নতুন করে একুশের চেতনা

একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে এককথায় বলতে পারি, একুশে ফেব্রুয়ারি হলো বাঙালি জাতির পরিচয়চিহ্ন। তবে এটি তো এককথায় বলার বিষয় নয়। একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা বিভিন্নভাবে আমাদের ভিত্তি নির্মাণ করেছে। তাই প্রত্যেক বছর পত্রপত্রিকা থেকে আমাকে অনুরোধ করা হয়, একুশে ফেব্রুয়ারি সম্বন্ধে কিছু লিখতে। বিষয়টি নিয়ে নানা সময়ে আমি লিখেছিও। তাই এখন বরং আমি কীভাবে একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে পরিচিত হলাম সে কথাই বলি, বর্ণনাটি খানিকটা ব্যক্তিগত হয়ে যাবে যদিও।
এটা অনেকের জানা, স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পর রাঢ়বঙ্গ থেকে আমি বাংলাদেশে—খুলনায় এসেছি। সেটা ১৯৫৪ সাল। মানে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সাত বছর পর। তত দিনে ১৯৫২ তে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়ে গেছে; এবং আমি পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে এসেছি ভাষা আন্দোলনেরও দুই বছর পরে। এরপর তো এই দেশে চিরকালের জন্য স্থায়ী হয়ে যাওয়া।
এসেই ভর্তি হলাম খুলনার দৌলতপুরের ব্রজলাল কলেজে। বিএল কলেজ হিসেবে সবাই চেনেন এ প্রতিষ্ঠানকে। এটা সে সময় খুলনার প্রধান কলেজ হিসেবে পরিচিত। কেবল খুলনাতেই নয়, এই প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি ছিল বাংলাদেশজুড়ে। এ দেশে সে সময় খুলনার ব্রজলাল কলেজ, রংপুরের কারমাইকেল কলেজ, রাজশাহী কলেজ, বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ—বড় বড় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুখ্যাতি ছিল ভালো কলেজ হিসেবে। তো, বিএল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমার পৃথিবীটা অনেক বড় হয়ে গেল। যেন আমি মুক্ত পাখি, আকাশ আমার আশ্রয়। তবে এই মুক্তি আসলে স্কুল পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হওয়া এবং নতুন দেশে আসার জন্য নয়; এর প্রেক্ষাপটটা আরও বিস্তৃত। সহজ করে বললে সবকিছুর পরিধি অনেক বড় হয়ে গেল। এই প্রেক্ষাপটেই আমি প্রথম পরিচিত হলাম একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে।
ছাত্ররাজনীতির অবস্থা তখন এখনকার মতো নয়, সত্যিকার অর্থেই ছাত্ররাজনীতি সে সময় দেশীয় রাজনীতির পরিপোষক ছিল। ছাত্রসমাজ বিভিন্ন ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে ছিল অবিচল। কারণ, তারা দেখছে ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। হ্যাঁ, কলেজে উঠে মুক্তি ও নতুন জন্মের স্বাদ নিতে নিতে আমরা দেখলাম ক্ষুব্ধ স্বদেশ। তখনই বুঝেছি, পাকিস্তানিদের দ্বারা পরিচালিত এই রাষ্ট্রে সমতা ও ন্যায় নেই; পরিবর্তে আমাদের বাঙালিদের জন্য আছে সীমাহীন শোষণ, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা ও অপমান। সর্বোপরি সব ক্ষেত্রে এক উৎকট বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠল। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন এই বৈষম্য আর অপমানের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম সরব জবাব।
দৌলতপুরের বিএল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর অল্প দিনেই আমার যোগাযোগ তৈরি হলো ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। প্রগতিশীল ভাবধারার মানুষজন নিয়ে গড়ে ওঠা এই সংগঠনের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেলাম, তাদের রাজনীতি আমার রাজনীতি হয়ে গেল। ভাষা আন্দোলনকে সামনে নিয়ে আমরা আন্দোলন শুরু করলাম। তখন ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়া আরও যে ছাত্রসংগঠন বাঙালির ন্যায্য অধিকারের ব্যাপারে সবব ছিল, সেটা ছাত্রলীগ। তবে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গেই আমার গাঁটছাড়া। যদ্দূর মনে পড়ে, ১৯৫৪ তে কলেজে ভর্তি হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করি। সে সময় একুশে ফেব্রুয়ারি পালনে আজকের মতো আনুষ্ঠানিকতার অবকাশ ছিল না। সাধারণত সভা-সমিতির মাধ্যমেই স্মরণ করা হতো দিনটি। তখনো ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি গাওয়া হতো, কিন্তু সেটি কি এখনকার মতো উজ্জ্বল? মনে পড়ে না।
১৯৫৪-এর পর থেকে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব চোখে পড়ার মতো বেড়ে গেল। বায়ান্নর একুশের চেতনাকে ধারণ করেই তো চুয়ান্নর নির্বাচনে খাজা নাজিমুদ্দিন সরকারকে হটিয়ে যুক্তফ্রন্টের জয়লাভ। এই সময় থেকেই আওয়াজ উঠল ‘এক ইউনিট বাতিল কর, স্বায়ত্তশাসন দাও’। সেই পরম্পরায় আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যাত হলো এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবি মুখ্য হয়ে উঠল। পরবর্তীকালে ছেষট্টিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে ধীরে ধীরে নিয়ে চলল স্বাধিকারের দিকে। এরপরের ঘটনা তো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
এই প্রতিটি ঘটনার পেছনেই ভাষা আন্দোলন ও একুশে ফেব্রুয়ারির প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। প্রভাবটা বরং বাড়ছে দিনে দিনে। বাঙালি জাতিসত্তার মূলে যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেটা নতুনভাবে পরিচর্যা পেয়েছে। বাংলা ভাষা অন্য এক মাত্রায় পৌঁছেছে একুশে ফেব্রুয়ারির হাত ধরে। আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও। ফলে ওই যে বলেছি, চুয়ান্নর পর থেকে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব চোখে দেখার মতো বেড়ে গেল। গুরুত্বের সেই বৃদ্ধি এখন দেশ ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বে সম্প্রসারিত।
একুশে ফেব্রুয়ারি এবং ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যের সঙ্গে সঙ্গে এখন বাংলা ভাষা নিয়েও দু-চার কথা বলা যাক।
বিশ্বের পঁচিশ কোটি লোক আজকে বাংলা ভাষায় কথা বলে। এই পঁচিশ কোটি লোকের ভাষা বাংলা টিকবে না—এ কথা বলা যায় না। আর ইতিমধ্যে এই ভাষার মধ্যে যা তৈরি হয়ে আছে, যা কিছু এই ভাষার ভান্ডারে আছে তা এত তাড়াতাড়ি বিলুপ্ত হবে বলে মনে হয় না। ব্যাপারটা যে নিছক আবেগের বশে বলছি তা মোটেই নয়। সেদিন কেউ একজন বলছিল, বাড়িঘর করে কী হবে, বাংলাদেশ একদিন ডুবে যাবে। সেদিন খবরের কাগজে দেখলাম ২০৩৬ সালে বাংলাদেশের ওপর একটা গ্রহাণু এসে পড়বে। তাতে করে বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু এসব বাস্তব হয়ে ওঠার আগেই মানুষ প্রতিরোধ ও বিকল্প ব্যবস্থাও গড়ে তুলবে। আর বাংলাদেশ ডুবে যাওয়া মানে কিন্তু ভাষার মৃত্যু নয়। বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাওয়া মানে ভাষার বিলুপ্তি নয়। কারণ ভাষাটা কোনো ভৌগোলিক সীমার মধ্যে থাকে না, থাকে মানুষের মধ্যে। মানুষ যদি থাকে তাহলে তার ভাষাও থাকবে। আর আমাদের বাংলাদেশের বয়স কত?
চুয়াল্লিশ বছর। এই অল্প সময়ের মধ্যে সে যে নিজের অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটিয়ে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারল—এটা কি তার শক্তি ও সম্ভাবনার জানান দিচ্ছে না?
একুশে ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে এখন ভাষা নিয়ে এই যে কথা বলছি, এ সূত্রেই নিজের ভেতরে একটা প্রশ্ন বেশ বড় হয়ে দেখা দিল: ভাষা নিয়ে আমরা কী করেছি? আমরা মুখে মুখে অনেক কথা বলেছি। কিন্তু ভাষা নিয়ে কাজের কাজ কিছুই করতে পারিনি। যেমন কিছুটা স্ববিরোধী ভঙ্গিতেই আমি বলব উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাকে মাধ্যম করাটাই ভুল হয়েছে। এ কথা বললে লোকে আমাকে দেশদ্রোহী বলবে। বাংলাকে মাধ্যম করার আগে বোঝা দরকার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা কী পড়াই। দর্শন ও ইতিহাস পড়তে গিয়ে একজন বাংলায় যে বইগুলো পড়ে তা কি পাঠযোগ্য? বাংলায় দর্শনের ওপরে কোনো ভালো বই নেই। একজন ছাত্র যখন বাংলা বইয়ের মাধ্যমে দর্শনকে বোঝার চেষ্টা করে তখন সেটা অর্থহীন হয়ে পড়ে। সে ইংরেজি না জানার কারণে দর্শন ভালো করে বোঝে না অথবা অগোছালো বাংলায় দর্শনকে ভুলভাবে বোঝে। বাংলায় ফিলোসফির কোনো বই পড়া যায়? কিন্তু এর মানে এই নয় যে বাংলায় দর্শনচর্চা সম্ভব নয় বা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়। যত্ন নিয়ে, শ্রম দিয়ে এসবই সম্ভব। আমরা এই ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব। বাংলা ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি ভাষা। আমি মুষ্টিমেয় কিছু পণ্ডিতের ওপর অনাস্থা আনতে পারি, কিন্তু ২৫ কোটি মানুষের ভাষার ওপর আমার আস্থা গভীর।
তবে ২৫ কোটি মানুষের মুখের ভাষার ওপর আস্থা স্থাপন করেই বলি: বাংলা ভাষাকে সরাসরি প্রভাবিত করছে এমন ঘটনাও তো ঘটছে। যেমন ভারতীয় চ্যানেলের মাধ্যমে হিন্দি সংস্কৃতির আধিপত্য। এটা বাংলা ভাষাকে নিশ্চয়ই প্রভাবিত করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এটা আমরা ঘটতে দিচ্ছি কেন? যাদের পরামর্শে এটা হচ্ছে তারা ‘না’ করতে পারছে না, ‘না’ বলাটা শিখতে হবে।
আজকে একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্যকে ধারণ করতে হলে ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা—অধিপত্যবাদবিরোধী চেতনা ও শক্তির দিকে আমাদের ফিরে তাকাতেই হবে। সেখানেই আমাদের মুক্তি নিহিত।