ভারতের পরের দুই টেস্টে আম্পায়ার বাংলাদেশের শরফুদ্দৌলা, এবার কী হবে
ক্রিকেট মাঠে ক্রিকেটাররাই সব সময় আলোচনায় থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। যাঁরা খেলাটা পরিচালনা করেন, যেমন আম্পায়ার, ম্যাচ রেফারি বা অন্য কোনো অফিশিয়াল...তাঁদের নিয়ে তুলনামূলক কম আলোচনা হয়।
তবে আম্পায়ার হয়েও গত ছয় মাসে বৈশ্বিক ও ঘরোয়া ক্রিকেট মিলিয়ে সবচেয়ে আলোচিত নামটা বোধ হয় শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ, যিনি সৈকত নামে বেশি পরিচিত।
শরফুদ্দৌলা প্রথম বাংলাদেশি আম্পায়ার হিসেবে আইসিসি এলিট প্যানেলে জায়গা করে নেন গত বছরের মার্চে। এর পর থেকে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফিসহ প্রায় সব বড় আসর ও সিরিজে ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। তাঁকে আম্পায়ারিং করতে দেখা গেছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের মতো ঘরোয়া টুর্নামেন্টেও।
এই সময়ে প্রযুক্তিকে তোয়াক্কা না করে সাহসী সিদ্ধান্ত, সিডনির ‘কুরুক্ষেত্র’ সামলানো, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে তাওহিদ হৃদয়–কাণ্ডে বাংলাদেশ ক্রিকেটে বোর্ডের (বিসিবি) চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত এবং পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত বদলে সেই চাকরিতে থেকে যাওয়া—সব মিলিয়ে গত বছরের শেষ দিকে এবং এই বছরের প্রথম ছয় মাসে বেশ কয়েকবার খবরের শিরোনাম হয়েছেন শরফুদ্দৌলা।
শুরুটা হয়েছিল মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া–ভারতের বক্সিং ডে টেস্টে প্যাট কামিন্সের আবেদন দিয়ে। সেই ম্যাচেই ভারতীয় ওপেনার যশস্বী জয়সোয়ালকে আউটের সিদ্ধান্তে ব্যাপক আলোচিত হন তিনি। কারও কারও তোপের মুখে পড়লেও সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতায় বেশির ভাগ ধারাভাষ্যকার ও বিশ্লেষক শরফুদ্দৌলার পাশে দাঁড়ান। সেই শরফুদ্দৌলা আবারও পেয়েছেন ভারতের ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব!
হেডিংলিতে ইংল্যান্ড–ভারত টেস্ট সিরিজের (বর্তমান নাম অ্যান্ডারসন–টেন্ডুলকার ট্রফি) প্রথমটিতে টিভি আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেছেন শরফুদ্দৌলা। তবে ২ জুলাই শুরু হতে চলা এজবাস্টন টেস্ট ও ১০ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া লর্ডস টেস্টে ৪৮ বছর বয়সী এই বাংলাদেশিকে মাঠের আম্পায়ার হিসেবে দেখা যাবে। ম্যাচ দুটি সামনে রেখে তাই প্রশ্নটা আবারও উঠছে—ভারতের ম্যাচে আম্পায়ার বাংলাদেশের শরফুদ্দৌলা, এবার কী অপেক্ষা করছে?
এবার কী হবে, তা সময়ই বলে দেবে। বরং আগে কী হয়েছিল, সেদিকেই নজর ফেরানো যাক—
মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) সর্বশেষ বক্সিং ডে টেস্টে শরফুদ্দৌলা ছিলেন টিভি আম্পায়ার। গত ২৯ ডিসেম্বর ম্যাচের চতুর্থ দিনে প্যাট কামিন্সের বল মোহাম্মদ সিরাজের ব্যাট ছুঁয়ে যায় স্লিপে। বল সরাসরি স্লিপে থাকা স্টিভেন স্মিথের হাতে গেছে নাকি আগে মাটিতে পড়েছে, মাঠের আম্পায়ার মাইকেল গফ নিশ্চিত হতে পারেননি।
সিদ্ধান্তের জন্য গফ সহযোগিতা চান টিভি আম্পায়ার শরফুদ্দৌলার। খুব দ্রুত দুবার রিপ্লে দেখার পর বাংলাদেশের এই আম্পায়ার সিরাজকে নটআউট দেন। এ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক কামিন্স ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান।
সবচেয়ে বড় বিতর্কের সূত্রপাত পরদিন ৩০ ডিসেম্বর টেস্টের শেষ দিনে।
স্নিকোমিটার প্রযুক্তি কট বিহাইন্ড না ধরতে পারলেও ভারতীয় ওপেনার জয়সোয়ালকে আউটের সিদ্ধান্ত দেন শরফুদ্দৌলা। তখনো পঞ্চম দিনের ২১.২ ওভার বাকি। টেস্ট জিততে অস্ট্রেলিয়ার দরকার ছিল ৪ উইকেট, ভারতের ২০০ রান।
তখন অবশ্য ভারত জয়ের জন্য নয়, ড্রয়ের জন্য খেলছিল। হার এড়াতে সফরকারীদের মূল ভরসা ছিলেন জয়সোয়াল, ব্যাটিং করছিলেন ৮৪ রান নিয়ে। এই পরিস্থিতিতে কামিন্সের বাউন্সারে বল উইকেটকিপার অ্যালেক্স ক্যারির গ্লাভসে জমা পড়লে জয়সোয়ালের ক্যাচের আবেদন করে অস্ট্রেলিয়া।
মাঠের আম্পায়ার আউট দেননি। অধিনায়ক কামিন্স রিভিউ নিলে সিদ্ধান্ত যায় টিভি আম্পায়ার শরফুদ্দৌলার কাছে। রিপ্লেতে দেখা যায়, বল জয়সোয়ালের ব্যাট ও গ্লাভস ছুঁয়েছে। শরফুদ্দৌলাও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় জানান, তিনি স্পষ্ট করেই দেখতে পাচ্ছেন বলের গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। তবে আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি স্নিকোমিটারের সাহায্য চান।
তখনই বাধে বিপত্তি। বল ব্যাটে বা গ্লাভসে লাগার ফলে স্নিকোমিটারের লাইনগুলোতে বড় যে দাগ (তরঙ্গ চিহ্ন) ওঠে, তা দেখা যায়নি। এরপরও শরফুদ্দৌলা জয়সোয়ালকে আউট দেন অনেকটা প্রযুক্তির তোয়াক্কা না করেই! এ নিয়ে মাঠের দুই আম্পায়ার মাইকেল গফ ও জোয়েল উইলসনের ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন জয়সোয়াল। মাঠ ছাড়ার সময় তাঁকে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতেও শোনা যায়।
শরফুদ্দৌলা জয়সোয়ালকে আউট দেওয়ার পর ভারত আর বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়া বক্সিং ডে টেস্ট জিতে নেয় ১৮৪ রানে। তখন থেকে পরের কয়েক দিন বিশ্ব ক্রিকেটে সবচেয়ে আলোচিত নাম হয়ে ওঠেন শরফুদ্দৌলা। কেউ কেউ তাঁর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও বেশির ভাগই পক্ষ নেন।
হার্শা ভোগলে, মার্ক নিকোলাসের মতো ধারাভাষ্যকাররা শরফুদ্দৌলার সিদ্ধান্তকে ‘সাহসী ও ন্যায্য’ বলেন। এমনকি রেকর্ড পাঁচবারের বর্ষসেরা আম্পায়ার সাইমন টফেল, সেই ম্যাচে ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা, ভারতের সাবেক কোচ রবি শাস্ত্রী, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক রিকি পন্টিং, ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক মাইকেল ভন, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ব্যাটসম্যান মার্ক ওয়াহ, ভারতের সাবেক উইকেটকিপার সুরিন্দর খান্নাসহ আরও কয়েকজন বাংলাদেশি আম্পায়ারের প্রশংসা করেন।
এ বছরের ৩ জানুয়ারি শুরু হওয়া সিডনি টেস্ট শরফুদ্দৌলার জন্য আরও বড় পরীক্ষা হয়ে ওঠে। কারণ, এবার তিনি মাঠের আম্পায়ার।
মেলবোর্ন টেস্টের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত মাথায় নিয়ে আম্পায়ারিং করার চ্যালেঞ্জ তো ছিলই, সঙ্গে আগের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার তরুণ ওপেনার স্যাম কনস্টাসের সঙ্গে যশপ্রীত বুমরা ও বিরাট কোহলির গ্যাঞ্জামের জেরে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড (এসসিজি) যেন কুরুক্ষেত্রে পরিণত না হয়, সেটি সামলানোর দায়িত্বও ছিল।
শেষ পর্যন্ত তেমনটাই হয়েছে। সিডনি টেস্টের প্রথম দিনের শেষ ১৫ মিনিট ক্রিকেটকে ভদ্রলোকের খেলা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়নি। বিশেষ করে উসমান খাজাকে আউট করার পর ভারতীয়রা কনস্টাসের সামনে গিয়ে যেভাবে অগ্নিমূর্তিতে উল্লাস করেছেন। এর আগে বুমরা ও কনস্টাস কয়েকবার কথার লড়াইয়ে জড়িয়েছেন। প্রতিবারই পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে গেছেন আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা।
ও হ্যাঁ, সিডনি টেস্টেও একটি সিদ্ধান্ত ঘিরে আলোচনায় আসেন শরফুদ্দৌলা। এবার তিনি অস্ট্রেলিয়ানদের আবেদনে ভারতীয় অলরাউন্ডার ওয়াশিংটন সুন্দরকে আউট না দিলে প্যাট কামিন্স রিভিউ নিয়ে সফল হন। সেই ম্যাচের টিভি আম্পায়ার জোয়েল উইলসন শরফুদ্দৌলার সিদ্ধান্ত পাল্টে সুন্দরকে আউট দিলেও স্নিকোমিটার প্রযুক্তির নির্ভুলতা নিয়ে আবারও প্রশ্ন ওঠে।
বুমরা, জয়সোয়াল, সুন্দররা ভারতের ইংল্যান্ড সফরেও আছেন। তাঁদের পরের দুই টেস্টে মাঠে থাকছেন বাংলাদেশের শরফুদ্দৌলাও। ছয় মাস আগের আলোচিত ঘটনাগুলোর কোনো ছায়া কি এবার এজবাস্টন, লর্ডসেও পড়তে পারে?