ঈদ মানেই একটা ফাঁকা শহর

>

ঈদ হলো আনন্দের ভেলায় চেপে হাসিখুশিভরা বর্ণিল জগতে হারিয়ে যাওয়া। বিনোদনজগতের এই তারকা ফিরে তাকিয়েছেন তাঁর ফেলে আসা ঈদের প্রান্তরে।

মোশাররফ করিম
মোশাররফ করিম

ঈদ মানে একটা ছুটির দিন। আর এই বয়সে আমার কাছে এখন ঈদ হলো পরিবারের সঙ্গে থাকা, শুটিংয়ে না যাওয়া কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ। শৈশব-কৈশোর পার হয়ে আসার পর ঈদ নিয়ে প্রচলিত যে আবেগ, সেগুলো খুব বেশি স্পর্শ করত না আমাকে।

কোনো কোনো ঈদে গ্রামের বাড়ি বরিশালে যেতাম, আবার ঢাকায় থাকতাম কোনো কোনো ঈদে। সে সময় বাড়িতে যাওয়াটাই ছিল একটা আনন্দ। আর ঢাকায় থাকা মানেই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। গত শতকের নব্বই দশকে বেশির ভাগ ঈদই কাটত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে। আড্ডাই তো সব আনন্দের উৎস। আড্ডা হতো বেইলি রোড, চারুকলার সামনে, বন্ধুদের বাসা বা নিজের বাসায়।

যখন ছাত্র ছিলাম, তখনকার ঈদ আর দশজন মানুষের মতোই কাটাতাম। মানে, সমাজব্যবস্থাটা যেমন ছিল, সে রকম। যদি ছোটবেলার কথা বলি, তখন রেডিমেড জামা পাওয়া যেত না। গজ কাপড় কিনে দরজির কাছে মাপ দিয়ে আসতে হতো। তারপর সেই জামা কবে হাতে পাব, ছিল সেই অপেক্ষা। জামা হাতে আসার পর কী যে আনন্দ হতো! এরপর শুরু হতো নতুন এক অপেক্ষা—কবে ঈদ আসবে? কেউ দেখলে জামা পুরোনো হয়ে যাবে বলে সেটা লুকিয়ে রাখতাম। ঈদের দিন সকালবেলা বের করে পরতাম। আহা, কত নির্ভার ছিল ছোটবেলাটা! সে কারণেই হয়তো সবকিছুই ছিল আনন্দময়।

ঈদের জামার প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমাদের শৈশবে বেলবটম প্যান্টের একটা ক্রেজ ছিল। বায়না ধরলাম, আমিও বেলবটম প্যান্ট বানাব। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো বিহারি এক দরজির দোকানে। মাপ নেওয়া হলো। তারপর যথারীতি রোমাঞ্চকর অপেক্ষা, কোমরের দিকে টাইট আর পায়ের দিকে চওড়া সেই প্যান্টটা পরে কখন স্কুলে যাব, সেই অপেক্ষা। প্যান্ট আসার পর দেখা গেল, প্যান্টটা উল্টো হয়ে গেছে, পায়ের দিকে চিপা আর কোমরের দিকে ঢিলা। সেই প্যান্ট আমি কোনোভাবেই পরতে চাইছিলাম না। সবাই পরছে এক রকম, আর আমি পরব আরেক রকম? যাহোক, একপর্যায়ে যখন ওই প্যান্ট পরে স্কুলে গেলাম, পুরো ক্লাস আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করল। 

নব্বইয়ের দশকে আমার কাছে ঈদের উত্তাপ হারিয়ে গিয়েছিল। ঈদ মানে তখনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। ঈদের সময় রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকত। রিকশায় চেপে বেড়ানো যেত। সেটাও বিশেষ কোথাও না, বন্ধুর বাসায়। যে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ম করে আড্ডা হতো, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ইউসুফ হাসান অর্ক, আমার দল ‘নাট্যকেন্দ্র’র বন্ধু ফজলুল কবির তুহিনের বাসা। এখনো রিকশায় ঘুরতে পছন্দ করি আমি। এখন অবশ্য আড্ডা দেওয়ার সময় তেমন পাই না। পেলে তাদের সঙ্গেই আড্ডা দিই। শুটিং করতে করতে অস্থির লাগলে, ভারাক্রান্ত মনে হলে চলে যাই তাদের কাছে। এই তো সেদিনও সারা রাত গান-বাজনা করলাম তুহিনের বাসায়। 

ঈদের আরেকটা রোমাঞ্চকর বিষয় ছিল ঈদকে কেন্দ্র করে বের হওয়া নতুন গানের ক্যাসেটগুলো। সেগুলো নিয়ে একধরনের উত্তেজনা ছিল। সেগুলো কিনতে ও শুনতে হবে—এ রকম একটা তাড়না কাজ করত আমার ভেতরে। তখন যাঁদের শুনতাম, সেই শিল্পীরা এখনো সরব, যেমন কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী। ব্যান্ডের মধ্যে ছিল ফিডব্যাক, মাইলস। তখনকার দিনের সেই গানগুলো শুনলে এখনো মনে হয়, ফিরে গেছি সেই সময়ে। মনে পড়ে, মাকসুদ ভাইয়ের গাওয়া ‘মনে পড়ে তোমায়’ গানটার কথা। গানটা আজও ভালো লাগে। 

কোরবানির ঈদ আমার কাছে অন্যদের মতো নয়। সবাই যেমন গরু কিনতে যায়, গরু-খাসির দেখভাল করে, আমার সে রকম কোনো প্রবণতা ছিল না কখনো, এখনো নেই। ছোটবেলা থেকেই হাট-বাজার আমার পছন্দ না। ভিড়, ঠেলাঠেলি—এগুলো সব সময় এড়িয়ে চলতাম। শৈশবে দেখেছি, বাড়িতে কোরবানির ব্যবস্থাপনা বাবাই করছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি চলে গেলেন। 

সত্যি বলতে, ঈদ নিয়ে আর দশজন সাধারণ মানুষের যে ধরন, পারিবারিক বা সামাজিক যে চর্চা, সেটা আমার ভেতরে তেমন ছিল না, বরং একটা বোহেমিয়ান ব্যাপার ছিল। কী বলব, আমার কাছে এখনো ঈদ মানে একটা ফাঁকা শহর, যেখানে রিকশায় ঘুরে বেড়ানো যাবে, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া যাবে আর হবে আড্ডা, তুখোড় আড্ডা।

মোশাররফ করিম: অভিনয়শিল্পী।