ভারত–পাকিস্তান লড়াই: একসময় আগুন জ্বলত, এখন শুধু ধোঁয়া

কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার ঘটনায় ভারতীয় সমর্থকদের ক্ষোভ ও এশিয়া কাপ ঘিরে মোটা অঙ্কের টাকার খেল যদি না থাকত, তাহলে ভারত–পাকিস্তান ম্যাচে সেই পুরোনো উত্তাপ ফিরত না।

দুবাইয়ে গতকাল এশিয়া কাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছে ভারত–পাকিস্তানছবি: এএফপি

ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেটীয় সম্পর্ক সব সময়ই দুই দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কৌশল অনুযায়ী এগিয়েছে।

অতীতেও দ্বিপক্ষীয় সিরিজে লম্বা বিরতি দেখা গেছে। ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৮—টানা ২৪ বছর পাকিস্তান সফরে যায়নি ভারত। আবার ১৯৬০ সালের পর পাকিস্তানও প্রথমবারের মতো ভারতে খেলতে যায় ১৯৭৯ সালে।

এরপর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান নিয়মিত মুখোমুখি হয়েছে। এই সময়ে ভারত তিনবার পাকিস্তান সফরে গিয়ে খেলে ১২ টেস্ট, পাকিস্তানও ভারতে গিয়ে খেলে ৮ টেস্ট।

দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৯ সালে পাকিস্তান তিন টেস্ট খেলতে ভারতে যায়। এর মধ্যে একটি ছিল কলকাতার ইডেন গার্ডেনে প্রথম এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। ভারত ফিরতি টেস্ট সিরিজ খেলতে পাকিস্তানে যায় ২০০৪ সালে, যা ছিল ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শচীন টেন্ডুলকারের অভিষেকের পর প্রথমবার।

২০০৪ সালের পাকিস্তান সফরে কড়া নিরাপত্তায় ব্যাটিংয়ে নামেন শচীন টেন্ডুলকার
ছবি: এক্স

তারপর শুরু হয় এক উন্মাদনা—চার বছরে চারটি তিন টেস্টের সিরিজ, দুই দেশেই সমান ম্যাচ। কিন্তু ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ভারতের মাটিতে পাকিস্তান সিরিজ জেতার পর থেকে দুই দল আর কোনো টেস্ট খেলেনি।

সর্বশেষ দ্বিপক্ষীয় সিরিজ হয়েছিল ভারতে, সেই ২০১২-১৩ সালে। মিসবাহ উল হক, শহীদ আফ্রিদি, উমর গুল, মোহাম্মদ হাফিজদের পাকিস্তান তিনটি ওয়ানডে ও দুটি টি-টোয়েন্টি খেলতে গিয়েছিল।

এর পর থেকে ভারত-পাকিস্তানের একটা ম্যাচ দেখতে ক্রিকেটপ্রেমীদের চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতে হয়েছে। রাজনৈতিক বৈরিতায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের লড়াই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে বৈশ্বিক ও মহাদেশীয় টুর্নামেন্টে। আরও স্পষ্ট করে বললে, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আর এশিয়া কাপ ছাড়া দুই দল মুখোমুখি হয় না।

আরও পড়ুন

একসময় ভারত-পাকিস্তান প্রায় সমশক্তির দল ছিল। ২০১২-১৩ সালে সর্বশেষ দ্বিপক্ষীয় সিরিজেই পাকিস্তান ২-১ ব্যবধানে ওয়ানডে সিরিজ জিতেছিল, টি-টোয়েন্টি সিরিজ শেষ হয়েছিল ১-১ সমতায়। কিন্তু এর পর থেকে ভারত শুধু উন্নতিই করেছে আর পাকিস্তানের পারফরম্যান্সের গ্রাফ নিচে নেমেছে।

১৯৯০-এর দশক আর এই শতাব্দীর শুরু দিকে ভারতের দুর্দান্ত ব্যাটিং লাইন আপ আর পাকিস্তানের ভয়ংকর বোলিং আক্রমণের মধ্যে লড়াই জমে উঠত।

একসময় শচীন টেন্ডুলকারের সঙ্গে শোয়েব আখতারের ঝাঁজালো লড়াই হতো
ছবি: এএফপি

মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলী, রাহুল দ্রাবিড়দের সঙ্গে ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, সাকলায়েন মুশতাক...পরবর্তীতে বীরেন্দর শেবাগ, ভিভিএস লক্ষ্ণণদের সঙ্গে শোয়েব আখতার আর আবদুল রাজ্জাক। বিশেষ করে শারজায় পাকিস্তান রাজত্ব করত, অন্য জায়গায় ভারতও জিতত।

যদিও ভারত ওয়ানডে বিশ্বকাপে যতবার পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছে, ততবারই জিতেছে। কিন্তু তখনো দুই দল সমানে–সমান ছিল। ম্যাচ জেতার জন্য মাঝে মাঝে একক কোনো অসাধারণ ইনিংস বা দুর্ধর্ষ এক স্পেল যথেষ্ট ছিল। কোনো ম্যাচে এক তরফা জয় মানেই এমনটা মনে হতো না যে, পরের ম্যাচেও সেই দল দাপট দেখাবে বা হেসেখেলে জিতবে।

ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রতিবারই পাকিস্তানকে হারিয়েছে ভারত
ছবি: আইসিসি

কিন্তু দৃশ্যপট এখন পুরোপুরি পাল্টে গেছে। বর্তমানে ভারত ক্রিকেটের ‘পাওয়ার হাউস’ আর প্রায়ই ধুঁকতে থাকা পাকিস্তান যেন টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে। একসময় যে লড়াইয়ে আগুন জ্বলত, এখন সেখানে শুধু ধোঁয়া!

আরও পড়ুন

প্রশ্ন হলো—পাকিস্তানের ক্রিকেট হঠাৎ এতটা পিছিয়ে পড়ল কেন?

ক্রিকেটে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর ব্যাপার তো আছেই; সবচেয়ে বড় কারণে ২০০৯ সালে লাহোরে শ্রীলঙ্কান দলের ওপর হামলা। এরপর পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দীর্ঘদিনের জন্য নির্বাসনে চলে যায়। নিরাপত্তার শঙ্কায় কোনো দলই দেশটিতে খেলতে যায়নি। এতে পাকিস্তানে ক্রিকেটের অগ্রগতিও থমকে খায়, যা তাদের জন্য বিশাল এক ধাক্কা হয়ে আসে।

২০০৯ সালে লাহোরে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বন্ধ হয়ে যায়
ছবি: এক্স

অর্ধযুগ বিরতির পর ২০১৫ সালে জিম্বাবুয়ের সফর দিয়ে পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেরে। তবে বড় কোনো দল (দক্ষিণ আফ্রিকা) পাকিস্তান সফরে যায় আরও ছয় বছর পর, ২০২১ সালে।

দেশের মাটিতে লম্বা সময় শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্রিকেট খেলতে না পারাতেই পাকিস্তান খুব বেশি বিশ্বমানের ক্রিকেটার তৈরি করতে পারেনি। এ কারণেই দলটি ধারাবাহিকভাবে ভালো করতে পারছে না এবং বড় দলের বিপক্ষে প্রায়ই মুখ থুবড়ে পড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

দুবাইয়ে গত রাতে ভারতের বিপক্ষে এশিয়া কাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচই যার অকাট্য প্রমাণ। সালমান আগা-ফখর জামান-শাহিন আফ্রিদিদের দেওয়া ১২৮ রানের লক্ষ্য ৭ উইকেট ও ২৫ বল হাতে রেখে টপকে গেছে সূর্যকুমার যাদবের দল, যা দুই দলের মান ও শক্তির ব্যবধান আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে।

অবশ্য এই ম্যাচের কয়দিন আগেই দুই দেশের ক্রিকেট বিশ্লেষকেরা মানতে বাধ্য হয়েছিলেন ভারত এখন অনেক বেশি শক্তিশালী ও পরিপূর্ণ দল। তাই পাকিস্তান যদি কাল জিতত, সেটাকে অঘটন বিবেচনা করা হতো।

ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্স দেখে হতাশ সমর্থকেরা। কাল রাতে ইসলামাবাদে
ছবি: এএফপি

কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার ঘটনায় ভারতীয় সমর্থকদের ক্ষোভ ও এশিয়া কাপ ঘিরে মোটা অঙ্কের টাকার খেল যদি না থাকত, তাহলে ভারত–পাকিস্তানের এই ম্যাচেও পুরোনো উত্তাপ ফিরত না।

আরও পড়ুন

মোটকথা, একসময়ের ‘সোনার হাঁস’ ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ এখন আর মাঠের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য নয়; বরং প্রচারণা, ক্রিকেটের বাজারজাতকরণ আর বাণিজ্যিক স্বার্থে আলোচিত হয়। হাইপে ভরপুর হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভাবলেশশূন্য!