পৃথিবীর দীর্ঘতম রাতও ভোর হয়, আমাদেরও বোধোদয় হোক
সিটি গ্রুপ–প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার ২০২৪ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে বিশেষ একটা বক্তৃতা দিয়েছেন উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার। সেই বক্তৃতার লিখিত রূপ—
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে আমার সম্পর্কের শুরুর কথা বলতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে। সেই বছর আমি দ্বিতীয় জাতীয় দাবার বাছাইপর্বে প্রথম অংশগ্রহণ করি। তখন আমার বয়স ছিল ৯ বছর। আর এ বছর আমি ৫৯তম জন্মদিন পালন করলাম। অর্থাৎ পুরো অর্ধশতক। এই ৫০ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশের ক্রীড়াজগৎ নিয়ে আমাকে কিছু বলতে বলা হয়েছে।
স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ফুটবল ছিল মূল খেলা। এ দেশের মানুষ বরাবরই ফুটবলপ্রিয়। ১৯৫৮ সাল থেকে ঢাকায় আগা খান গোল্ড কাপের মতো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হতো। স্বাধীনতার পরও খেলার তারকা বলতে আমরা ফুটবলারদেরই বুঝতাম। সালাহউদ্দিন ভাই, এনায়েত ভাই, চুন্নু ভাই, আসলাম ভাই—ওনারাই ছিলেন সত্তর–আশি দশকের তারকা। আমি নিজেও কিন্তু এই ফুটবল উন্মাদনার মধ্যে বড় হয়েছি। প্রতিদিন বিকেল হওয়ার আগেই আমি পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলতে নেমে পড়তাম। ১৯৭৭ সালে আমি জাতীয় দাবা খেলোয়াড় হয়ে গেছি, কিন্তু ফুটবল খেলা মিস দিতাম না। দাবাগুরু কাজী মোতাহার হোসেন আমার সঙ্গে দাবা খেলতে আসতেন। বাইরে থেকে ফুটবল খেলার আওয়াজ আসত, আর আমার মন ছটফট করত। কিন্তু এমন একজন মনীষী সামনে বসা, আমার কিছু করার থাকত না।
১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে এমসিসি, ভারতের ডেকান ব্লুজ এবং শ্রীলঙ্কা জাতীয় ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফরে আসে। আমরা এই ম্যাচগুলো মাঠে গিয়ে দেখেছি। এই সময় ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা একটু বাড়তে থাকে। রকিবুল হাসান, ইউসুফ রহমান বাবু, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশা, শফিকুল হক হীরা প্রমুখ ঘরে ঘরে বেশ পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন। হকি তারকা সাব্বির ইউসুফ, আবদুস সাদেক প্রমুখের নাম আমরা শুনেছিলাম, কিন্তু তাঁদের ফুটবলারদের মতো ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল না। তবে দাবা ফেডারেশনের রুমটা হকি স্টেডিয়ামের উল্টো দিকে হওয়ায় আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রায়ই হকি খেলা দেখতাম।
ফুটবল নিয়েই এই সময় মানুষের সবচেয়ে বেশি আবেগ ছিল। এই আবেগের কারণে সমর্থকদের মধ্যে অনেক মারামারিও হতো। ইটপাটকেল, আগুন, রেফারির মার খাওয়া—কোনো কিছুই বাদ ছিল না মোহামেডান-আবাহনী খেলায়। দুর্ভাগ্যবশত এই আবেগের কারণে কিছু লোক সে সময় প্রাণও হারায়। এই জনপ্রিয়তাই কিন্তু খেলার প্রাণ, আমাদের দেশে মাঠেঘাটে আজও ফুটবল খেলা হয়, তার কারণ এই আবেগ। এখন এই আবেগের সঙ্গে ক্রিকেটও যুক্ত হয়েছে।
কিন্তু খেলার আরেকটি দিক আছে। সেটা হচ্ছে স্পোর্টিং এক্সিলেন্স। সব রাষ্ট্রই চায় তার দেশের ক্রীড়াবিদেরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভালো করুক। অন্য দেশকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাক। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তারা রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হোক। এই দিক থেকে কিন্তু আমাদের বড় খেলাগুলো তখন অনেক পিছিয়ে ছিল।
আশির দশক থেকে শুরু করে ২০০০ সালের পরও আমাদের বেশির ভাগ সাফল্য আসে এমন সব খেলা থেকে, যেগুলোকে আমরা ‘ছোট’ খেলা বলে থাকি। আমি যদি কিছু নাম বলি...সাঁতারু মোশাররফ হোসেন খান, স্প্রিন্টার প্রয়াত মোহাম্মদ শাহ আলম, তাঁর পথ ধরে এলেন বিমল চন্দ্র তরফদার। শুটার আব্দুস সাত্তার নিনি, আতিকুর রহমান…পরে সাবরিনা, আসিফ, দাবায় আমি, রানী হামিদ, এরপর চার গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া, রিফাত, রাকিব ও এনামুল। বক্সার মোশাররফ ভাই, ওয়েটলিফটার মাবিয়া, দলগতভাবে জাতীয় কাবাডি দল আরও অনেকে বিভিন্ন সময় সম্মান বয়ে এনেছে দেশের জন্য। সব নাম বলে শেষ করা যাবে না, ফলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তবে একটা জিনিস পরিষ্কার। অনেক কম সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও সম্ভাবনার কোনো অভাব ছিল না আমাদের এই খেলাগুলোতে।
সমস্যা ছিল একটাই। প্রতিটি সাফল্যই যেন একটা নির্দিষ্ট সীমানা পর্যন্ত এসে আটকে যাচ্ছিল। দক্ষিণ এশিয়া, কমনওয়েলথ, কখনো কখনো এশিয়ান গেমস। বিশ্বের প্রথম সারিতে আমরা কিছুতেই প্রবেশ করতে পারছিলাম না। এখানে দুটি নাম আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, যার মধ্যে একটি নাম আমার নিজের। যদিও নিজের কথা বলতে আমার একটু বিব্রত লাগে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে বলা উচিত বলে মনে করছি। ভারতের কিংবদন্তি দাবাড়ু বিশ্বনাথন আনন্দের এক বছর আগে আমি গ্রান্ডমাস্টার হই, কিন্তু পরে আনন্দ বিশ্ব চাম্পিয়ন হলেও আমি আর তাঁর তুলনায় ততটা এগোতে পারিনি। একইভাবে আমাদের কৃতী শুটার আসিফ মাত্র ১৭ বছর বয়সে কমনওয়েলথ গেমসে স্বর্ণ জিতলেন। সেটিও জিতলেন ভারতের অভিনব বিন্দ্রাকে হারিয়ে। সেই বিন্দ্রাই কিছুদিন পর অলিম্পিক মেডেল গলায় পরলেন, কিন্তু আমাদের স্বপ্ন পূরণ হলো না। আমরা পেলাম না কাঙ্ক্ষিত অলিম্পিক মেডেল।
আসলে একজন বিশ্বমানের অ্যাথলেট পেতে কী করতে হবে, এই ধারণাটাই আমাদের কখনো ছিল না। ফুটবল আর ক্রিকেট ছাড়া আমি আজ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের খেলোয়াড়দের নিয়ে কোনো পরিকল্পনার কথা শুনিনি। কাউকে সেই রকম কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কেউ কোথাও ভালো কিছু করলে তাকে দুই-চার-পাঁচ লাখ টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়, আর তারপর ছবি-টবি তুলে আবার ফেডারেশনের দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া হয়।
আসলে যে মুহূর্তে আপনি বুঝতে পারবেন যে একটি খেলায় আপনার কোনো দল বা খেলোয়াড় বিশ্বমানের হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সঙ্গে সঙ্গে তার যত্ন নিতে হবে। রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এটা অনেকটা দক্ষ একজন মালির মতো কাজ। একজন মালি যেমন চারা গাছের যত্ন করে, তাতে পানি দেয়; খেলাধুলায়ও ঠিক তেমনিভাবে প্রতিভার যত্ন করতে হবে। তাকে আগলে রাখতে হবে।
এখন ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এ রকম—আমরা চারা লাগাচ্ছি, সেটা কিছুটা বড় হচ্ছে, ফলও ধরছে তাতে। কিন্তু তারপর কোনো কারণে গাছটা অকালে মরে যাচ্ছে। যে মহীরুহের অপেক্ষায় আমরা, তার দেখা মিলছে না। এই ব্যাপারে আমাদের রাষ্ট্রীয় একটি ক্রীড়া নীতি প্রয়োজন। শুধু এই কাজ জাতীয় ফেডারেশনের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। মনে রাখতে হবে আমাদের অধিকাংশ ফেডারেশনই আর্থিকভাবে সচ্ছল নয়। ফুটবল আর ক্রিকেট হয়তো নিজেরটা নিজে সামাল দিতে পারবে, কিন্তু অন্যরা সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। বলতে গেলে ক্রিকেট ছাড়া আর কোনো খেলাতেই খেলোয়াড়দের আর্থিক নিরাপত্তা নেই। একজন খেলোয়াড়কে শুধু খেলা আর কোচের ব্যবস্থা করে দিলেই হয় না। তার চলার জন্য চাই মাসিক ভাতা, তার ভবিষ্যতের জন্য চাই নিরাপত্তা। যখন সে খেলা ছেড়ে দেবে, তখন কী করবে? আজকে শাহ আলম, মোশাররফ ভাই, সিদ্দিকদের উত্তরসূরি নেই, দাবায় ১৮ বছরের গ্র্যান্ডমাস্টারের খরা, শুটিংয়ের মেডেলগুলোও আসা বন্ধ হয়ে গেছে। এর কারণ হচ্ছে, আমরা খেলোয়াড়দের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারি নাই। এই অবস্থা বছরের পর বছর চলেছে, এখনো চলছে।
প্রশ্ন করতে পারেন, কীভাবে বুঝলাম এখন চলছে? একটা উদাহরণই তো যথেষ্ট। এমনই না চললে রোমান সানা আর দিয়া সিদ্দিকীর মতো সম্ভাবনাময় তারকারা দেশ ছাড়ত না। বাংলাদেশের অর্থনীতি নাকি পৃথিবীর ৩০তম স্থানে আছে। তা-ই যদি হয়, আমাদের ইতিহাসের প্রথম অলিম্পিক পদকের জন্য কেন ১৫-২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা যাবে না? কেন বাংলাদেশের অলিম্পিকে পদক না জেতা সবচেয়ে জনবহুল দেশের অগৌরবের রেকর্ড থাকবে? আমাদের ক্রীড়াবিদেরা এই পদক আনবে, তাদের যদি সংসার চালানোর জন্য দুশ্চিন্তা করতে হয়, তাদের বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়...তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে!
আমাদের যে ব্যাপারটা বুঝতে হবে সেটা হচ্ছে, আমাদের আবেগের জায়গা ক্রিকেট ও ফুটবল এবং অন্য খেলাগুলো, যেগুলোকে আমরা ‘ছোট খেলা’ বলি, সেগুলো তেমন দর্শকপ্রিয় নয়। কিন্তু চাইলে আবেগ আর যুক্তি এই দুটো তো মেলানো যায়। আমরা অনেক সময়ই আমাদের ক্রীড়ার নীতিনির্ধারকদের দেখি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা দেখেন, ক্যামেরায় চেহারা দেখান। আমার মনে হয় তাঁরা যদি চেষ্টা করেন, অবশ্যই অন্য খেলাগুলোর জন্যও কিছু সময় বের করে আনতে পারবেন।
যাই হোক, আজকের ‘সিটি গ্রুপ-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার’–এর এই আনন্দঘন সন্ধ্যায় আমরা আবার আশায় বুক বাঁধছি। পৃথিবীর দীর্ঘতম রাতও ভোর হয়। আমাদেরও বোধোদয় হোক। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন আলোয় উদ্ভাসিত হোক। আর পথিকৃতদের যে ছোট-বড় বলা না বলা কাহিনিগুলো, তা নীল ধ্রুবতারা হয়ে নতুনদের পথ দেখাক।