গ্যাবার গ্যালারিতে বসে দেখা ওয়েস্ট ইন্ডিজের অবিশ্বাস্য জয়
শামার জোসেফের করা ওভারটার চতুর্থ বলে ১ রান নিয়ে প্রান্ত বদল করলেন স্টিভ স্মিথ। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসটা তিনি একাই টানছেন তখন, ওপেনিংয়ে নেমেও অবিচল ৯১ রানে। পড়ন্ত বিকেলে গ্যাবায় কয়েক হাজার দর্শকের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসী উচ্ছ্বাস। অস্ট্রেলিয়া তখন জয় থেকে মাত্র ৯ রান দূরে। হ্যাজলউড যখন স্ট্রাইকে গেলেন, দর্শকসারি থেকে একজন বলে উঠলেন, ‘রিপিট বার্মিংহাম, হ্যাজল!’
গত বছর বার্মিংহামে এ রকম চাপে পড়েও এজবাস্টন টেস্ট ২ উইকেটে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু আজ ক্রিকেট–দেবতা যে ভিন্ন চিত্রনাট্য ভেবে রেখেছিলেন। শামার জোসেফের পরের বলেই উড়ে গেল হ্যাজলউডের স্টাম্প, গ্যাবার সোনালি আলোয় দুহাত মেলে উড়তে থাকলেন জোসেফও। সঙ্গে তাঁর বাকি ১০ সতীর্থও। ডাগআউট থেকে ছুটে এলেন অন্য ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়েরাও।
উসাইন বোল্টের গতির সেই দৌড় শেষ হলো ‘২০১ সেকশন’ গ্যালারির সামনে। সেখানে সেকশন ২০১–এর ২৪১ নম্বর সিট থেকে হাতে ছোঁয়া দূরত্বে দেখছিলাম ক্যারিবীয় উচ্ছ্বাস। অপ্রতিরোধ্য অস্ট্রেলিয়াকে তাদের দুর্গে হারিয়ে দিয়ে আলিঙ্গন করছিলেন ওয়ালশ-অ্যামব্রোসদের উত্তরসূরিরা। সেই উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা চলল বেশ কিছুক্ষণ। এরপর অপরাজিত স্মিথ ও শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হওয়া হ্যাজলউডকে সান্ত্বনা জানিয়ে শেষ হলো উদ্যাপনের প্রথম পর্ব।
আজ রোববার সকাল থেকেই ব্রিসবেনে বৃষ্টি। গতকাল ম্যাচের তৃতীয় দিন ছিল প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরম। ওই দিন যখন মাঠ ছেড়ে আসি, তখন অস্ট্রেলিয়ার রান ছিল ২ উইকেটে ৬০। জয়ের জন্য দরকার ১৫৬ রান। মাঠ থেকে ফেরার সময় কেন যেন মনে হচ্ছিল, ম্যাচটা জমতে পারে। তৃতীয় দিন শেষে রাতেই চতুর্থ দিনের টিকিট সংগ্রহ করলাম। ‘সেকশন ২০১’ একেবারে মাঠের কাছের গ্যালারি। কাছেই ড্রেসিংরুম, খুব কাছ থেকে তারকা খেলোয়াড়দের দেখা সুযোগ পাওয়া যায়।
আর ‘২০১ সেকশন’-এর এই গ্যালারি মিডিয়াকর্মীরাও ব্যবহার করেন। তাই বিরতির সময় সাবেক তারকা খেলোয়াড়দের খুব কাছে পাওয়া যায়। তৃতীয় দিনে কিংবদন্তি অস্ট্রেলিয়ান উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান অ্যাডাম গিলক্রিস্ট আমার দ্বিতীয় সন্তান আইজানের সঙ্গে হাই ফাইভ করলেন, হাত মেলালেন, ছবি তুললেন। শিহরণ জাগানো অনুভূতি। তাই গ্যাবায় টেস্টের চতুর্থ দিনের খেলা দেখার প্রবল ইচ্ছা ছিল। ভাবছিলাম, যদি দিনের শুরুতেই ২–১ উইকেট পড়ে যায়, ম্যাচটি জমবে। আর যেহেতু গোলাপি বলে দিবারাত্রি টেস্ট, তাই কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না। মনে হচ্ছিল, ক্যারিবীয় পেস আক্রমণে যেকোনো সময় অস্ট্রেলিয়ানরা ধসে পড়তে পারে।
আজ ভোর থেকে বৃষ্টি থাকলেও চতুর্থ দিনের খেলা সময়মতোই বেলা দুইটায় (স্থানীয় সময়) শুরু হয়। পরপর কয়েকটি উইকেটও পড়ল। আমি তখন ছুটির দিনের দাওয়াতে তারিঙ্গা নামের লোকালয়ে এক বাঙালি শিক্ষকের বাসায়। ১১৩ রানে ট্রাভিস হেড যখন আবার গোল্ডেন ডাক মারলেন, মনে হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচটি জিতবে।
দাওয়াত খাওয়া ছেড়ে ছুটলাম স্টেডিয়ামের দিকে। গাড়িতে যেতে যেতে স্কোরবোর্ডে নজর রাখছিলাম। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় খুব দ্রুত পৌঁছালাম স্টেডিয়ামে। গ্যাবায় পৌঁছে মিচেল স্টার্কের কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন শট দেখলাম। পাশে বসে থাকা এক বাচ্চা বলে উঠল, ‘স্টার্কি, ফিনিশ ইট!’
৪টি চার মেরে স্টার্ক ফিরলেন। নামলেন কামিন্স। গ্যালারিতে অন্য রকম উচ্ছ্বাস। অস্ট্রেলিয়ানরা অধিনায়ক কামিন্সকে যে বিশেষ সম্মান করেন, তা–ই প্রতিফলিত হলো গ্যালারিতে। কিন্তু কামিন্স পারলেন না, ২ রান করে জোসেফের শিকার হলেন।
নামলেন নাথান লায়ন। ওদিকে অবিচল স্টিভ স্মিথ। চতুর্থ ইনিংসে স্মিথের জমাট ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছিল, আর যা–ই হোক, এই ভদ্রলোক আউট হবেন না। স্মিথ-লায়ন জুটির সময় হলো ডিনার ব্রেক। বিরতি থেকে ফিরে ভালোই খেলছিলেন স্মিথ ও লায়ন। আলজারি জোসেফকে একটা চারও মারেন লায়ন। এরপর কিপারের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন। উত্তেজনার পারদ তখন সর্বোচ্চ চূড়ায়।
পরের ওভারের প্রথম বলেই স্মিথ অসাধারণ এক স্কুপে ছক্কা মারলেন। গ্যাবার কয়েক হাজার দর্শক তখন সবাই দাঁড়িয়ে। কেউ সিটে বসে নেই। জয় থেকে মাত্র ১৪ রান দূরে অজিরা। অটল পাহাড়ের মতো অবিচল থেকে শেষ চেষ্টা করেছেন স্মিথ। কিন্তু পারেননি। সতীর্থের ওপর আস্থা রেখে জোশেফের ওভারের ২টি বল খেলতে দিয়েছিলেন হ্যাজলউডকে। কিন্তু হ্যাজলউডের স্টাম্প উড়িয়ে নতুন ইতিহাস লিখেছেন জোসেফ।
ম্যাচ শেষে কমেন্ট্রি বক্স থেকে দ্রুত নেমে আসেন ব্রায়ান লারা ও ইয়ান বিশপ। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়ের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। গ্যালারি থেকে অবশ্য সেসব কথা শোনার সুযোগ ছিল না।
পুরস্কার বিতরণীর শেষে শামার জোসেফকে ডাকলাম মিনতি করে। কাছে এলেন, সেলফির আবদার মেটালেন। হাত মেলালেন। চলে গেলেন উদ্যাপন মঞ্চে। একটু পর নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে নিজে নিজে বললাম, অস্ট্রেলিয়াকে নিজেদের দুর্গে হারিয়ে দেওয়া এক ক্রিকেটারের সঙ্গে হাত মেলানোর সুযোগ হয়তো জীবনে একবারই আসে।
• রাহাত মিনহাজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।