ইমরান খান: হাসপাতালের জন্য ক্রিকেটে ফেরা, এরপর বিশ্বকাপ জয়

জাভেদ মিয়াঁদাদ ও ইমরান খান—পাকিস্তান ক্রিকেটের দুই কিংবদন্তি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ সাল সময়ে একসঙ্গে পাকিস্তান দলে খেলা এ দুই ক্রিকেটারের সম্পর্ক মাঠের বাইরেও গভীর ও জটিল। যে সম্পর্কের ধরন জানা যাবে মিয়াঁদাদের ‘কাটিং এজ: মাই অটোবায়োগ্রাফি’ বইটা পড়লে। পরপর দুটি অধ্যায়ে মিয়াঁদাদ লিখেছেন ইমরান সম্পর্কে অনেক কথা। ‘ইমরান অ্যান্ড আই’ নামে অধ্যায়ে মূলত প্রশংসা, ‘আ ডিফিকাল্ট রিটায়ারমেন্ট’ অধ্যায়ে তীব্র সমালোচনা। আজ পাঠকদের জন্য থাকছে মূলত প্রশংসার অংশটুকু।

‘ইমরান অ্যান্ড আই’ অধ্যায়ে কী লিখেছেন মিয়াঁদাদ

১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে জয় পাকিস্তানের জন্য এক গৌরবময় অর্জন। এটি ইমরান খানের সঙ্গে আমার দীর্ঘ সময়ের সম্পর্কের সেরা সাফল্যও।

আমার খেলোয়াড়ি জীবনে পাকিস্তানকে একটি বিশ্বমানের দলে পরিণত হতে দেখে আমি ভাগ্যবান। ইমরান ছাড়া এটি সম্ভব হতো না। একজন ক্রিকেটারের আত্মজীবনীতে অন্য একজন ক্রিকেটারকে নিয়ে একটি পুরো অধ্যায় উৎসর্গ করাটা অদ্ভুত মনে হতে পারে। কিন্তু ইমরান কোনো সাধারণ ক্রিকেটার নন, তিনি ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার। এই অধ্যায়ে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।

নিজের সেরা সময়ে ইমরান খান পাকিস্তান ক্রিকেটে শাসন করতেন। ছিলেন সেনাপতির মতো, যাঁর আদেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। এর পেছনে আংশিক কারণ ছিল তাঁর শিক্ষা, আচার-আচরণ এবং পারিবারিক নাম (তাঁর দুই চাচাতো ভাই মজিদ খান ও জাভেদ বুরকি পাকিস্তানের অধিনায়ক ছিলেন)। কিন্তু পাকিস্তান ক্রিকেটে তাঁর শক্তিশালী ভূমিকার আসল কারণ তিনি দলের অপরিহার্য বোলার ছিলেন।

পাকিস্তান সব সময়ই ভালো মানের ব্যাটসম্যান তৈরি করতে পারত, কিন্তু ভালো মানের বোলার, বিশেষ করে ফাস্ট বোলার মনে হতো শুধু ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকেই বের হবে। ইমরানই পাকিস্তানের প্রথম বোলার, যিনি শীর্ষস্থানীয় বোলারদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি শুধু তাঁর সময়ের সেরা একজন হিসেবেই বিবেচিত নন, ইতিহাসের সেরা বোলারদেরও একজন।
বিশ্বমানের ফাস্ট বোলার ছাড়া একটি প্রভাবশালী টেস্ট দল হওয়া সম্ভব নয়। বরং একটি দলে যত বেশি প্রথম সারির ফাস্ট বোলার থাকবে, বৈশ্বিক অঙ্গনে আধিপত্যের সম্ভাবনা তত বেশি বাড়বে।

ইমরান একজন নিখুঁত পেসার হিসেবে প্রথম স্বীকৃত হন ১৯৭৬-৭৭ সালে সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক জয়ের পর। এর অল্প পরেই তিনি কেরি প্যাকার্স ওয়ার্ল্ড সিরিজে বিশ্বের সেরা বোলারদের সঙ্গে টেক্কা দেন। সেখানে সব শীর্ষস্থানীয় ব্যাটসম্যানই তাঁর বলে ভুগেছেন।

এই সময়ে ইমরান বিশ্বের অন্যান্য ফাস্ট বোলারের সঙ্গে একটা গতির প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। ডেনিস লিলি, জেফ থমসন, মাইকেল হোল্ডিং, অ্যান্ডি রবার্টস, লে রু, মাইক প্রক্টর, কলিন ক্রফট ও জোয়েল গার্নারের মতো বোলারদের সঙ্গে লড়াই করে ইমরান হয়েছিলেন দ্বিতীয় দ্রুততম (প্রথম থমসন)। এই অভিনব এবং আকর্ষণীয় প্রতিযোগিতা ক্রিকেট বিশ্বে ইমরানকে একজন ব্যতিক্রমী ফাস্ট বোলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।  এতে ইমরানও আশ্বস্ত হন যে তিনি অন্যতম সেরা। পরবর্তী সময়ে এই আত্মবিশ্বাস কখনো কমেনি।

যখন ইমরান বিশ্বের অন্যতম সেরা ফাস্ট বোলার হিসেবে আবির্ভূত হলেন, তাঁর সঙ্গে পাকিস্তান ক্রিকেটের তারকাটাও উজ্জ্বল হলো। দলের ভেতরে, এমনকি পুরো দেশে ইমরানের গুরুত্ব দ্রুত বাড়তে থাকল।

ইমরান যখন পাকিস্তানের অধিনায়ক হলেন, তখন এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেন, যেখানে মাঝারি মানের পারফরম্যান্সের কোনো স্থান ছিল না। দলে জায়গা পাওয়া হয়ে গেল কঠোরভাবে পারফরম্যান্স-ভিত্তিক। প্রত্যেকেই দলে নিজেদের জায়গা হারানোর ভয়ে থাকত, যেটা আবার নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে খেলার জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবেও কাজ করত। নিজের সামর্থ্যে আত্মবিশ্বাসী থাকায় ইমরান কাউকে ভয় পেতেন না। যে কারণে খেলোয়াড় এবং ক্রিকেটের হর্তাকর্তারা তাঁকে আরও বেশি ভয় পেতেন।

জাভেদ মিয়াঁদাদ ও ইমরান খান।
জাভেদ মিয়াঁদাদের ইনস্টাগ্রাম পোস্ট থেকে

ইমরান ও আমি পাকিস্তানের হয়ে আমাদের সেরা সময়টা একসঙ্গে পার করেছি। তিনি বোলিংয়ের দায়িত্ব সামলাতেন এবং আমি ব্যাটিংয়ের। আমরা দুজনেই বহু বছর পাকিস্তানের অধিনায়কত্ব করেছি। পাকিস্তানে বলা হয়ে থাকে, ইমরান আর আমার সংমিশ্রণ পাকিস্তান ক্রিকেটে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই, এই ধরনের বিশ্লেষণ সম্পর্কে আমার পক্ষে বস্তুনিষ্ঠ হওয়া অসম্ভব। তবে আমি জানি যে ইমরানের মতো একজন সঙ্গী থাকায় আমি পাকিস্তানের জন্য যা করতে পেরেছি, তা একা কখনোই করতে পারতাম না। এটি আমার সৌভাগ্য। যখন আমি আমার ক্যারিয়ারের দিকে ফিরে তাকাই, তখন এটা ভেবে নিজেকে ভাগ্যবানই মনে হয় যে—আমি ইমরানের সঙ্গে একই সময়ে পাকিস্তানের হয়ে খেলেছি।

আমাকে প্রায়ই ইমরানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। পাকিস্তানের ক্রিকেট অনুসারীরা, সম্ভবত বিদেশিরাও এ বিষয়ে খুব কৌতূহলী। আমি নিজেকে কখনোই কোনোভাবে অপরিহার্য মনে করিনি। ইমরানের অধিনায়কত্বে আমি আমার কিছু সেরা ইনিংস খেলেছি। তিনি একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে আমার অবদানকে মূল্য দিতেন। আমিও প্রায়ই ইমরানকে বোলিং পরিবর্তন, ফিল্ডিং সাজানো, ব্যাটিং অর্ডার সম্পর্কে পরামর্শ দিতাম। তিনিও এই পরামর্শগুলোকে মূল্য দিতেন, শুনতেন।

আরও পড়ুন

ইমরান খান নিয়াজী পরিচয়ে ইমরানের জন্ম ২৫ নভেম্বর ১৯৫২ সালে লাহোরে। তিনি বেড়ে উঠেছেন একটি উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে। ক্রিকেটের সংস্পর্শে এসেছেন খুব অল্প বয়সে। লাহোরের জামান পার্কে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে খেলতেন। পরে ইংলিশ-ধারার পাবলিক স্কুল আইচিসন কলেজেও খেলেছেন।

হাইস্কুলে পড়ার সময়ই ইমরান ইংল্যান্ড চলে যান, আর সেই সময় তাঁর ক্রিকেটের ভিতটা তৈরি হয়। গড়ে ওঠার সময়টায় উস্টারশায়ার কাউন্টি ক্লাব আর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে খেলেছেন।

ইমরান যে একজন দুর্দান্ত ক্রিকেটারে পরিণত হতে পেরেছেন, সেটা সম্ভব হয়েছে ইংল্যান্ডে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহারের কারণে। নিবিড়ভাবে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। শুরু থেকেই প্রতিভাবান ছিলেন, এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল ইংল্যান্ডে এই প্রতিভাকে অধ্যবসায়, মনোযোগ এবং বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তোলায়। তিনি খেলা এবং ক্রিকেটের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে সব দরকারি জিনিসই শিখেছিলেন, সে সময়ে যা শুধু ইংল্যান্ডেই শেখা সম্ভব ছিল।

খেলোয়াড়ি জীবনের শুরুর দিকেই ইমরান নিজের জন্য কঠোর শারীরিক অনুশীলনের একটা রুটিন তৈরি করে নিয়েছিলেন, যা বাকি জীবনও অনুসরণ করে গেছেন। প্রতিদিন দৌড়াতেন, ৬ থেকে ৮ ওভার টানা বোলিং করে যেতেন।

জাভেদ মিয়াঁদাদ ও ইমরান খান যখন ব্যাটিংয়ে।
জাভেদ মিয়াঁদাদের ইনস্টাগ্রাম পোস্ট থেকে

কোনো ব্যাটসম্যানকে বোলিং করতেন না। একটা পপিং ক্রিজ আর ২২ গজে একটা স্টাম্প। যখন বোলিং অনুশীলন করতেন, তাঁর দুনিয়ায় অন্য কিছুই থাকত না।  

সেই দিনগুলোতে, ১৯৯০-এর দশকে এবং তার পরে যে কোচিং সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা ছিল না। (অনুশীলন) দেখভাল করে গাইডলাইন দেওয়ার মতো তেমন কেউ থাকত না। নিজের কাজটা নিজেকেই করতে হতো। ইমরান তাঁর নিজের লেখায় ক্রিকেট শেখার এই দিকটির কথা খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে লেখেননি। তবে এটা মানতেই হবে যে তিনি মূলত নিজেকে নিজেই শিখিয়েছিলেন। তাঁর নিজের শারীরিক ক্ষমতা এবং মানসিক দক্ষতার প্রতি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ‍ছিল, যেটা তাঁকে দারুণ ফল দিয়েছে।

কোনো কিছুতে বিশ্বমানের হয়ে উঠতে নিজেকে শেখানোর জন্য খুব শক্তিশালী মনের প্রয়োজন হয়। ইমরানের ব্যক্তিত্বের এই দিকটি মাঝেমধ্যে ‘অহংকার’ বলে ভুল করা হয়, তবে এটি আসলে মনের শক্তি।

ইমরান ১৯৭১ সালে ১৮ বছর বয়সে পাকিস্তান দলের সঙ্গে ইংল্যান্ড সফরে যান। সেই সফরের পর তিনি ইংল্যান্ডের উস্টারশায়ার গ্রামার স্কুলে পড়ার জন্য থেকে যান। এখান থেকেই তাঁর ইংল্যান্ডে ক্রিকেট শেখার শুরু। যদি তিনি ১৯৭১ সালের সেই সফরের শেষে পাকিস্তানে ফিরে আসতেন, তাহলে যে মানের ক্রিকেটার হয়ে উঠেছিলেন, তার কাছাকাছিও যেতে পারতেন না। হাইস্কুল পাস করে ইমরান অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে যান। ইমরানের ক্রিকেট উন্নয়নে অক্সফোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

আরও পড়ুন

অক্সফোর্ডের পর ইমরান ‍উস্টারশায়ার কাউন্টিতে খেলা শুরু করেন। সেখান থেকে যান সাসেক্সে। এই দলে দুই মৌসুম আমি ইমরানের সতীর্থ ছিলাম। আমরা হোভে আলাদা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম, কিন্তু অনেক সময় একসঙ্গে কাটাতাম, ঘুরতে যেতাম। তত দিনে আমরা একসঙ্গে পাকিস্তানের হয়েও খেলে ফেলেছি। তবে সাসেক্সে খেলার সময়ই ইমরানের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব শুরু হয়। সেটা ১৯৭৭ সালের দিকের সময়।

সাসেক্সে আমি জন স্নোর মতো ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ফাস্ট বোলারের তত্ত্বাবধানে ইমরানকে পরিণত হতে দেখেছি। এ সময় তাঁর বলে ছিল ভয়ংকর গতি, কাউন্টিতে বেশ নাম ছড়িয়ে পড়ে।

এই সময়ের আশপাশে ইমরান রিভার্স সুইংয়ের কৌশল রপ্ত করেন, যা পরের সময়গুলোয় তাঁকে অনেক উইকেট এনে দিয়েছে।

গতি, চাতুর্য এবং রিভার্স সুইংয়ের সংমিশ্রণ ইমরানকে মারাত্মক বোলার করে তুলেছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে কোন বলে উইকেট আসবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে শুরু করলেন ইমরান। যখন টেল এন্ডারের ব্যাটিং শুরু হতো, বলেকয়ে উইকেট নিতেন। আমাদের প্রায়ই বলতেন যে তিনি ব্যাটসম্যানের একটি দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছেন এবং কীভাবে তিনি পরের বলেই তাকে আউট করবেন। গতি এবং নিয়ন্ত্রণে এতটাই ভালো হয়ে উঠেছিলেন যে, সেটা করতেনও।

ইমরান কখনোই তাঁর অর্জন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাই একজন বোলার হিসেবে তিনি থেমে থাকেননি। ফাস্ট বোলিংয়ে দক্ষতা অর্জনের পর তিনি ব্যাটিংয়ের দিকে মনোযোগ দেন। এ জায়গাতেও কাউন্টি ক্রিকেট তাঁর জন্য পাঠশালা হয়ে ওঠে। সাসেক্সের হয়ে লোয়ার অর্ডারে ব্যাটিং শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যে নির্ভরশীল ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠেনও।

মাঠের বাইরেও দুজনের বন্ধন ছিল ঘনিষ্ঠ।
জাভেদ মিয়াঁদাদের ইনস্টাগ্রাম পোস্ট থেকে

আমি এই বইয়ের অন্য এক জায়গায় (অধ্যায় ২২) বলেছি ইমরান তাঁর সময়ের সেরা অলরাউন্ডার হয়েছিলেন। এটা অনেক বড় কথা, যখন মাথায় রাখবেন যে সমসাময়িকদের মধ্যে কপিল দেব, রিচার্ড হ্যাডলি ও ইয়ান বোথামরা ছিলেন। ইমরান ছিলেন তাঁদের মধ্যে সেরা ব্যাটসম্যান এবং যেকোনো বোলারের মতোই ভালো বোলার। তিনি সবচেয়ে সফল অধিনায়কও ছিলেন।

ব্রিটিশ মিডিয়া বোথামকে অলরাউন্ডারদের মধ্যে সেরা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, কিন্তু তারা ভুল। স্লিপ ক্যাচিংয়ের সামান্য ব্যতিক্রম বাদে ক্রিকেটের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইমরান বোথামের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন।

ইমরান তাঁর ক্যারিয়ার শেষ করেন ৩৬২ টেস্ট উইকেট নিয়ে। ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে শিনের স্ট্রেস ফ্র্যাকচারের কারণে কয়েক বছর বোলিং মিস না করলে কত উইকেট শিকার করতেন, কে জানে।

ইমরানের চোট পাকিস্তান দল এবং পাকিস্তানের ক্রিকেট সমর্থকদের জন্য ছিল বড় হতাশার। তবে ভেবে দেখুন তো, এটি ইমরানের নিজের ওপর কী প্রভাব ফেলেছিল। তিনি তাঁর সেরা সময়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বছর থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। তবে ইমরান একজন যোদ্ধা। তিনি তাঁর দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি দিয়ে এটিকে কাটিয়ে উঠেছিলেন।

ইমরান এমন একজন ব্যক্তি, যিনি কখনোই হাল ছাড়েন না। যখন আমরা ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ খেলতে অস্ট্রেলিয়ায় যাই, তখন তাঁর কাঁধে চোট। ‍তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন একজন বোলার হিসেবে সেরাটা দিতে না পারলেও একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে লড়াই করবেন এবং পারফর্ম করবেন। শেষ পযন্ত সেটা করেছেনও। যদি তিনি ফাইনালে আমার সঙ্গে অন্য প্রান্তে ব্যাটিং না করতেন, আমরা জিততাম কি না সন্দেহ।

১৯৯২ বিশ্বকাপজয়ের পর ড্রেসিংরুমে।
‘‘কাটিং এজ: মাই অটোবায়োগ্রাফি’ বই থেকে

ইমরান ছিলেন পাকিস্তানের খুব সফল অধিনায়ক, একই সঙ্গে ভাগ্যবান অধিনায়কও। ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন এবং সফলও হতেন। অধিনায়ক হিসেবে ছিলেন খুব কঠোর। তাঁর সবার প্রতি, এমনকি নিজের প্রতিও উচ্চ প্রত্যাশা ছিল। আর সেই প্রত্যাশা না মেটাতে পারলে সরাসরি বলতে দ্বিধা করতেন না।

একজন ভালো পারফর্মারের জন্য তাঁর প্রিয় শব্দ ছিল ‘টাইগার’। এই শব্দটা খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করত, উজ্জীবিত করত। প্রত্যেকে ইমরানের জন্য ‘টাইগার’ হতে চাইত। তিনি খোলামেলাভাবে সমালোচনা করতেন। খেলোয়াড়দের তিরস্কার করার এমন একটি ধরন ছিল যে তারা এটিকে ইতিবাচকভাবে নিত। তাদের মন খারাপ বা বিষণ্ণ করার পরিবর্তে ইমরানের তিরস্কার আরও ভালো করতে উৎসাহিত করত। এটি একজন অধিনায়কের জন্য অত্যন্ত কার্যকর উপহার বলব আমি।

আমি সামগ্রিকভাবে মনে করি, ইমরান খেলোয়াড়দের যোগ্যতার একজন ভালো বিচারক ছিলেন। কখনো কখনো তিনি একজন খেলোয়াড়ের মধ্যে বিশেষ কিছু দেখলে তাঁকে সমর্থন দিতেন, সামনে এগিয়ে রাখতেন। এমনকি ব্যর্থ হওয়ার পরও আগলে রাখতেন। এর একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ব্যাটসম্যান মনসুর আখতার। হতাশাজনক পারফরম্যান্সের পরও মনসুরকে টেস্ট দলে রাখতেন ইমরান। এমন একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে মনসুরের প্রতি ইমরানের অযৌক্তিক সমর্থন ছিল। ইমরানের ব্যক্তিত্বে একধরনের একগুঁয়েমি আছে বলেই এমন করেছিলেন।

এ বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলব, ইমরান তাঁর কৌশলে ঠিকই ছিলেন। মনসুর খুব ভালো খেলোয়াড় ছিল, ওকে সুযোগ করে দেওয়াটা ভালো সিদ্ধান্ত। মনসুর যে পুরোপুরি ক্লিক করতে পারেনি, তা দুর্ভাগ্য, তবে পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন হওয়ার সব উপাদানই তার মধ্যে ছিল।

আরও পড়ুন

অধিনায়কত্ব ইমরানের মধ্যে পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কঠোরতাও নিয়ে এসেছিল। একজন খেলোয়াড় সম্পর্কে একটি মতামতে পৌঁছাতে সময় নিতেন, কিন্তু একবার তিনি তা করে ফেললে নড়ানো খুব কঠিন ছিল। এমন কিছু খেলোয়াড় আছে, যাঁরা মনে করেন যে ইমরানের অনুগ্রহ লাভ করতে না পারার কারণে তাঁদের ক্যারিয়ার অকালে শেষ হয়ে গেছে। ইমরানের অবশ্যই এই নেতিবাচক দিকটি ছিল—যদি তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন যে আপনার মধ্যে কোনো ঘাটতি আছে, তাঁর মতামত পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব ছিল।

তবে একজন অধিনায়ক হিসেবে ইমরানের যে ত্রুটিই থাকুক না কেন, সেটা নিয়ে তেমন প্রশ্নই ওঠেনি। কারণ, তাঁর অধীনে দল নতুন উচ্চতায় উঠছিল। আর যে ফর্মুলায় দল ভালো করে, সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেও না। মাঝেমধ্যে আমিও ইমরানের এই একগুঁয়ে দিকটির সম্মুখীন হতাম। এমন কিছু ঘটনা ছিল, যখন আমি মনে করতাম ইমরান ভুল করছেন এবং আমি ভয় পেতাম যে তাঁর একগুঁয়েমির কারণে আমরা ম্যাচ হারতে চলেছি। আমি জানতাম আমাকে আমার মতো করে চলতে হবে। চলতামও।

একটি প্রশ্ন যা, বারবার আসে যে ইমরান এবং আমার মধ্যে পেশাগত ঈর্ষার কোনো উপাদান ছিল কি না। আমার মতে, এটা বোকামো প্রশ্ন। ঈর্ষা কীভাবে না থাকে? আমরা দুজনেই পারফর্মার ছিলাম, যারা সব সময় আরও ভালো করতে উদগ্রীব। একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব অনুভব করা স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে এই পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু পেশার মধ্যেই ছিল, এর বেশি কিছু ছিল না। আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কেও কোনো প্রভাব পড়েনি। আমি এ বিষয়ে সব সময়ই সচেতন ছিলাম, যত দূর জানি ইমরানও সতর্ক ছিলেন।

অবশ্যই ইমরানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গুজব আছে। এটিকে বিভিন্নভাবে ‘কঠিন’, ‘ঝোড়ো’, ‘সমস্যাযুক্ত’, এমনকি ‘কাঁটাময়’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, সংবাদপত্র এবং ট্যাবলয়েডগুলো সব সময় এই বিষয়ে আমার চেয়ে বেশি জানে বলে মনে হয়েছে। সত্য হলো, ইমরান এবং আমি সব সময় ভালো সম্পর্কের মধ্যেই ছিলাম। হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে। কিন্তু সেই মতবিরোধ আমাদের ব্যক্তিগত পারস্পরিক যোগাযোগকে প্রভাবিত করেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পার্থক্যগুলো হয় সমাধান হয়েছে অথবা একপাশে সরিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে।

খেলোয়াড়ি জীবনের শেষে জাভেদ–ইমরান যখন একসঙ্গে।
জাভেদ মিয়াঁদাদের ইনস্টাগ্রাম পোস্ট থেকে

ইমরান তাঁর অবসরের পর প্রয়াত মায়ের স্মরণে লাহোরে ক্যানসার হাসপাতাল তৈরির কাজে মনোযোগ দিয়েছিলেন। শওকত খানম মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতাল এবং গবেষণা কেন্দ্র এখন পাকিস্তানের একটি শীর্ষস্থানীয় ক্যানসার পরিচর্যা কেন্দ্র। প্রতিশ্রুতি অনুসারে এই হাসপাতাল যেসব রোগী টাকা দিতে পারে না, তাদের ফেরায় না।

ইমরান ১৯৮৭ বিশ্বকাপে ব্যর্থ অভিযানের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার কাছে সেমিফাইনালে হারের পর বেশ হতাশা পেয়ে বসেছিল তাঁকে। তবে এই ‘অবসর’ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৮৭-৮৮ মৌসুমের শেষ দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিতে তিনি আবার খেলায় ফেরেন। ইমরানের অবসর নেওয়া ঠিকও ছিল না, কারণ তখনো তাঁর দেওয়ার অনেক কিছু ছিল। তবে আমার এটাও মনে হয় যে ইমরানের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার কারণ ছিল ক্যানসার হাসপাতাল প্রকল্পের জন্য তহবিল সংগ্রহ করা।

সেটা কাজেও লেগেছে। ক্রিকেটে সক্রিয় থাকায় ইমরানের জনপ্রিয়তাও বজায় ছিল, যা তহবিল সংগ্রহে কাজে লেগেছে। দলের বাকি খেলোয়াড়দের সহযোগিতাও তিনি পেয়েছিলেন।

বস্তুত ইমরান খানের ক্যানসার হাসপাতাল গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বড় অবদান ছিল। আমাদের দল সব ধরনের পুরস্কারের অর্থ, দলীয় পুরস্কার এবং ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত নগদ অর্থ হাসপাতালে দান করে দিতেন। একবার একজন খেলোয়াড় একটি গাড়ি পুরস্কার পেয়েছিল, ওটাও হাসপাতালকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন

আমাদের অনেকেই সরাসরি তহবিল সংগ্রহে সাহায্য করেছিলাম। আমি এই মহৎ উদ্দেশ্য পূরণে আমার অংশটুকু করার চেষ্টা করেছি এবং অনেক সম্পদশালী ব্যক্তিকে এই প্রকল্পে উদারভাবে সমর্থন করার জন্য রাজি করাতে পেরেছিলাম।

সংবাদপত্রে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল যে দলকে তাদের পুরস্কারের অর্থ ইমরানকে দিতে বাধ্য করা হয়েছে। তবে এটা ঠিক নয়। হ্যাঁ, ইমরানের ব্যক্তিত্বের শক্তি খেলোয়াড়দের দান করতে উৎসাহিত করার একটা কারণ ছিল। তবে একটি ক্যানসার হাসপাতাল গড়ার মূল্য এবং নৈতিক মর্যাদা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। পুরস্কারের অর্থ সবার সম্মতিতে দান করা হতো। কোনো জোরজবরদস্তি ছিল না।

অনেক সময় পুরস্কারের অর্থ জেতার আগেই হাসপাতালের জন্য দিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করা হতো। আমরা মনে করতাম যদি পুরস্কারের অর্থ ইতিমধ্যেই একটি দাতব্য ও মহৎ কাজের জন্য মান্নত করা হয়, তাহলে আল্লাহ আমাদের জয় এনে দেবেন।

ক্যানসার হাসপাতাল স্থাপনের পর ইমরান পাকিস্তানের জাতিগত সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টায় হাত দেন। রাজনীতিতে নেমে তেহরিক-ই-ইনসাফ বা মুভমেন্ট ফর জাস্টিস দল গঠন করে পাকিস্তানের সংসদে নির্বাচিতও হয়েছেন। আমি রাজনীতিতে ইমরানের সর্বাত্মক সাফল্য কামনা করি, কারণ আল্লাহ জানেন, পাকিস্তানের একজন একজন সৎ রাজনীতিবিদ কত দরকার। তবে দল গঠনের কয়েক বছর পর যখন আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি, তখন তিনি আমাকে ব্যক্তিগত পরামর্শ হিসেবে বলেছিলেন, যেন রাজনীতিতে কখনোই না যাই।

ব্যক্তিগতভাবে ইমরান রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন জেনে আমি অবাক হয়েছিলাম। তাঁকে সব সময় রাজনীতি এড়িয়ে চলতে দেখেছি। আমি কখনোই ভাবিনি যে এটি তাঁর পেশা হবে।

ইমরান এবং আমি, দুজনেই পাকিস্তানের কাছে আমাদের ক্যারিয়ারের জন্য কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ, যা কখনো শোধ করা যাবে না। পাকিস্তান আমাকে যা দিয়েছে, তাতে আমি কৃতজ্ঞ, আমি নিশ্চিত ইমরানও একই রকম অনুভব করেন, কারণ পাকিস্তান তাঁকেও কম কিছু দেয়নি।

ইমরান ক্রিকেটে একটি বিখ্যাত নাম, এটি একটি অক্ষয় নামও। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো কেলেঙ্কারি বা কোনো অসৎ কার্যকলাপের অভিযোগ নেই। একেবারে নিষ্কলঙ্ক নির্ভেজাল এবং দাগহীন ক্যারিয়ার। এই খ্যাতি ইমরানকে পাকিস্তানের একজন মহান দূতে পরিণত করেছে।  নিজের জীবনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের মাধ্যমে দেশের নামকে মহিমান্বিত করা, এর চেয়ে বড় অর্জন আর কী হতে পারে!

*ঈষৎ সংক্ষেপিত

পাঠকের জন্য তথ্য

ইমরান ও মিয়াঁদাদ এখন দুই ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। ইমরান খান ২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন, ২০২২ সালে হন ক্ষমতাচ্যুতও। এখন তাঁর জীবন কাটছে কারাগারে, আছে মামলার চক্কর, হয়েছেন দণ্ডিতও। আর ‘বড়ে মিয়া’খ্যাত মিয়াঁদাদ এখনো ক্রিকেটেই আছেন—ধারাভাষ্য দেন, বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করেন। খেলা ছাড়ার পর দুজন দুই দুনিয়ায় পা রাখলেও বিভিন্ন সময়ে মিয়াঁদাদের কথায় ইমরান উঠে এসেছেন। যেমন ২০২০ সালে ইমরানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ক্রিকেট ধ্বংসের অভিযোগ করেছেন মিয়াঁদাদ (ওয়াসিম খানকে বিদেশ থেকে এনে পিসিবির দায়িত্ব দেওয়ার সমালোচনায়), আবার ২০২৩ সালে বলেছিলেন, ইমরান তাঁর কথা শুনলে ক্ষমতাচ্যুত হতেন না। অন্য এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ইমরান ন্যায়বিচার পাবেন বলে তিনি আশাবাদী। সমালোচনা বা সহানুভূতি—যেভাবেই নাম আসুক, পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসে ‘ইমরান ও মিয়াঁদাদ’ যুগল একটি সময়ের স্মারক হয়ে থাকবে সব সময়ের জন্য।