পরিকল্পনা ও বড় জুটির অভাবে হার বাংলাদেশের

লিটনের আউটের পর নিউজিল্যান্ডের উদ্‌যাপনএএফপি

যদি বলা হয় ম্যাচটা তো নিউজিল্যান্ড ২৩৯ রান করে ফেলার পরই শেষ, খুব কি ভুল বলা হবে? একটু বোধ হয় ভুলই। ৯২ রানে ৪ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও ২০০ রান তো করেছে বাংলাদেশ। খারাপ কী!

শেষে এসে স্কোরটা দেখে একটু সান্ত্বনা হয়তো পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ৩০ ওভারের ম্যাচে ২৪৫ রান করে জিততে যে ব্যাটিংটা শুরু থেকে দরকার ছিল, ডানেডিনের প্রথম ওয়ানডেতে আজ সেটা কি করতে পারল বাংলাদেশ?

বৃষ্টিতে বারবার থেমেছে খেলা। পরিস্থিতি বুঝে নিউজিল্যান্ডের ওপেনার উইল ইয়াং আর অধিনায়ক টম ল্যাথাম অনেকটা হিসেব করেই বেহিসেবি ব্যাটিং করলেন। বৃষ্টির কারণে খেলা শুরু হয়েছিল ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট দেরিতে। এরপর দুটি মোটামুটি লম্বা বৃষ্টি বিরতির পর ৩০ ওভারে নেমে আসা ম্যাচেও তাই নিউজিল্যান্ডের রান ৭ উইকেটে ২৩৯। ওই কন্ডিশনে বাংলাদেশের জন্য ডিএলএস পদ্ধতিতে দাঁড়ানো ২৪৫ রানের লক্ষ্য স্পর্শ করাটা কঠিনই ছিল।

আরও পড়ুন

সেই কঠিনকে সহজ করারও কোনো পরিকল্পনা দেখা গেল না বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে। শুরুর দিকের ব্যাটসম্যানরা উইকেটে এলেন আর গেলেন। লম্বা ইনিংস নেই, বড় জুটি হয়নি। ১০৩ রানে ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর এই ম্যাচ থেকে আসলে আর বেশি কিছু আশা করারও ছিল না। ষষ্ঠ উইকেটে তাওহিদ হৃদয় আর আফিফ হোসেনের ৫৬ রানের জুটিতে ম্যাচের সময়টাই কেবল দীর্ঘায়িত হলো।

নিউজিল্যান্ড সিরিজের দলে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে ফিরেছেন সৌম্য সরকার। তাঁর সামর্থ্যের কথা ভেবে অবশ্য একটা আশাও ছিল—ওই কন্ডিশনে হয়তো দেখা যাবে পুরোনো সৌম্যকে। না, দেখা গেল না কোনোভাবেই। বল হাতে ৬ ওভারে ৬৩ রান দিয়ে উইকেট শূন্য। তার চেয়েও হতাশার এনামুল হক বিজয়ের সঙ্গে ইনিংস শুরু করতে নেমে তাঁর প্রথম ওভারেই দ্বিধান্বিত শট খেলে আউট হয়ে যাওয়া। ইনিংসের চতুর্থ বলে অ্যাডাম মিলনের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাট লাগিয়ে সেকেন্ড স্লিপে ক্যাচ, দলের রান তখন মাত্র ১।

ল্যাথাম–ইয়াং জুটিতেই বড় সংগ্রহ পেয়েছে নিউজিল্যান্ড
এএফপি

সপ্তম ওভারে ইশ সোধির বলে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন বোল্ড হয়ে গেলেন রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে। ওই শটটা তখন খেলার খুব দরকার ছিল কি না নাজমুলই ভালো বলতে পারবেন। তবে পরিণতি যে ভালো হয়নি সেটা তো সবাই-ই দেখেছেন।
শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিং করা এনামুল ব্যক্তিগত ৮ রানে আউট হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের উইকেটকিপার টম ব্লান্ডেল গ্লাভসে বল রাখতে না পারায়। সেই এনামুলও ফিরলেন ৪৩ রান করে অভিষিক্ত পেসার জশ ক্লার্কসনকে তাঁরই হাতে প্রথম আন্তর্জাতিক উইকেট উপহার দিয়ে।

আরও পড়ুন

লিটন দাস ক্লার্কসনেরই আরেকটা বলে খেলবেন কি খেলবেন না করে গ্লাভসে বল লাগিয়ে কট বিহাইন্ড, মুশফিকুর রহিমও কট বিহাইন্ড রাচিন রবীন্দ্রকে রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে। এভাবে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসার খেলায় মাতলে আর যাই হোক ৩০ ওভারে ২৪৫ করতে পারার কথা নয়। বাংলাদেশ তা করেওনি। তাওহিদ আর আফিফের কিছু ভালো শট এবং দুটি মাঝারি ইনিংসের সুবাদে ৯ উইকেটে ঠিক ২০০ করেছে বাংলাদেশ। ভালো শুরু পাওয়া ব্যাটসম্যানদের অন্তত কেউ একজন যদি পারতেন নিজের ইনিংসটা লম্বা করতে, ম্যাচের ফলাফল অন্যরকম হতেও পারত।

অথচ কী দারুণভাবেই না শুরু হয়েছিল ম্যাচটা! বৃষ্টি ভেজা কন্ডিশনে টসে জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিলেন অধিনায়ক নাজমুল। ম্যাচের প্রথম বলে উইল ইয়াংয়ের ব্যাটে চার খেলেও চতুর্থ বলেই শরীফুল উল্লাসে উদ্বাহু হয়েছিলেন। অফ স্টাম্পের ওপর বল ছিল। রাচিন রবীন্দ্রের ব্যাটের কানা ছুঁয়ে সেটা জমা পড়ল উইকেটকিপার মুশফিকের হাতে। ওভারের শেষ বলে আবারও বাংলাদেশ দলের উদ্‌যাপনের মধ্যমণি বাঁহাতি শরীফুল। সেকেন্ড স্লিপে এবার হেনরি নিকোলসের দুর্দান্ত ক্যাচ নিলেন এনামুল।

বোলিংয়ে বাংলাদেশকে দারুণ শুরু এনে দেন শরীফুল
এএফপি

বৃষ্টির কারণে ৫০ ওভারের ম্যাচ নেমে এসেছিল ৪৬ ওভারে। তবে বৃষ্টির ঝাপটা ওখানেই থামেনি। নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের সময়ই আরও দুবার খেলা থেমেছে বৃষ্টিতে। ম্যাচটা সে কারণেই শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে ৩০ ওভারের।
যখনই বৃষ্টি থেমে খেলা শুরু হয়েছে, তখনই কমিয়ে আনা হয়েছে ম্যাচের দৈর্ঘ্য, সঙ্গে কিউই ব্যাটসম্যানরা ব্যাটে তুলেছেন ঝড়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ঝড়টা তুলেছেন অধিনায়ক টম ল্যাথাম আর ওপেনার উইল ইয়াং। ল্যাথাম শেষ পর্যন্ত ৯২ রানে আউট হয়ে গেলেও ইয়াং ফিরেছেন ওয়ানডেতে নিজের তৃতীয় শতক (১০৫) নিয়ে।

শরীফুলের অমন শুরুর পরও কিউইরা বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে এ দুজনের কৃতিত্বে। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠতে দুজনই প্রথমে করেছেন সতর্ক ব্যাটিং, পরে গেছেন আক্রমণে। বৃষ্টির বাধা টপকে ১৭১ রানের তৃতীয় উইকেট জুটিতে নিউজিল্যান্ডের ইনিংসটা এগিয়ে নিয়েছেন তাঁরাই, যেটা পারেননি বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান। অবশ্য এ জন্য সৌম্য সরকারকেও একটা ‘ধন্যবাদ’ দিতে পারেন ল্যাথাম।

আরও পড়ুন

ইনিংসের ১০ম ওভারের প্রথম বলে নিজের রান যখন ১৮, মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়তি বাউন্স পাওয়া বলে ফার্স্ট স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন ল্যাথাম। সৌম্য লাফিয়ে উঠে শুধু হাতই ছোঁয়াতে পারলেন বলে, ক্যাচ নিতে পারলেন না। অথচ ল্যাথাম ওই বলে আউট হলে ইয়াংয়ের সঙ্গে তাঁর জুটিটা শেষ হয়ে যেত মাত্র ৩০ রানে। তাঁরও আর ৯২ রান করা হয় না।

ইনিংসের ১৩.৫ ওভার পর প্রথমবার বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হওয়ার সময় নিউজিল্যান্ডের স্কোর ছিল ২ উইকেটে ৬৩ রান। পৌনে এক ঘণ্টার বিরতির পর ৪৬ ওভারের ম্যাচ নেমে এসেছিল ৪০ ওভারে। কিন্তু ৬ ওভার ৩ বল খেলা হয়েই আবার বৃষ্টি। মাঝের এই সময়টায় নিউজিল্যান্ডের দুই ব্যাটসম্যানই রানের গতি বাড়িয়ে নিয়েছেন।
১৯.২ ওভার পর দ্বিতীয়বার বৃষ্টিতে খেলা থামার আগেই স্বাগতিকদের রান ১০৮, অর্ধশত হয়ে যায় ল্যাথামের। ১২তম কিউই ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে করে ফেলেন ৪ হাজার রানও। ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট পর আবার খেলা শুরু হলে ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমে আসে ৩০ ওভারে। এই দফা ইয়াং-ল্যাথাম হয়ে ওঠেন আরও আগ্রাসী।

বাংলাদেশের হয়ে ৩৯ বলে ৪৩ রান করেছেন এনামুল হক
এএফপি

বৃষ্টি থামার পরের ওভারেই সৌম্যর বলে উইকেটকিপার মুশফিকের মাথার ওপর দিয়ে স্কুপে ছক্কা মারেন ল্যাথাম। আরেকটি দারুণ স্কুপে সৌম্যকে ওই ওভারে ছক্কা মেরেছেন ইয়াংও। মিরাজকে মারা ল্যাথামের ছক্কা গিয়ে পড়েছে ইউনিভার্সিটি ওভালের কার পার্কে। পরের ওভারের শেষ তিন বলে সৌম্যকে পর পর তিন বাউন্ডারি হাঁকিয়েছেন ল্যাথাম।

ম্যাচের এই পর্বের প্রায় প্রতি ওভারেই একের বেশি চার-ছক্কা। ২৫তম ওভারে ল্যাথাম আর ইয়াংয়ের বলে দুই ছক্কা খেতে হয়েছে ওই ওভারেই প্রথম বোলিংয়ে আসা আফিফ হোসেনকেও। এক ওভার করেই তিনি দিয়েছেন ১৭ রান। সৌম্যর করা ২৮তম ওভারে এসেছে চার বাউন্ডারিতে ১৮। চারটি চারই মেরেছেন ইয়াং।

আরও পড়ুন

৩ ছক্কা আর ৯ বাউন্ডারিতে ৭৭ বলে ৯১ রান করা ল্যাথাম শেষ পর্যন্ত ফিরেছেন মিরাজের বলে বোল্ড হয়ে। ব্যাটের ভেতরের কানায় বল লেগে স্টাম্প ভেঙেছে কিউই অধিনায়কের। তার আগে ইয়াংয়ের সঙ্গে হওয়া তাঁর ১৭১ রানের জুটি বাংলাদেশের বিপক্ষে যে কোনো উইকেটে নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

ল্যাথাম ফিরে যাওয়ার পর ইয়াং-এর সঙ্গে দলের রানটাকে গতিশীল রাখার দায়িত্ব নেন মার্ক চ্যাপম্যান। দুজন মিলে ২৭তম ওভারেই ২০০ পার করিয়ে দেন নিউজিল্যান্ডকে। ১১ বলে দ্রুতলয়ে ২০ রান করে ফিরে যান চ্যাপম্যান।

শেষ দিকে দ্রুত রানের জন্য ছুটতে গেয়ে ইয়াংসহ নিউজিল্যান্ডের চার ব্যাটসম্যানই রান আউট হয়েছেন। তাতে কী! বাংলাদেশকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো একটা লক্ষ্য যে দেওয়া গেছে তার আগেই। বারবার বৃষ্টির বাধা আর কিউই ব্যাটসম্যানদের চার-ছক্কার ঝড়ে শরীফুলের আগুন ঝরানো প্রথম ওভার তখন সুদূর অতীত। বাংলাদেশ হেরে যাওয়ার পর তো সেই শুরু আর মনে রাখারই সুযোগ নেই।