এ কোন সকাল

গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজ তরুণ ডাব ঝুলে আছে গাছে। ডাবের মসৃণ শরীর। ডাবগুলোকে মাধ্যাকর্ষণ টানে। কিন্তু টেনে নামাতে পারে না। গাছ তাকে আঁকড়ে রেখেছে। যদি নামাতে পারত, তাহলে যেখানে ভূমিষ্ঠ হতো তারা, ঠিক সেখানেই হয়তো খুঁজে পাওয়া যেত সেই চিহ্ন। কিংবা হয়তো খুঁজে পাওয়া যেত না তাদের; কারণ, তারা হয়তো চলে গেছে কীট, বাতাস, পতঙ্গ, জন্তু অথবা পৃথিবীর উদরে। তাদের খোঁজে অবশ্য একদিন দুজন কৌতূহলী মানুষ আসবেন ওই ডাবগাছের নিচে।

গাড়ি ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়ালে জানালার কাচে এক এক করে হাজির হয় ইনফরমাল ইকোনমি। কাঠির ডগায় পতাকার মতো উড়িয়ে দেওয়া আমড়া নিয়ে হাজির হন একজন, তিনি চলে যান। জানালার ওপারে শিশুদের ছবির বইয়ের পাতা মেলে ধরেন একজন। তাতে রঙিন জিরাফ গলা উঁচিয়ে থাকে। তিনিও চলে যান। আসেন প্রকৃতি, মানবাধিকার ইত্যাদিকে দ্বিধায় ফেলে দেওয়া একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তার ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। তিনি সাহায্য চান। তার পেছনের ফুটপাতে একটা গাছ। সেখানে কোনো পাখি নেই।

গাড়ির ভেতর গান বাজে, ‘আমি ঝড়কে যেদিন ধরে বেঁধে আমার মাঝি করেছি, আমি সেদিন থেকে জেতা বাজি হেরেছি।’ গাড়ির দুই প্রজন্মের যাত্রী গান শোনেন।

নাম জানো এই শিল্পীর?—আগের প্রজন্ম।

না—নতুন প্রজন্ম।

জটিলেশ্বর—আগের প্রজন্ম। 

স্ট্রেঞ্জ নাম—নতুন প্রজন্ম।

আশ্চর্য গান লেখেন তিনি। অফ ট্র্যাকের মানুষ।—আগের প্রজন্ম।

ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়লে জটিলেশ্বরের নতুন গান শুরু হয়, ‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার…।’

আগের প্রজন্ম, ‘এ গান তিনি একাত্তরে লিখেছেন, জানো। শুনেছি, একদিন ভোরে সীমান্তের ওপারে তিনি পথে দাঁড়িয়ে দেখলেন বাংলাদেশ থেকে আসছে অগণিত শরণার্থী। তিনি বাড়ি গিয়ে লিখলেন গানের প্রথম লাইন, ‘এ কোন সকাল রাতের চেয়ে অন্ধকার, এ কি পাখির কূজন, নাকি হাহাকার।’

গাড়িচালক শ্মশ্রুমণ্ডিত, বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ। এখন এ বয়সের গাড়িচালকের দেখা মেলে না বিশেষ। তিনি স্বল্পবাক। গাড়ির মালিক সম্প্রতি নিয়োগ দিয়েছেন তাঁকে। বন্ধুর বাবার গাড়ি চালাতেন তিনি। বাবার মৃত্যুতে বেকার হয়ে পড়েছিলেন। স্বল্পবাক এই শ্মশ্রুমণ্ডিত আর কোনো ব্যবসা জানেন না। স্টিয়ারিংয়ের ওপর তাঁর হাত। স্টিয়ারিংয়ে যেখানে তাঁর তর্জনী ও অনামিকা থাকার কথা, সেখানে শূন্যতা। এই শূন্যতার জন্যই গাড়ির মালিক নিয়োগ দিয়েছেন তাঁকে।

জটিলেশ্বরের গানের প্রেক্ষাপটে আগের প্রজন্ম জানান, তিনি গিয়েছিলেন এক জাদুঘরে। গণহত্যার জাদুঘর। রুয়ান্ডায়। ধারালো দা। প্রতিদিন দশ হাজার লোকের মৃত্যু। হুতু, টুটসি। এক শ দিন ধরে হত্যাযজ্ঞ। বীজ সেই বেলজিয়ামে। উপনিবেশে। এসব বলেন তিনি। কেমন আলো–অন্ধকার কামরা জাদুঘরে। রুয়ান্ডার গরিলারা গভীর বনে পাতা খুঁজতে বেরোয়। উত্তর গোলার্ধ থেকে অনেক হাঁস উড়ে যায় দক্ষিণে, উষ্ণতার আশায়। জীবনের স্বাদ ভালোবাসে তারা। তাদের হাতে ধারালো দা নেই, বন্দুক নেই। জাদুঘরের কামরায় অন্ধকার। সেখানে আরও হত্যাযজ্ঞের গল্প, বসনিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামের। এর ভেতর চেনা এক গল্প খোঁজেন আগের প্রজন্ম। সেই গল্পের দেশে কাঁঠালপাতা ঝরে, যেখানে ঘটেছে আরও ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ। না, পৃথিবীর সব দেশের গণহত্যার গল্প থাকলেও সে দেশের গল্প নেই জাদুঘরে।

নতুন প্রজন্ম, নেই কেন?

পুরোনো প্রজন্ম, মুক্তির কথা ছবিটা দেখেছিলে?

নতুন প্রজন্ম, না।

পুরোনো প্রজন্ম, সেখানে এক বৃদ্ধ বলেন, আমার পোলায় কয়, কিয়ের যুদ্ধের কথা কও তুমি? কোন যুদ্ধ করছ তুমি? ওই যুদ্ধ তুমি স্বপনে দেখছ। স্বপনে একটা খেলা খেলছ তুমি।

তাহলে স্বপ্নই কি ছিল সেটা, আমাদের সেই যুদ্ধ? তাই কি আমরা পৃথিবীর লোককে জানাইনি?—নতুন প্রজন্ম।

শ্মশ্রুমণ্ডিত গাড়িচালক তাঁর হাতের আংশিক শূন্যতা নিয়ে স্টিয়ারিং থেকে হাত উঠিয়ে গাল চুলকান। গাড়ি ডাবগাছের দিকে ধাবিত হয়। গাড়ি শহর ছাড়িয়ে গেলে চারদিকে শস্যখেত দৃশ্যমান হয়।

গাড়ির যাত্রী দুই প্রজন্ম চা খাবে বলে দূরপাল্লার রাস্তার পাশে দাঁড়ায়। একটা নিঝুম ঝুপড়ি চা–স্টল দেখা যায়। সেখানে রঙিন প্যাকেট, রঙিন পানীয়ের বোতল, ডিম, আগুনে পুড়ে যাওয়া কেটলি, বিড়ালছানার মতো সাদা সাদা কাপ। দুই প্রজন্মের গাড়ির যাত্রী রং–চা খাবেন বলে চা–স্টলে বসেন। ভিন্ন টেবিলে বসেন স্বল্পবাক শ্মশ্রুমণ্ডিত গাড়িচালক। টি–স্টলে টেলিভিশনে চলমান চলচ্চিত্রের নায়িকার পিঠে পরির মতো পাখনা।

কাপ–চামচের সশব্দ নড়াচড়া তরুণ চা বিক্রেতার দক্ষতার জানান দেয়। দূরে কোনো এক মাইকে কেউ একজন বলছেন, ‘সূর্যটা সেদিন মাথার খুব কাছে চলে আসবে। সূর্যের উত্তাপে সেদিন মাথার মগজগুলো গলে গলে পড়বে...’

পুরোনো প্রজন্ম চা বিক্রেতার ইতিবৃত্ত জানতে চান। চা বিক্রেতা তাঁর স্বপ্নের কথা বলেন। তিনি বলেন, তিনি অচিরেই রোমে চলে যাবেন। সেখানে তাঁর চাচাতো ভাই পিৎজার দোকান চালান, সেই দোকানে যোগ দেবেন।

নতুন প্রজন্ম চা বিক্রেতার চোখের ভেতর রোমের ক্যাথিড্রাল দেখতে পান। চা বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি জানেন, রোম কোন দেশে।

না। শুধু জানি, সেইটা বিদেশ।

এ সময় নতুন প্রজন্মের ফোন বেজে ওঠে। ওই প্রান্ত থেকে তাঁর বন্ধু বলেন, ছুটির দিনে তুই কই পালাইলি?

নতুন প্রজন্ম তাঁর ডাবগাছের কাছে যাবার প্রেক্ষাপট বলেন।

ওই প্রান্তের কণ্ঠস্বর, ‘তুই আবার ওই স্মৃতির পাল্লায় পড়লি? স্মৃতি ধুইয়া পানি খাবি?’

ফোন কেটে দেন নতুন প্রজন্ম।

শ্মশ্রুমণ্ডিত গাড়িচালক তাঁর তর্জনী আর অনামিকাবিহীন হাতে সাদা বিড়ালছানার মতো চায়ের কাপ উঠিয়ে তাতে চুমুক দেন।

একটা ভাঙা–পা শালিক দোকানের পাশের চত্বরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে।

টেবিলে রাখা খবরের কাগজ ওলটান আগের প্রজন্ম। নানা লেখায় চোখ বোলান তিনি। কেউ একজন লিখেছেন, ‘আমাদের দেশ তো একটা ছিলই। কিন্তু সে দেশটা থেকে বেরিয়ে এলাম কেন? কারণ তো এই যে ওই দেশটা পছন্দ হচ্ছিল না আমাদের। ওই দেশটা চালাত সামরিক শাসকেরা, ওই দেশটার একটা সাম্প্রদায়িক পরিচয় ছিল আর ওই দেশটার অর্থনীতি ছিল বৈষম্যমূলক। তাই তো রক্তপাতের ভেতর নতুন একটা দেশ পেলাম আমরা। কিন্তু সেই নতুন দেশ কতটা নতুন, তা নিয়ে অবশ্য ভাবা যেতে পারে।’

হাঁসেরা সম্ভবত ইতিমধ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধে। দিনের পর দিন দল বেঁধে উড়বে তারা। আগে পথ চিনে উড়বে একদল, তখন পেছনের হাঁসেরা শুধু ডানা মেলে ঘুমিয়ে থাকবে। তারপর জায়গা বদল করবে তারা। পেছনের দল সামনে এসে পথ দেখাবে আর সামনের দল ঘুমাবে পেছনে গিয়ে।

আবার চলতে শুরু করে গাড়ি। 

আগের প্রজন্ম, গাছটা এখনো কি আছে?

নতুন প্রজন্ম, আছে, আমি জানি।

একটা গাছ দেখার জন্য এত দূর আসার কোনো মানে হয় না। কিন্তু আগের প্রজন্মের এই মানুষ উদ্ভট কৌতূহলী। একজন আঙুলবিহীন মানুষকে গাড়িচালনায় নিয়োগ দেওয়া ঝুঁকি জেনেও এই উদ্ভট মানুষ তাঁকে নিয়োগ দেন। কারণ, তিনি তাঁর কাছে এই গাছের গল্প শুনতে পান। তারপর ওই গাছ দেখবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। এ ব্যাপারে তাঁর সন্তানকেও কৌতূহলী করতে সমর্থ হন। 

মোক্ষম দিন ভেবে দুই প্রজন্মের দুজন শহর ছেড়ে রওনা দেন এই বিশেষ মাসের ১৬ তারিখে।

গাড়িতে সেই অফবিট শিল্পীর গান বেজে চলে, ‘আমার স্বপন কিনতে পারে এমন আমির কই?’

নতুন প্রজন্ম জানতে চান, আচ্ছা, আমাকে বলো তো, হোয়াট একজ্যাক্টলি ডাজ ইট মিন, এই যে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’?

পুরোনো প্রজন্ম কোনো উত্তর দেন না। শিল্পী গেয়ে চলেন, ‘আমার জলছবিতে রং মেলাবে এমন আবির কই?’

অতঃপর তাঁরা সেই ডাবগাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ান। গাছে তখনো গুচ্ছ গুচ্ছ ডাব। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তাঁদের টানে; কিন্তু টেনে নামাতে পারে না।

গল্পটা শ্মশ্রু বলেছেন আগে। কিন্তু এই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে তাঁর সন্তানকে আবার সেই গল্পটা তাঁকে বলতে বলেন পুরোনো প্রজন্ম।

শ্মশ্রুমণ্ডিত জানান যে সে রাতে অন্ধকার ছিল খুব। চাঁদ ছিল না। অনেক রাতে দরজায় টোকা পড়ে। শ্মশ্রু তখন বালক। দাদি আর মায়ের সঙ্গে জবুথবু হয়ে থাকেন। বাবা গেছেন যুদ্ধে। ধড়মড়িয়ে ওঠেন তাঁরা। ঝুপঝাপ ঘরে ঢুকে পড়েন চার তরুণ। তাঁদের কাঁধে স্টেনগান। ক্লান্ত মুখের যোদ্ধারা ফিসফিস করে বলেন, ‘খাই না দুই দিন, দুইটা ভাত খাওয়াতে পারেন? সময় খুব কম।’

তটস্থ হয়ে পড়েন শ্মশ্রুর মা। চুলা জ্বালান, হাঁড়িতে চাল–ডাল ঢেলে দেন। গভীর রাতে কুপির অল্প আলোয় ভাত রান্না হতে থাকে। যোদ্ধাদের দেখে চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বালকের।

‘যতক্ষণ না ভাত রান্না হচ্ছে, আপনাদের ডাব খাওয়াই?’ যুদ্ধে সামান্য অবদান রাখার আকুতি বালকের। দা হাতে গাছের দিকে যায় সে। গাছি নয় সে, আনাড়ি, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দা হাতে সে উঠে যায় ডাবগাছে। উত্তেজনায় বুক ধড়ফড় করে তার। সময় কম। দ্রুত গাছের আগায় উঠে অন্ধকারে একের পর এক ডাব কাটে বালক। তিনটা ডাবের পর চতুর্থ ডাবের ওপর হাত রেখে প্রচণ্ড কোপ দিতেই সেই কোপ গিয়ে পড়ে তার আঙুলে। মুহূর্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার তর্জনী, অনামিকা। রক্ত ঝরতে থাকে।

সেই রাত, রক্তপাত, মায়ের আহাজারি, গরম ভাত, ডাব, যোদ্ধাদের স্টেনগানের নাটকীয়তা মনে পড়ে শ্মশ্রুমণ্ডিতের। মনে পড়ে, পরদিন ভোরে ডাবগাছের নিচে কাটা আঙুল দুটো পান বালক বয়সী শ্মশ্রু। আঙুল দুটোকে মা–ছেলে মিলে কবর দেন গাছের নিচে। জীবিত প্রবীণ শ্মশ্রুমণ্ডিতের মৃত দুটো আঙুল কবরস্থ আছে এ ডাবগাছের নিচে।

খুঁড়ে দেখেছেন কখনো আঙুলগুলো আছে কি না?—আগের প্রজন্ম।

নতুন প্রজন্ম, নেই। নিয়ে গেছে শিয়ালে।

নতুন প্রজন্মের ফোন বেজে ওঠে। বন্ধুর ফোন। ফোন কেটে দেন নতুন প্রজন্ম।

তাঁরা গাড়ির দিকে রওনা দেন আবার।

পুরোনো প্রজন্ম নতুন প্রজন্মকে বলেন, ওই যে তাঁর কাটা আঙুল দুটো, হয়তো ওটাই স্মৃতি। আঙুলগুলো হাতে নেই, মাটির নিচেও নেই। এই স্মৃতি ধুয়ে যে পানি খাবে, সে উপায়ও তো নেই।


শাহাদুজ্জামান কথাসাহিত্যিক