ইরাকে প্রবাসীরা যে কারণে মাতৃভূমিতে রমজান কাটাতে পছন্দ করেন

সাহরির খাবারের জন্য কেনাকাটা করছেন আবু আহমেদ আবু কালাল (আল জাজিরা)

পঞ্চাশোর্ধ্ব নাফি আল-ফারতুসি স্বদেশে রমজান কাটান মায়ের আদেশ পালনের জন্য। তিনি বলেন, ‘মা মনে করেন, রমজানে পরিবারের সবাই একত্র হওয়া জরুরি, তাতে যদি আমি আমেরিকাতেও থাকি। পশ্চিমাদের থ্যাঙ্কসগিভিং দিবসের মতোই আমাদের কাছে রমজান। তাই আমি ও আমার রোমানিয়ায় অধ্যয়নরত বোন রমজানে ইরাকে ফিরে আসি।’

 বাড়ি ফিরে নাফি পুরনো বাড়িতে ভাই-বোন এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন। একসঙ্গে ইফতার আয়োজন করেন। দেখেন যে, তার মা গ্রীষ্ম থেকে বামিয়া (ঢেঁড়স ) সংরক্ষণ করে রেখেছেন, যাতে রোজায় খেতে পারেন। নাফি মাছ পছন্দ করেন বলে তার মা বন্দর শহর ফাও থেকে জুবাইদি (এক ধরনের জনপ্রিয় মাছ) নিয়ে এসেছেন।

 রমজান ইরাকে পুনর্মিলনের মাস। বাড়ির সবাই মিলে গল্প করেন, পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করেন এবং প্রবাস জীবনের কষ্ট শেয়ার করেন। দ্রুতই রমজানের ত্রিশ দিন শেষ হয়ে যায়, প্রবাসীরা যার যার কাজে জীবনের স্বাভাবিক রুটিনে ফিরে যান, এই প্রত্যাশা নিয়ে যে, আবার আগামী বছর প্রিয়জনের কাছে ফিরে আসবেন, মাতৃভূমির বুকে সুন্দর রাতগুলো একসঙ্গে কাটাবেন।

আরও পড়ুন
ঐতিহ্যবাহী ইরাকি পোশাক এবং রমজানের লণ্ঠন (আল জাজিরা)

ঐতিহ্য, পরিবার ও বন্ধনের আকর্ষণ

অনেকেই আছেন রমজান মাস এমন দেশে কাটাতে চান যেখানে দিনের রোজার সময় কম এবং আবহাওয়া আরও মনোরম। ইরাকি প্রবাসীদের ক্ষেত্রে চিত্রটা ঠিক বিপরীত, আবহাওয়া যেমনই হোক তারা রমজান মাস নিজ দেশে কাটাতে পছন্দ করেন। এই মাসে ইরাকের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, পারিবারিক একতা এবং সামাজিক সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত হয়, যা বিদেশে পাওয়া যায় না।

 এক মাসের ছুটি

আবু আহমেদ আবু কিলাল দুবাইয়ে বাস করেন। তিনি রমজান শুরু হওয়ার আগেই ইরাকে ফিরে এসেছেন। তিনি এই পুরো মাস তার পরিবার, মা, সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের সঙ্গে থাকবেন তিনি। এটা তার প্রতি বছরের রীতি। তিনি দেশে থাকেন ঈদুল ফিতরের শেষ দিন পর্যন্ত। তিনি বলেন, ‘প্রবাসে একা একা লাগে। রমজানে বাগদাদ এবং আমার শহর সামাওয়াতের স্বাদ একেবারে আলাদা। বিশেষ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও মানুষকে রোজা পালনে অনুপ্রাণিত করে। ইফতারের সময় পুরো পরিবার একত্র হয়। থাকে বাহারি খাবার—ইরাকি খেজুর, শুরবা (স্যুপ) এবং নানা ধরনের মিষ্টান্ন।’

আরও পড়ুন

রমজানের ঐতিহ্যবাহী রমজান খাবার

 ইরাকের রমজান খাবারের টেবিলে থাকে বিভিন্ন ধরনের খেজুর, মিষ্টান্ন ও পানীয়। জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে রয়েছে দোলমা, শুরবা, তাস-কি-বাব (গরুর মাংসের তরকারি), মুরগি গ্রিল, ঘরে তৈরি কাবাব এবং আরবি সালাদ। এছাড়াও রমজানের অন্যতম মিষ্টান্ন বাকলাভা, জিলাপি, কুনাফা এবং পানীয় হিসেবে থাকে লেবুর শরবত, কিশমিশের শরবত, লাবান ও তান্নুর রুটি।

রমজানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক

 ইরাকের রমজান শুধু খাবারের জন্যই বিখ্যাত নয়, ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং আলোকসজ্জার জন্যও প্রসিদ্ধ। বাগদাদের অধিবাসীরা বিশেষ ধরনের পোশাক পরিধান করে বের হন। রমজানের ফানুস (প্রদীপ) ঝুলতে থাকে প্রতিটি বাড়ির অলিন্দে।

আরও পড়ুন

ঐতিহ্যের শেকড়ে ফিরে যাওয়া

 রমজান উপলক্ষে শহরের বাজারগুলো ও রাস্তাঘাটে বিশেষভাবে আলোকসজ্জা করা হয়। ইরাকে রয়েছে অসংখ্য মসজিদ এবং হোসাইনের স্মৃতি-বিধৌত অঞ্চল। বিশেষ করে ইফতারের পরের সময়টিতে ইরাকের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।

সামাজিক গবেষক নাদা আল-আবিদি বলেন, ‘ইরাক রমজানে ব্যতিক্রম সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হয়। প্রবাসী ইরাকিরা সেই সুন্দরের টানেই ছুটে আসে। পবিত্র মাসের সুন্দর পরিবেশ তারা উপভোগ করতে চায়। প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যত উন্নত হোক না কেন, পরিবার ও আত্মীয়দের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সংস্কৃতি এখনো ইরাকে রমজানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে রয়ে গেছে, যা ইফতার থেকে শুরু করে রাতের ইবাদত পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকে।’

আরও পড়ুন

তারাবি নামাজের বিশেষ পরিবেশ

 ইফতারের পর তারাবি নামাজ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সুন্নি মুসলিমদের মধ্যে এটি বেশি প্রচলিত, তবে কোথাও কোথাও শিয়ারা অংশ নেয়। ইফতারের পর মসজিদের মাইক থেকে তসবি ও ইস্তিগফার ঘোষণার মাধ্যমে তারাবিহর সূচনা হয়। ইরাকিদের বিশ্বাস, তারাবি নামাজ রোজার দিন শেষে মানসিক প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিকতা এনে দেয়। বাগদাদের এক বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সী আবু তাকি আল-কাইসি বলেন, ‘আমার মেয়ের চিকিৎসার জন্য আমি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছি এবং আমি আশা করছি, এই পবিত্র মাসে আল্লাহ তাকে সুস্থতা দান করবেন। তবে আমার দোয়া পুরো মুসলিম উম্মাহর জন্য, প্রতিটি রোগী ও তাদের পরিবারের জন্য।’

ইরাকিদের উদারতা ও দানশীলতা

 ইরাকে রমজান মাস শুধু রোজার জন্য খ্যাত নয়, বরং দান ও সহযোগিতার মাস হিসেবেও স্বীকৃত। ইরাকি মুসলিমরা মনে করেন গরিব ও দুস্থদের সাহায্য করা এই মাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, যা সমাজে সংহতি ও সহানুভূতি বৃদ্ধি করে। মসজিদ, হোসেইনিয়া এবং বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে ইফতার আয়োজন করে গরিব ও অভাবীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। বাগদাদের আজমিয়া শহরে অবস্থিত ইমাম আবু হানিফা আন-নুমানের মাজার, কাজিমিয়া শহরের ইমাম মুসা আল-কাজিমের মাজার এবং শেখ আবদুল কাদির জিলানির মাজারে প্রতিদিন ইফতার পরিবেশন করা হয়।

 পুরো রমজান মাস জুড়ে গরিব ও রোজাদারদের জন্য বিনা মূল্যে খাবার বিতরণ করা হয়, পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য ত্রাণ বিতরণ ও খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট বিতরণের বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই দানশীলতা ও ভ্রাতৃত্ববোধই ইরাকি সংস্কৃতির একটি মূল বৈশিষ্ট্য, যা রমজান মাসে আরও বেশি দৃশ্যমান হয়।

 সূত্র: আল-জাজিরা ডট নেট

আরও পড়ুন