সবার অভীষ্ট লক্ষ্যই যেহেতু পরিচালকের পদে বসা, ‘যুদ্ধবিগ্রহে’ লিপ্ত হয়ে খামাখা অনিশ্চয়তা বাড়ানো কেন! তার চেয়ে কিছু ছাড় দিয়ে সমঝোতা করে নেওয়াই লাভজনক।
গত শুক্রবার সরকার ও বিএনপি–সমর্থিত দুই পক্ষের মধ্যে হওয়া দুটি আলোচনার পর সে রকম সমঝোতার দিকেই যাচ্ছে বিসিবির পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন। এর পর থেকে ৬ অক্টোবরের নির্বাচন নিয়ে উত্তাপও বেশ কমে এসেছে। ‘আসন’ (পড়ুন পরিচালক পদ) ভাগাভাগিও নাকি মোটামুটি সারা।
এর মধ্যেই নিজেদের মধ্যে বিভেদ-অসন্তোষে চাপা উত্তাপ ছড়াচ্ছে ক্যাটাগরি-২ বা ক্লাব ক্যাটাগরির নির্বাচন। ক্লাব থেকে পরিচালক প্রার্থী হিসেবে বিএনপির নেতা-পুত্রদের অগ্রাধিকার দেওয়ায় প্রকৃত ক্লাব সংগঠকেরা নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন এককভাবে। ক্লাব সংগঠকেরা যে তাঁদের বাদ দিয়ে প্যানেল করাটাকে ভালোভাবে নেননি, তার প্রমাণ এই ক্যাটাগরিতে ১২টি পরিচালক পদের জন্য ৭৬ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৩২ জনেরই মনোনয়নপত্র কেনা।
গতকাল তাঁদের ৩০ জন তা জমা দিয়েছেন, দেননি শুধু কাকরাইল বয়েজ ক্লাবের কাউন্সিলর ও বর্তমানে বিসিবির পরিচালক সালাহউদ্দিন চৌধুরী এবং ব্রাদার্সের কাউন্সিলর ও বিএনপির প্রয়াত নেতা সাদেক হোসেনের ছেলে ইশরাক হোসেন।
তবে চারটি ক্লাবের কাউন্সিলর হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিএনপির অন্য চার নেতা বরকতউল্লা বুলুর ছেলে ওমর শরীফ মো. ইমরান, মির্জা আব্বাসের ছেলে মির্জা ইয়াসির আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছেলে ইসরাফিল খসরু ও সালাহউদ্দিন আহমদের ছেলে সাঈদ ইব্রাহিম আহমদ।
সরকার-বিএনপি ‘আসন’ ভাগাভাগিতে বর্তমান বোর্ড সভাপতি আমিনুল ইসলামই এখন পর্যন্ত ভবিষ্যৎ সভাপতি হিসেবে একমাত্র প্রার্থী বলে শোনা যাচ্ছে। রাজনৈতিক সঙ্গীসাথি ও বিএনপির সমর্থন নিয়ে মহাসমারোহে নির্বাচনের মাঠে নামা জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবালের পক্ষ কিছুটা ব্যাকফুটে।
সমঝোতায় তামিমকে আপাতত ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান করার পাশাপাশি সেন্টার অব এক্সিলেন্স গঠনের দায়িত্ব দিয়ে তাঁর স্বপ্নপূরণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও গুঞ্জন আছে, তিনি দুটি সহসভাপতি পদের একটি পেতে পারেন, তবে ক্লাবগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হওয়ায় একই গুঞ্জন অন্যদের নিয়েও আছে এবং সেটাই বেশি জোরালো। অবশ্য দুটি সহসভাপতি পদই যে ক্লাব থেকে আসা পরিচালকদের দুজন পাবেন, তা মোটামুটি নিশ্চিত।
নির্বাচনে বিএনপিপন্থীদের মূল শক্তি ক্যাটাগরি-২–এর ক্লাব কাউন্সিলররা আর সরকারপন্থীদের শক্তি ক্যাটাগরি-১–এর জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা এবং ক্যাটাগরি-৩–এর সাবেক ক্রিকেটার, বিশ্ববিদ্যালয় ও সংস্থার কাউন্সিলররা।
ক্লাব ক্যাটাগরিতে প্রকৃত সংগঠকদের অনেককে বাদ দিয়ে বিএনপির পাঁচ নেতার ছেলেকে কাউন্সিলর করা হয়। অতীতে এসব ক্লাবকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা সংগঠকদের বাদ দিয়ে হঠাৎ রাজনৈতিক নেতা-পুত্রদের সামনে নিয়ে আসায় বিভাজন তৈরি হয়েছে ক্লাবগুলোর মধ্যে।
বিভেদের সৃষ্টি অবশ্য বিসিবির বর্তমান পরিচালক মাহবুবুল আনাম নির্বাচন না করার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই। তার আগপর্যন্ত মাহবুবের নেতৃত্বে ২০-২২টি ক্লাবের একটি মোর্চা ছিল। তাঁরাও ক্লাব ক্যাটাগরি থেকে ৯টি পরিচালক পদ পাওয়ার জন্যই এগোচ্ছিলেন, তবে সেখানে সবাই ছিলেন প্রকৃত সংগঠক। বাকি তিনটি পদ তাঁরাও সরকারপন্থীদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
মাহবুব নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর নেতৃত্বের সংকটে পড়ে ক্লাবগুলো, শুরু হয় দ্বন্দ্ব। সূত্র জানিয়েছে, তামিম ইকবাল নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্য বিএনপির নেতা-পুত্রদের কাছে টানেন, যেটির বিরূপ প্রভাব পড়ে ক্লাব সংগঠকদের মধ্যে। ক্লাব থেকে ১২ পরিচালক আনার ভোটাভুটিতেও এই বিরূপ প্রভাব বড় প্রভাবক হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন ভোটাররা।
দুই পক্ষের একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সমঝোতায় ঠিক হয়েছে, ক্লাব ক্যাটাগরি থেকে বিএনপিপন্থীরা পাবে ৯ থেকে সর্বোচ্চ ১০টি পরিচালক পদ। এ ক্ষেত্রে ওল্ড ডিওএইচএসের কাউন্সিলর তামিম ইকবাল ছাড়াও বর্তমান বোর্ড পরিচালক ও সূর্যতরুণের ফাহিম সিনহা, মোহামেডানের মাসুদুজ্জামান, ইন্দিরা রোডের রফিকুল ইসলাম, ধানমন্ডি স্পোর্টস ক্লাবের ইশতিয়াক সাদেক, ঢাকা মেরিনার ইয়াংস ক্লাবের শানিয়ান তানিম নাভিন, বাংলাদেশ বয়েজ ক্লাবের ওমর শরীফ মো. ইমরান, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাবের মির্জা ইয়াসির আব্বাস, এক্সিওম ক্রিকেটার্সের ইসরাফিল খসরু ও ফেয়ার ফাইটার্স স্পোর্টিং ক্লাবের সাঈদ ইব্রাহিম আহমদের নাম শোনা যাচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, সমঝোতায় ক্লাব ক্যাটাগরি থেকে সরকারপন্থীদের জন্য তিনটি পরিচালক পদ চেয়েছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া, যার অন্যতম সাবেক বিসিবি সভাপতি ও রেঞ্জার্স ক্রিকেট একাডেমির কাউন্সিলর ফারুক আহমেদ।
তবে শেষ মুহূর্তে এখান থেকে অন্তত দুজন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বিএনপিপন্থীদের অলিখিত প্যানেলে চলে আসতে পারেন বিসিবির বর্তমান দুই পরিচালক ইফতেখার রহমান ও মনজুর আলম। প্রথমজন তৃতীয় বিভাগের দল ভাইকিংস ক্রিকেট একাডেমি ও দ্বিতীয়জন রেগুলার স্পোর্টিং ক্লাবের কাউন্সিলর।
সূত্র জানিয়েছে, সমঝোতায় ক্লাব ক্যাটাগরি থেকে সরকারপন্থীদের জন্য তিনটি পরিচালক পদ চেয়েছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া, যার অন্যতম সাবেক বিসিবি সভাপতি ও রেঞ্জার্স ক্রিকেট একাডেমির কাউন্সিলর ফারুক আহমেদ।
তাঁর সঙ্গে শোনা যাচ্ছে ঢাকা স্পার্টানস ক্রিকেট ক্লাবের আমজাদ হোসেন ও কাঁঠালবাগান গ্রিন ক্রিসেন্ট ক্লাবের মেজর (অব.) ইমরোজ আহমেদের নামও। শেষেরজন বিভিন্ন ফেডারেশন ও জেলা-বিভাগের অ্যাডহক কমিটি পুনর্গঠনে গঠিত যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সার্চ কমিটির সদস্য ছিলেন।
বিসিবির ২৫টি পরিচালক পদের জন্য পরশু সব মিলিয়ে ৬০টি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হলেও গতকাল জমা পড়েছে ৫১টি। এর মধ্যে খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের পরিচালক পদে ভোটাভুটির প্রয়োজন পড়বে না।
বিসিবির ২৫টি পরিচালক পদের জন্য পরশু সব মিলিয়ে ৬০টি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হলেও গতকাল জমা পড়েছে ৫১টি। এর মধ্যে খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের পরিচালক পদে ভোটাভুটির প্রয়োজন পড়বে না। এই তিন বিভাগের মধ্যে খুলনা থেকে দুটি পরিচালক পদের জন্য মনোনয়নপত্রও জমা দিয়েছেন দুজন—খুলনা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কাউন্সিলর ও জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার খান আবদুর রাজ্জাক এবং খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাউন্সিলর জুলফিকার আলী খান।
বরিশাল বিভাগ থেকে কেনা একমাত্র মনোনয়নপত্রটি জমা দিয়েছেন ভোলা জেলা ক্রীড়া সংস্থার শাখাওয়াত হোসেন। সিলেট বিভাগ থেকেও একমাত্র প্রার্থী বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কাউন্সিলর রাহাত সামস। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, যেসব ক্ষেত্রে একাধিক মনোনয়নপত্র জমা পড়েনি, সেসব ক্ষেত্রে ‘বিধি মোতাবেক’ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই চারজনের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বোর্ড পরিচালক হওয়া তাই অনেকটাই নিশ্চিত।
অবশ্য ক্যাটাগরি–১ ও ক্যাটাগরি–৩ এর প্রায় সব ক্ষেত্রেই সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের পরিচালক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ক্যাটাগরি–১ থেকে পরিচালক হবেন ১০ জন, ক্যাটাগরি–৩ থেকে ১ জন।
আজ মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে, আগামীকাল আপিল গ্রহণ ও শুনানি এবং ১ অক্টোবর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিনে জানা যাবে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা। ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচনে সরকার ও বিএনপি সমর্থিতদের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তা এখন কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। তবে ক্লাব ক্যাটাগরির নির্বাচনী উত্তাপ কমবে, নাকি বাড়বে, তা বোঝা যাবে সেদিনই।
