধ সাহাবি আবদুল্লাহ বিন মুগাফফালের চাচা।
তিনি রাসুলের সাহচর্য গ্রহণ করেন এবং তাঁর সঙ্গেই অবস্থান করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী (আওয়াহ), অত্যন্ত মর্যাদাবান এবং পবিত্র কোরআনের একনিষ্ঠ তিলাওয়াতকারী।
আবদুল্লাহ (রা.) ছিলেন শৈশবে পিতৃহারা এতিম। পিতার কাছ থেকে কোনো সম্পদ পাননি। তবে তাঁর চাচা ছিলেন প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য ব্যক্তি; তিনি আবদুল্লাহর দায়িত্ব নেন এবং তাঁর তত্ত্বাবধানেই আবদুল্লাহ বড় হন। যৌবনে উপনীত হলে চাচা তাঁকে অনেক উট, ভেড়া ও দাস–দাসী প্রদান করেন।
আল্লাহর রাসুল মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এলে আবদুল্লাহর মন ইসলামের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। কিন্তু চাচার ভয়ে তিনি তা প্রকাশ করতে পারছিলেন না।
পার্থিব জীবনের সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যখন তাঁর হাতের মুঠোয়, ঠিক তখনই মদিনা থেকে উচ্চারিত তওহিদের বাণী তাঁর হৃদয়ের গভীরে আলোড়ন তোলে। আল্লাহর রাসুল মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এলে আবদুল্লাহর মন ইসলামের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। কিন্তু চাচার ভয়ে তিনি তা প্রকাশ করতে পারছিলেন না। কেননা তাঁর চাচা ছিলেন চরম ইসলামবিরোধী।
আবদুল্লাহ মনেপ্রাণে চাইতেন চাচা ইসলাম গ্রহণ করুক, যিনি তাঁকে লালন-পালন করে বড় করেছেন।
মুহাম্মদ বিন কা’ব আল-কুরাজি বর্ণনা করেন, আবদুল্লাহ জুল-বিজাদাইনের হৃদয়ে রাসুল (সা.) এবং ইমানের প্রতি গভীর ভালোবাসা জন্মেছিল। মদিনাগামী হিজরতকারী সাহাবিদের তিনি অভ্যর্থনা জানাতেন এবং তাঁদের কাছ থেকে কোরআন শিখতেন। জ্ঞান অর্জনের নেশায় তিনি তাঁদের সঙ্গে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে চলতেন; এরপর পরবর্তী কাফেলার জন্য অপেক্ষা করতেন। এ সময় তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেও তা গোপন রেখেছিলেন।
এভাবে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যায়। অনেক ঐতিহাসিক যুদ্ধও সংঘটিত হয়। অবশেষে একদিন সাহস করে চাচাকে বললেন, ‘চাচা, আমি এত দিন আপনার ইসলাম গ্রহণের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু আমি দেখছি আপনি মুহাম্মদের আদর্শ গ্রহণের কোনো ইচ্ছাই করছেন না। এখন আমাকে অন্তত ইসলাম গ্রহণের অনুমতি দিন।’
স্বভাবতই চাচার ক্রোধ ছিল তীব্র। তিনি গর্জন করে বললেন, ‘তুমি যদি শেষ পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করার স্পর্ধাই দেখাও, তবে আমার দেওয়া যা কিছু তোমার কাছে আছে—এমনকি তোমার পরনের এই কাপড়টুকুও আমি কেড়ে নেব।’
মায়ের কাছে গেলে মা নিজের একটি মোটা চাদর দুই টুকরা করে দিলেন। তিনি এক টুকরা লুঙ্গির মতো করে এবং অন্য টুকরা চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে মদিনার পথে পা বাড়ালেন।
কিন্তু সত্য দ্বীনের কাছে পার্থিব ধনসম্পদ ছিল মূল্যহীন।
নিষ্ঠুর চাচা সত্যিই তাঁর দেওয়া সবকিছু কেড়ে নিলেন, এমনকি তাঁর পরনের কাপড়টিও টেনে নিয়ে তাঁকে রিক্ত করে দিলেন। আবদুল্লাহ সেই অবস্থায় তাঁর মায়ের কাছে গেলে মা নিজের একটি মোটা চাদর দুই টুকরা করে দিলেন। তিনি এক টুকরা লুঙ্গির মতো করে এবং অন্য টুকরা চাদরের মতো গায়ে জড়িয়ে মদিনার পথে পা বাড়ালেন।
তিনি যখন মদিনায় পৌঁছালেন, তখন শেষ রাতের সময়। তিনি ক্লান্ত শরীরে মসজিদে নববিতে শুয়ে থাকলেন। রাসুল (সা.) ফজরের নামাজ শেষ করে নিয়ম অনুযায়ী উপস্থিত সবার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছিলেন। অপরিচিত পোশাকে তাঁকে দেখে নবীজি চিনতে পারেননি।
ফলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে?’
তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। এরপর নিজের ওপর ঘটে যাওয়া সবকিছু খুলে বললেন। তাঁর এই আত্মত্যাগের কাহিনি শুনে নবীজি দুঃখে বিগলিত হলেন। তিনি তখন তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখলেন আবদুল্লাহ। আর তাঁর এই ত্যাগের স্মারকস্বরূপ উপাধি দিলেন ‘জুল-বিজাদাইন’, যার অর্থ ‘দুই টুকরা কম্বলওয়ালা’।
আল্লাহর রাসুল বললেন, ‘আবদুল্লাহ, আজ থেকে তুমি আমার কাছাকাছিই থেকো।’
এর পর থেকে তিনি রাসুলের মেহমানদের অন্তর্ভুক্ত হন এবং তাঁর কাছ থেকে কোরআন শিখতে থাকেন।
মসজিদে নববিতে আশ্রয়লাভের পর আবদুল্লাহ (রা.) রাত–দিন কোরআন পড়া ও শোনায় মগ্ন থাকতেন। পবিত্র কোরআনের প্রতি তাঁর আগ্রহ এত তীব্র ছিল যে তিনি উচ্চ স্বরে পাঠ করতেন। সব সময় জিকির-তসবি পাঠে ডুবে থাকতেন। এত জোরো আওয়াহ করে কোরআন পড়তেন বলে একবার ওমর (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, সে কি লোক দেখানো কাজ করছে না?’
রাসুল (সা.) বললেন, ‘ওমর, তাকে কিছু বোলো না। সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য সবকিছু ত্যাগ করে এসেছে।’ (আল-আওসাত, তাবারানি, হাদিস: ৯১১১; মুসনাদে বাজ্জার, হাদিস: ১৭০৬; মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, হাইসামি, হাদিস: ৪২৩৭)
ওকবা বিন আমের (রা.) বলেন, জুল-বিজাদাইন সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই সে একজন “আওয়াহ” (অত্যন্ত বিনয়ী ও আল্লাহর কাছে ক্রন্দনকারী)।’ কারণ, তিনি কোরআন পাঠ ও দোয়ার মাধ্যমে অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করতেন এবং পাঠের সময় কণ্ঠস্বর উঁচু করতেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৭৪৪৭; আল-মুজামুল কাবির, জাদুল মাআদ, ইবনুল কায়্যিম: খণ্ড-৩, পৃ. ৪৭১)
নবম হিজরিতে যখন তাবুক অভিযানের ডাক এল, সেটি ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। একদিকে গ্রীষ্মের খরতপ্ত দাবদাহে মরুভূমি পুড়ছিল, অন্যদিকে ছিল পাথেয় আর বাহনের চরম সংকট। কিন্তু সব বাধা তুচ্ছ করে আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রায় ৩০ হাজার সাহাবির এক বিশাল কাফেলা নিয়ে রোম সম্রাটের দর্প চূর্ণ করতে রওনা হন।
আল্লাহর কসম, আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, যদি এই কবরের বাসিন্দা আজ আমি হতাম! যদিও আমি তাঁর পনেরো বছর আগে ইসলাম গ্রহণ করেছি।আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)
এই কঠিন যাত্রায় আবদুল্লাহর অন্তরে যেন শহীদ হবার বাসনা উথলে উঠল। তিনি ব্যাকুল হয়ে রাসুলের কাছে যান এবং আকুতি জানান, ‘আল্লাহর রাসুল, আপনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন, যেন আমি শহীদ হতে পারি।’
রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমাকে একটি গাছের ছাল এনে দাও।’ এনে দিলে সেটি আবদুল্লাহর বাহুতে তিনি বেঁধে দেন এবং দোয়া করেন, ‘আল্লাহ, আমি অবিশ্বাসীদের জন্য ওর রক্ত হারাম করে দিলাম।’
আবদুল্লাহ কিছুটা অবাক হয়ে বললেন, ‘আল্লাহর রাসুল, আমি যে শহীদ হতে চাই!’ রাসুল বললেন, ‘তুমি যখন আল্লাহর পথে যুদ্ধের জন্য বের হয়েছ, তখন যদি তুমি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যাও, তবু তুমি শহীদ। তোমার বাহন যদি তোমাকে ফেলে দেয় আর তাতে তোমার মৃত্যু হয়, তাহলেও শহীদ। এই দুটির মধ্যে যেভাবেই তোমার মৃত্যু হোক, তুমি তার পরোয়া কোরো না।’
তাবুকে পৌঁছার পর রাসুলের কথা সত্য প্রমাণিত হয়। আবদুল্লাহ জুল-বিজাদাইন (রা.) ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হন। আর এই জ্বর তাঁকে কাঙ্ক্ষিত মনজিলে পৌঁছে দেয়, তাবুকেই তিনি ইন্তেকাল করেন তিনি। (আল-ইসাবাহ, হাদিস: ৪৮০৭; সিরাতে ইবনে হিশাম: খণ্ড-২, পৃ. ৫২৮; যাদুল মাআদ: খণ্ড-৩, পৃ. ৪৭৩)
বিলাল বিন হারিস আল-মুজানি (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি সেই রাতে তাঁর দাফনের দৃশ্যে শরিক ছিলাম। বিলাল (রা.) কবরের কাছে একটি আগুনের মশাল ধরে পথ দেখাচ্ছিলেন। আমি দেখলাম, রাসুল স্বয়ং তাঁর কবরে নামছেন, আবু বকর ও ওমর (রা.) তাঁর লাশ রাসুলের হাতে তুলে দিচ্ছেন। আল্লাহর রাসুল তাঁদের বলছিলেন, ‘তোমাদের ভাইকে আমার দিকে এগিয়ে দাও।’
এরপর যখন তিনি তাঁকে কবরে শায়িত করলেন, তখন দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ, আমি আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর ওপর সন্তুষ্ট ছিলাম, আপনিও তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যান।’
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আমি যেন আজও দেখতে পাচ্ছি আল্লাহর রাসুল তাবুক যুদ্ধে; তিনি আবদুল্লাহ জুল-বিজাদাইনের কবরের ভেতরে নেমে দাঁড়িয়ে আছেন। আল্লাহর কসম, আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, যদি এই কবরের বাসিন্দা আজ আমি হতাম! যদিও আমি তাঁর পনেরো বছর আগে ইসলাম গ্রহণ করেছি।’
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবু বকর সিদ্দিক (রা.)–ও এই মর্যাদা দেখে একই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন। (দালাইলুন নুবুওয়্যাহ, আবু নাঈম ইসফাহানি: খণ্ড-২, পৃ.-৫২৮; উসদুল গাবাহ, ইবনুল আসির: খণ্ড-৩, পৃ. ১২৩, ২২৮)
ইলিয়াস মশহুদ : লেখক ও অনুবাদক