শেষবেলায় নিশাঙ্কাকে ফিরিয়ে কিছুটা স্বস্তি বাংলাদেশের

পাতুম নিশাঙ্কাকে বোল্ড করেছেন হাসান মাহমুদএএফপি

এমন দিনে গল ফোর্ট দেখতে চলে যাওয়াই ভালো। ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজদের বানানো দুর্গ, পরবর্তী সময়ে যেটি দখলে ছিল ওলন্দাজ আর ব্রিটিশদের। গলের পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে ওঠা দুর্গ এলাকায় হোটেল, রেস্তোরাঁ, লাইব্রেরি, দোকানপাট—সব আছে। গল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের একেবারে লাগোয়া বলে খেলার সময় অনেক ক্রিকেট–দর্শকও খুঁজে পাবেন সেখানে।

গল ফোর্টের ঘাসে ঢাকা সবুজ চাতালে বসে টেস্ট ম্যাচের ‘অ্যারিয়াল ভিউ’ দেখার বাড়তি সুবিধা—এই ক্রিকেটটা দুই দলই সাদা পোশাকে খেলে বলে কে বোলিং করছে, কে ব্যাটিং করছে, সেটা চাইলে না বুঝেও থাকা যায়। পাতুম নিশাঙ্কা নাহিদ রানা নাকি নাঈম হাসানকে মারছেন কিংবা নিশাঙ্কাই যে মারছেন আর নাঈম-নাহিদরাই যে মার খাচ্ছেন, অত উঁচু থেকে এত কিছু বোঝা কষ্ট।

শুধু বুঝবেন সাদা পোশাক পরে দুটি দল ক্রিকেট খেলছে। একটি দলের ব্যাটসম্যানরা হয়তো খুব আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করছেন, আরেক দলের বোলার-ফিল্ডাররা অসহায় হয়ে তা দেখছেন। সবুজ ঘাসে বসে নিচের সবুজ মাঠে সফেদ ক্রিকেটের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আপনাকে একটা নিরপেক্ষ স্থিতিতে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে আপনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ডুবে যাওয়া ক্রিকেটের রূপমাধুর্যই শুধু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবেন। কারও পক্ষ নিয়ে টেনশনে পড়ার ঝামেলা থাকবে না।

সেঞ্চুরির পর শ্রীলঙ্কার ওপেনার পাতুম নিশাঙ্কা
এএফপি

সমস্যাটা হয় ম্যাচ কাভার করতে আসা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের। অত ওপর থেকে অতটা সম্মোহিত হয়ে খুব বেশি সময় নান্দনিক ক্রিকেট দেখার সৌভাগ্য তাঁদের হয় না। একটা সময়ে মাটিতে নেমে আসতেই হয়। প্রেসবক্সে ফিরে অঙ্ক মিলিয়ে লিখতে হয়, বাংলাদেশ কেন শেষ পর্যন্ত ভালো খেলাটা ধরে রাখতে পারল না।

আগের দিনের ৫০০ ছুঁই ছুঁই (৪৮৪/৯) প্রথম ইনিংস আজ সকালেই থেমে গেছে ৪৯৫ রানে। মানে ৫০০ রানের চূড়ায় ওঠা হয়নি বাংলাদেশের। তৃতীয় দিনে হাসান মাহমুদ ও নাহিদ রানার শেষ উইকেট জুটি টিকেছে মাত্র ২.৪ ওভার। প্রায় শেষবেলায় হাসান মাহমুদ ডাবল সেঞ্চুরির দিকে ছুটতে থাকা নিশাঙ্কাকে ফেরাতে না পারলে দিনের বাকিটা শুধু শ্রীলঙ্কারই হয়ে যেত।

তাইজুল ইসলামকে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে ফেরা অভিষিক্ত ওপেনার লাহিরু উদারার (২৯) উইকেট হারিয়ে প্রথম সেশনেই ১০০ রান। তাতে প্রায় ৩০ বছর পর শ্রীলঙ্কার প্রথম ডানহাতি ওপেনিং জুটি হিসেবে নেমে পাতুম নিশাঙ্কা-লাহিরু উদারা জুটির অবদান ৪৭। টেস্টে শ্রীলঙ্কা এর আগে সর্বশেষ ডানহাতি ওপেনিং জুটি দেখেছে ২৬০ ম্যাচ আগে, ১৯৯৫ সালে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বক্সিং ডে টেস্টে। রোশন মহানামার সঙ্গে জুটিটা ছিল বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের।

লাহিরু উদারার ফিরতি ক্যাচ নিয়ে বাংলাদেশকে প্রথম উইকেট এনে দিয়েছিলেন তাইজুল ইসলাম (ডান থেকে ২য়)
এএফপি

দ্বিতীয় সেশনেও পড়েছে শ্রীলঙ্কার ১টি উইকেট। দ্বিতীয় উইকেটে নিশাঙ্কার সঙ্গে ১৫৭ রানের জুটি গড়ে দিনেশ চান্ডিমাল (৫৪) লেগ স্লিপে সাদমান ইসলামের ক্যাচ হয়েছেন নাঈম হাসানের বলে। এই সেশনে এসেছে ১৩৩ রান, আর শেষ সেশনে ১৩৫।

দিনের শেষ সেশনে অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি উইকেটও হারিয়েছে শ্রীলঙ্কা। ৭৫তম ওভারে মুমিনুল হকের বলে কট বিহাইন্ড ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলতে নামা অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস (৩৯)। এরপর দ্বিতীয় নতুন বল নিয়ে প্রথম ওভারেই (ইনিংসের ৮৬তম) হাসান মাহমুদ স্টাম্প এলোমেলো করে দেন নিশাঙ্কার। ২০০ ছুঁতে না পারলেও ২৫৬ বলে করা ১৮৭ রানই এখন টেস্টে তাঁর সর্বোচ্চ ইনিংস।

আরও পড়ুন

শুরু থেকে পুরোটা সময় শ্রীলঙ্কার দ্রুত রান তোলার মিশনে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন ওপেনার নিশাঙ্কা। ৮৮ বলে ফিফটির পর ১৩৬ বলে ১০০। ১৩ বাউন্ডারির সঙ্গে তাঁর একটি ছক্কাও মারা হয়ে গেছে ততক্ষণে। আরও ছয়টি বাউন্ডারিসহযোগে ১৫০-এ পৌঁছেছেন ২০১ বল খেলে। দুই দিনেরও বেশি সময় ব্যাট করে ৪৯৫ করা বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার ব্যাটিংয়ের পার্থক্য তৈরি হয়েছে এখানেই। এক দিনেরও কম সময়েই তাদের রান ৪ উইকেটে ৩৬৮। যদিও প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কা এখনো পিছিয়ে ১২৭ রানে।

ম্যাথুস ফিরেছেন ৩৯ রানে
এএফপি

শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশের ব্যাটিং পার্থক্য আরও স্পষ্ট হবে অঙ্কের হিসাবে। বাংলাদেশ ইনিংসে শ্রীলঙ্কার পাঁচ বোলারের মধ্যে ৩-এর ওপর ইকোনমি রেট ছিল শুধু থারিন্দু রত্নায়েকে আর প্রবাত জয়াসুরিয়ার। অন্যদিকে আজ বাংলাদেশের পাঁচ বোলারের মধ্যে তিনের নিচে ইকোনমি রেট নেই একজনেরও। ওভারপ্রতি সবচেয়ে কম ৩.৪৪ রান দিয়েছেন অফ স্পিনার নাঈম হাসান। ওভারপ্রতি ৫ রান করে দিয়ে সবচেয়ে খরুচে ফাস্ট বোলার নাহিদ রানা।

গলের তৃতীয় দিনের উইকেটে যে বোলারদের খুব বেশি কিছু করার ছিল, তা–ও অবশ্য নয়। যে উইকেটে বাংলাদেশ দল দুই দিনের বেশি ব্যাটিং করেছে সেখানে শ্রীলঙ্কার এমন ব্যাটিংই স্বাভাবিক। উইকেট আজও ছিল ব্যাটসম্যানদের পক্ষে। ব্যতিক্রম কিছু ঘটাতে বাংলাদেশের বোলারদের অসম্ভব ভালো কিছুই করতে হতো অথবা ভুল করতে হতো লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের। দুটোর কোনোটিই হয়নি। বাংলাদেশের পেসারদের মধ্যে নাহিদ রানা শুরুর দিকে সামান্য মুভমেন্ট পেলেও পরে আর তা থাকেনি। গলের উইকেট তৃতীয়-চতুর্থ দিনে বলে টার্ন আসে, আজ সেটাও খুব বেশি ছিল না।

আরও পড়ুন

সকালে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে বাংলাদেশকে অলআউট করার পর শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যানরা শুরু থেকেই দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করে গেছেন। তাঁদের ব্যাটিংয়ের এই মানসিকতাই বলে দিচ্ছে, গল টেস্টটা এখনো স্বাগতিকেরা জেতার জন্যই খেলছে। যদিও শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংস শেষ পর্যন্ত যেখানেই থামুক, বাংলাদেশ যদি দ্বিতীয় ইনিংসে নিজেদের প্রথম ইনিংসের অর্ধেক রানও করতে পারে, এই টেস্টে ড্র-ই অবধারিত ফল। অবশ্য দলটা বাংলাদেশ বলেই প্রথম ইনিংস থেকে রং নিয়ে দ্বিতীয় ইনিংসের অগ্রিম ছবি আঁকার উপায় নেই।

সে কারণেই ভয়, আবারও না গল ফোর্টের চাতালে গিয়ে বসতে হয়!

সংক্ষিপ্ত স্কোর (৩য় দিন শেষে)

বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ১৫৩.৪ ওভারে ৪৯৫ (মুশফিক ১৬৩, নাজমুল ১৪৮, লিটন ৯০; আসিতা ৪/৮৬, মিলন ৩/৩৯, থারিন্দু ৩/১৯৬)। শ্রীলঙ্কা ১ম ইনিংস: ৯৩ ওভারে ৩৬৮/৪ (নিশাঙ্কা ১৮৭, চান্ডিমাল ৫৪, ম্যাথুস ৩৯, কামিন্দু ৩৭*, উদারা ২৯, ডি সিলভা ১৭*; মুমিনুল ১/২৪, হাসান ১/৪৯, নাঈম ১/৮৬, তাইজুল ১/১২৬)।
আরও পড়ুন