তিনি অশ্বিন বলেই এমন ভাবতে পারেন
ধরুন, আপনি পাড়ার ক্রিকেট দলের খুব গুরুত্বপূর্ণ বোলার। সামনেই কোনো এক টুর্নামেন্টের ফাইনাল। যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ বোলার, তাই ফাইনালটা যে খেলবেন, সে বিষয়ে আপনার মনে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ফাইনালের দিন দেখা গেল উল্টো কাণ্ড, একাদশেই জায়গা হয়নি! এই অবস্থায় আপনি কী করবেন? প্রচণ্ড ক্ষোভের উদ্গিরণ ঘটানোই স্বাভাবিক। কিন্তু সবাই এমন নয়। কেউ কেউ রবিচন্দ্রন অশ্বিনও হতে পারেন।
গত জুনের শুরুতে ফিরে তাকান। ৭ জুন ওভালে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয়েছিল ভারত। সেদিন ভারতের একাদশে অশ্বিনকে না দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিলেন সবাই। যাঁদের মধ্যে সুনীল গাভাস্কার নামের একজনও ছিলেন। যিনি যৌক্তিক প্রশ্নটাই তুলেছিলেন, বিশ্বের কোনো দল কি র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা বোলারকে বাইরে রাখবে? হ্যাঁ, অশ্বিন এখনকার মতো তখনো আইসিসি টেস্ট বোলারদের র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে ছিলেন আর ভারত ২০৯ রানে ফাইনাল হেরেছিল।
ফাইনালে দলে জায়গা না পাওয়ায় অশ্বিনের যে মন খারাপ হয়েছিল, এটা না বললেও চলে। কিন্তু বর্তমান ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা মস্তিষ্কের এই মন খারাপের মধ্যেও উপলব্ধিটা একটু অন্য রকম ছিল। ফাইনালে হারের পরপরই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমি পড়ে যাইনি, বলতে পারেন হোঁচট খেয়েছি। আগেও আমি এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছি, তাই এই ঘটনা ভুলে এগিয়ে যাব।’ ভাবতে পারেন, এগুলো স্রেফ কথার কথা, মনের ক্ষোভ লুকিয়ে লোকদেখানো সৌজন্যতা। কিন্তু অশ্বিনের ক্ষেত্রে এই ভাবনা ভুল হবে।
ডমিনিকা টেস্টে কাল প্রথম দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার পর সংবাদমাধ্যমে অশ্বিনের বলা কথাগুলো শুনলে ভুল ভাঙবে। ভারতীয় অফ স্পিনার বলেছেন, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে বাদ পড়ার পর তাঁর সামনে দুটো পথ খোলা ছিল—রাগটা পুষে রেখে প্রতিবাদ করা অথবা এখান থেকে শিক্ষা নেওয়া। অশ্বিন দ্বিতীয়টি বেছে নিয়েছিলেন এবং নিজে বাদ পড়েও ড্রেসিংরুমের পরিবেশ ‘ফুরফুরে’ রাখার চেষ্টা করেছিলেন ফাইনালে। এরপর টেস্ট দলে ফিরেই ‘নিজের সেরাটা নিংড়ে দিয়েছেন।’ ক্রিকেটে তো টিমম্যানশিপ নিয়ে প্রচুর কথা হয়। সেখানে অশ্বিনকে কত নম্বর দেবেন?
ডমিনিকা টেস্ট দিয়ে ভারতের দলে ফেরা অশ্বিন ম্যাচের প্রথম দিনে নিজেকে কতটা নিংড়ে দিয়েছেন, তা জানাচ্ছে পরিসংখ্যানও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাত্র ১৫০ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার মূলে অশ্বিনের বোলিং, ২৪.৩–৬–৬০–৫। টেস্টে ৩৩তম বারের মতো ৫ উইকেট। ভারতের তৃতীয় বোলার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ছুঁয়েছেন ৭০০ উইকেটের মাইলফলক। বাকি দুজন হরভজন সিং ও অনিল কুম্বলে।
মোট ৭১১ উইকেট নেওয়া ‘ভাজ্জি’কে হয়তো কিছুদিনের মধ্যে টপকে যাবেন অশ্বিন। কুম্বলের ৯৫৬ কি ছুঁতে পারবেন? সেটা সময়ই বলে দেবে, তবে এই তিনজনের দিকে তাকালে একটি পরম্পরা ভেসে ওঠে। কুম্বলে যাওয়ার পর স্পিন বিভাগে ভারতীয়দের প্রত্যাশার ভার টানতে হয়েছে হরভজনকে। আর হরভজনের পর সেই দায়িত্ব এখন অশ্বিনের। ‘হোঁচট’ খেতে খেতে সেই অশ্বিন এখন আরও উঁচুতে। কতটা? পরিসংখ্যান এখন তাঁকে ভারতীয়দের মধ্যে তিনে রাখলেও ক্রিকেট নিয়ে তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটি মাপার কোনো স্কেল থাকলে অশ্বিন নিঃসন্দেহে অনেক ওপরেই থাকতেন।
প্রথম দিনের খেলা শেষে অশ্বিন বলেছেন, ‘আরও ভালো করার সার্বক্ষণিক চেষ্টা’ই তাঁকে সব খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও টিকিয়ে রেখেছে। এরপর বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘এমন কোনো মানুষ কিংবা ক্রিকেটার নেই যে সব সময় ভালো পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই গিয়েছেন, কখনো খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েননি। বাজে সময় আপনাকে দুটো পথ দেখাবে—হয় আপনি ক্ষোভে প্রতিবাদ জানাবেন এবং আরও নিচে নামবেন, অথবা সেখান থেকে শিক্ষা নেবেন। আমি এমন কেউ যে সব সময় বাজে পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নেয়। এই যে একটা ভালো দিন গেল, তারপর কী? একটু ভালো খাবার খাব, পরিবারের সঙ্গে কথা বলব, তারপর সবকিছু ভুলে যাব। কারণ, এটা আমরা জানি, আগামীকাল আরও ভালো করার জন্য উন্নতির জায়গা আছে।’
অশ্বিনের পরের কথাগুলো দার্শনিকসুলভ, ‘ভালো করার সার্বক্ষণিক চেষ্টাই আমাকে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যেও টিকিয়ে রেখেছে। তবে এটা সহজ কিছু নয়। কষ্টসাধ্য কাজ। তবে আমি এমন সব বাজে সময়ের প্রতি কৃতজ্ঞ। কারণ, এসবের মুখোমুখি না হলে জীবনে সাফল্যের দেখা পেতাম না।’
এই যে ভালো করার অহর্নিশ চেষ্টা, সেটাই তাঁকে ভারতের দ্রুততম ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ৭০০ উইকেটের মাইলফলকের দেখা পাইয়ে দিয়েছে। অশ্বিনের লাগল ২৭১ ম্যাচ, হরভজনের লেগেছে ৩৬৫ আর কুম্বলে খেলেছেন ৪০১ ম্যাচ।
অর্থাৎ, খারাপ সময় সব সময় খারাপ নয়, তা ভালো কিছু করার প্রসববেদনাও।