শত্রুরও এমন ভুল চান না ডোনাল্ড

ক্লুজনার দৌড়ে এ প্রান্তের ক্রিজে এসে আর থামেননি। ডোনাল্ড অন্য প্রান্তের ক্রিজে পৌঁছানোর আগেই রান আউট। জন্ম নিল প্রোটিয়া ক্রিকেটের বিষাদকাব্য। ছবি: ক্রিকইনফো টুইটার
ক্লুজনার দৌড়ে এ প্রান্তের ক্রিজে এসে আর থামেননি। ডোনাল্ড অন্য প্রান্তের ক্রিজে পৌঁছানোর আগেই রান আউট। জন্ম নিল প্রোটিয়া ক্রিকেটের বিষাদকাব্য। ছবি: ক্রিকইনফো টুইটার

সর্বকালের সেরা ওয়ানডে ম্যাচ?

অনেকে বলবেন, প্রশ্নবোধক চিহ্নটাই অবান্তর। তেমন ম্যাচ এখন আর দেখা যায় না! যদিও গত বিশ্বকাপ ফাইনালও অনেকের চোখে সর্বকালের সেরা ম্যাচ। কিন্তু ২১ বছর আগে বার্মিংহামে যা ঘটেছিল, তা অনেকেই ভুলতে পারেন না। বিশেষ করে অ্যালান ডোনাল্ড।

সময়ের হিসেব মিলিয়ে আর নামটি পড়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কোন ম্যাচের কথা বলা হচ্ছে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ, দ্বিতীয় সেমিফাইনাল।ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে এ ম্যাচের প্রভাব কিংবা আবেদন যাই বলুন না কেন, তা এত বেশি যে মনে হবে সেই বিশ্বকাপে একটাই সেমিফাইনাল ম্যাচ ছিল! প্রথম সেমিফাইনাল নিয়ে আগ্রহ খুব সামান্যই।

এর কারণ সহজ হলেও হৃদয়বিদারক। সেদিন সম্ভবত গোটা ক্রিকেট বিশ্ব দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য অনুশোচনা করেছে। তাতে আরও মহিমা বেড়েছে অস্ট্রেলিয়ার ফাইনালে ওঠার। আর ডোনাল্ড পুড়েছেন আত্মগ্লানির খরতাপে। দিন যত গেছে ততোই বেড়েছে উত্তাপ। দল বিবেচনা করলে প্রোটিয়াদের বিশ্বকাপ জয়ের ওটাই যে সেরা সুযোগ ছিল!

ডোনাল্ড সে সুযোগ ফেলে দেওয়ার পর পেরিয়ে গেছে দুই দশকেরও বেশি সময়। তবু 'সাদা বিদ্যুৎ'-এর অনুতাপ, 'এত বড় ভুল যেন আমার শত্রুও না করে।' ভুল যদিও ডোনাল্ডের একার ছিল না। ভীষণ চাপের মধ্যে অবিশ্বাস্য ব্যাট করা ল্যান্স ক্লুজনারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গিয়ে অবিশ্বাস্য, ব্যাখ্যাতীত এক দৌড়, আর ওপাশে ডোনাল্ডের দৌড়ের শুরুতে জমে যাওয়া, এই দুইয়ে মিলে জন্ম নেয় সেই মর্মান্তিক রূপকথা।

আগে ব্যাট করে ২১৩ রানে অলআউট হয় অস্ট্রেলিয়া। স্টিভ ওয়াহ ও মাইকেল বেভান ফিফটি পেলেও পেস বোলিং 'মাস্টারক্লাস' এর জন্ম দিয়েছিলেন শন পোলক (৫/৩৬) এবং ডোনাল্ড (৪/৩২)।

রান আউট হয়ে ড্রেসিং রুমের দিকে ফিরছেন ডোনাল্ড। অস্ট্রেলিয়া দলের উল্লাস। ছবি: আইসিসি
রান আউট হয়ে ড্রেসিং রুমের দিকে ফিরছেন ডোনাল্ড। অস্ট্রেলিয়া দলের উল্লাস। ছবি: আইসিসি

ওপেনিং জুুটিতে ৪৮ রান তুলে জয়ের পথেই ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।কিন্তু ওয়ার্নের ঘূর্ণিতে মাঝে মাত্র ১৩ রানের মধ্যে তারা হারায় ৪ উইকেট। সেখান থেকে ৮৪ রানের জুটিতে দলকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন জ্যাক ক্যালিস ও জন্টি রোডস। পরে রোডসকে ফিরিয়ে আরও একবার ম্যাচে ঘুরে দাঁড়ায় অস্ট্রেলিয়া। এরপর 'জুলু' চমক। নাহ, চমক নয় ওই বিশ্বকাপে ক্লুজনার প্রতি ম্যাচেই যা করছিলেন সেটাই করেন সেমিতে। শেষ দিকে মেরে বলের ছাল-চামড়া তুলে দলকে জেতানো।

শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ছিল ৯ রান। প্রথম দুই বলে চার মেরে ম্যাচটি টাই করে ফেলেছিলেন ক্লুজনার। পরের বল ডট। চতুর্থ বলটা ক্লুজনার ঠিকমতো খেলতে পারেননি। কোনোমতে ব্যাটে লাগিয়ে শুধু পড়িমড়ি করে ছুটলেন। ঠিক একই মুহূর্তে ক্লুজনারকে আবারও নামিয়ে দেওয়া হলে সাবেক এই প্রোটিয়া যে ওই পাগলাটে দৌড় দিতেন না তা নিশ্চিত।

কিন্তু সেদিন অবিশ্বাস্য ব্যাটিং করতে করতে ক্লুজনারের কাঁধে কী ভর করেছিল কে জানে! বলটা কোথায়, রান হবে কি না, সেসব না ভেবেই ক্লুজনার পড়িমড়ি করে ছুটলেন। ডোনাল্ড তখনো প্রায় অনড়! প্রথমে ক্রিজের দিকে ঘুরলেন, ব্যাট পড়ে গেল হাত থেকে। ততক্ষণে ক্লুজনার-ডোনাল্ড দাঁড়িয়ে একই প্রান্তে!

ওদিকে অস্ট্রেলিয়ান পেসার ডেমিয়েন ফ্লেমিং ঠান্ডা মাথায় আন্ডারআর্ম বোলিংয়ের মতো করে থ্রো দেন গিলক্রিস্টকে। ডোনাল্ড নিয়মরক্ষার জন্য যেন একটু দৌড়ালেন, হাল ছেড়ে দিতে হলো মাঝপথেই। গিলক্রিস্ট স্টাম্প ভেঙে ফেলেছেন!

ক্লুজনার তখনো দৌড়েই চলেছেন। ক্রিজ পেরিয়ে সোজা ড্রেসিং রুমের দিকে দৌড়। একটু থেমে একবার পেছন ঘুরে তাকালেন। কী ঘটিয়েছেন তা ফিরে দেখার সাহস তখনো ছিল! দেখলেন অস্ট্রেলিয়া দলের বুনো উল্লাস। ম্যাচ টাই হলেও সুপার সিক্সে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে জেতায় ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াই।

ডোনাল্ড-ক্লুজনারকে পরে অসংখ্যাবার সেই ম্যাচ নিয়ে কথা বলতে হয়েছে। সম্ভবত বেঁচে থাকতে হৃদয় খুঁড়ে এই বেদনা জাগানো থেকে নিস্তার নেই তাদের। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে ডোনাল্ড যেমন এ ম্যাচ নিয়ে একবার বলেছিলেন, ' কিছু বিষয় কখনো ভোলা যায় না। এ অসম্ভব।'

স্টাম্প ভাঙলেন গিলি। যেন প্রোটিয়াদের হৃদয়টাই ভেঙে দিলেন। ছবি: আইসিসি টুইটার
স্টাম্প ভাঙলেন গিলি। যেন প্রোটিয়াদের হৃদয়টাই ভেঙে দিলেন। ছবি: আইসিসি টুইটার

ডোনাল্ডের কাছে সেই ম্যাচ ক্রিকেটে মর্মান্তিক ভুলগুলোর একটি,'ওটা ক্রিকেটে সবচেয়ে বাজে ও মর্মান্তিক ভুলগুলোর একটি। আমার শত্রুরও যেন এমন ভুল না হয়।'

দীর্ঘদিন পর ডোনাল্ডের এ কথাগুলো তুলে আনার কারণ তো আছেই। ২১ বছর আগে সেই ম্যাচটা গড়িয়েছিল আজকের এই দিনে।