শ্রীলঙ্কা–বাংলাদেশ: লিটন–হৃদয়কে আজ যা করতে হবে
‘মিডল অর্ডারে তাদের একজন বলপ্রয়োগকারী লাগবে। খেয়াল করে দেখবেন, সূর্যকুমার ভারতের হয়ে এ কাজটা করে। মাঝের ওভারগুলোয় সে দারুণ স্ট্রাইক রেট এনে দেয়। আমার মনে হয় তারা মাঝের ওভারগুলোয় ভুগছে। মিডল অর্ডারে তাদের কাউকে প্রয়োজন, সেটা হতে পারেন লিটন কিংবা তাওহিদ হৃদয়।’
বাংলাদেশ দল নিয়ে কথাগুলো ভারতের জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার ও বিশ্লেষক হার্শা ভোগলের। ক্রিকেটসংশ্লিষ্ট খবরের পোর্টাল ‘ক্রিকবাজ’–এ বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা ম্যাচপূর্ব বিশ্লেষণে কথাগুলো বলেন হার্শা। এশিয়া কাপে সুপার ফোরে আজ দুবাইয়ে শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।
সবার আগে ভোগলের কথাগুলো একটু ভেঙে নেওয়া যাক। টি–টোয়েন্টিতে পাওয়ারপ্লের প্রথম ছয় ওভার এবং শেষ পাঁচ ওভারে এমনিতেই যেকোনো দল মারমুখী ব্যাটিং করে। ঝামেলা হয়ে যায় মাঝের ওভারগুলোয়। কারণ, তখন ৩০ গজ বৃত্তের বাইরে সীমানায় পাঁচজন ফিল্ডার থাকতে পারেন। যে কারণে পাওয়ারপ্লেতে মাত্র দুজন ফিল্ডার সীমানায় থাকায় তখন হাত খুলে খেলা গেলেও মাঝের ওভারে সেটা সম্ভব হয় না যদি দলের মিডল অর্ডারে ‘ক্লিন হিটার’ এবং পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান না থাকেন।
হার্শা ভারতের অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদবের উদাহরণ টেনেছেন। তাঁর যুক্তির পক্ষে সাক্ষ্য দেয় পরিসংখ্যান। গত দুই বছরে ভারতের মিডল অর্ডারে (৩ থেকে ৭ নম্বর) নেমে সূর্যর স্ট্রাইক রেট ১৫৩.৫৯। আছে সেঞ্চুরিসহ ৬টি ফিফটি। সামর্থ্যের প্রশ্নে তাঁর সঙ্গে অবশ্যই লিটন ও হৃদয়ের তুলনা চলে না। কিন্তু জায়গাটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট—যেখানে আসলে তুলনা চলে না বলে কোনোকিছুতে এতটুকু ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই। পারফর্ম করতেই হয়, এশিয়া কাপের মতো বড় টুর্নামেন্টে তো বটেই।
চলতি এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সর্বশেষ ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ। সে ম্যাচে বাংলাদেশ অধিনায়ক লিটন নামেন তিনে, হৃদয় চারে। শ্রীলঙ্কা ও হংকংয়ের বিপক্ষেও একই পজিশনে ব্যাট করেন তাঁরা। এই তিন ম্যাচে ৯৬ রান করা লিটনের স্ট্রাইক রেট ১২৬.৩১। হৃদয়ের পরিস্থিতি অতটা ভালো না। ৩ ম্যাচে ১০৬.১৫ স্ট্রাইক রেটে ৬৯ রান করেছেন। আফগানিস্তান ম্যাচে পাঁচে নামা শামীম হোসেন ২ ইনিংসে ১১৭.১৭ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৫৩ রান। ছয়ে জাকের আলী ৩ ম্যাচে ব্যাটিংয়ে নেমে ৫৩ রান করেছেন ১১০.৪১ স্ট্রাইক রেটে।
শ্রীলঙ্কার মিডল অর্ডারেও একবার তাকানো যাক। তার আগে জানিয়ে রাখা ভালো, আফগানিস্তানের বিপক্ষে তাঁদের সর্বশেষ ম্যাচে ধারাভাষ্যকার বলছিলেন, গত টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে এ পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার মিডল অর্ডার সেভাবে পারফর্ম করতে পারেনি। দলের ৬৭ শতাংশ রানই এসেছে শীর্ষ তিন ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে। কিন্তু ধারাভাষ্যকারের মুখের কথা মুখে রেখে সে ম্যাচেই জ্বলে ওঠে লঙ্কান মিডল অর্ডার। ওপেনার কুশল মেন্ডিস ৭৪ রানের ইনিংসে ম্যাচ জিতিয়েছেন ঠিকই, তবে চারে নামা কুশল পেরেরার ২০ বলে ২৮, পাঁচে আসালাঙ্কার ১২ বলে ১৭ এবং ছয়ে কামিন্দু মেন্ডিসের ১৩ বলে অপরাজিত ২৬ রানের অবদানও কম না। এই তিনজনের পারফরম্যান্স হয়তো অসাধারণ নয়, কিন্তু ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে ব্যাট করে এবং মেন্ডিসকে সঙ্গ দিয়ে জয়টা বের করে আনেন তাঁরা।
সর্বশেষ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে এ পর্যন্ত হিসাব করলে ২০ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার মিডল অর্ডার (৩ থেকে ৭ নম্বর) ১২৮.২৫ স্ট্রাইক রেটে ২০ ম্যাচে ১৩৮৯ রান করেছে। বাংলাদেশের মিডল অর্ডারও (৩ থেকে ৭ নম্বর) এ সময়ে ২৪ ম্যাচে ১২২.৭০ স্ট্রাইকরেটে ১৯৪০ রান করেছে।
এশিয়া কাপের গ্রুপ পর্বে বাংলাদেশের খেলা তিন ম্যাচে রান তোলার ধারাটা একবার দেখে নেওয়া যাক। হংকংয়ের বিপক্ষে রান তাড়ায় নেমে পাওয়ারপ্লেতে উঠেছে ২ উইকেটে ৫১ রান (৮.৫০ রান রেট), মাঝের ওভারে (৭ থেকে ১৬ ওভার) উঠেছে ৮৭ (৮.৭০ রান রেট)। প্রতিপক্ষ হংকংয়ের মতো সহযোগী দেশ হওয়ায় মাঝের ওভারগুলোয় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা একটু স্বস্তি পেয়েছেন সেটা ভাবতে পারেন।
তাহলে শ্রীলঙ্কার কাছে ৬ উইকেটে হারের ম্যাচে তাকানো যাক। আগে ব্যাটে ১৩৯ রান তোলা বাংলাদেশ সেদিন পাওয়ারপ্লেতে তুলেছে ৩ উইকেটে ৩০ (৫ করে রান রেট)। মাঝের ১০ ওভারে ২ উইকেটে ৭০ (৭ করে রান রেট) এরপর শেষের চার ওভারে বিনা উইকেটে ৩৯ (৯.৭৫ করে রান রেট)। আফগানিস্তানের বিপক্ষেও আগে ব্যাট করে ৫ উইকেটে ১৫৪ তুলেছিল বাংলাদেশ। পাওয়ারপ্লেতে বিনা উইকেটে ৫৯ (৯.৮৩ রান রেট) তোলার পর মাঝের ১০ ওভারে তুলেছে ৪ উইকেটে ৬৫ (৬.৫ রান রেট)। শেষের চার ওভারে ১ উইকেটে ৩০ (৭.৫ রান রেট)।
লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, উইকেট হারানোর চাপে পড়লে রান তোলা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের জন্য। তাহলে শ্রীলঙ্কার মাঝের ওভারে রান তোলার ধারাটাও একবার দেখে নিতে হয়। বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে মাঝের ১০ ওভারে ৩ উইকেটে ৮৫ রান (৮.৫ রান রেট) তুলেছে তারা। হংকংয়ের বিপক্ষে ১৪৯ রান তাড়া করতে নেমে মাঝের ১০ ওভারে তাদের সংগ্রহ ছিল ৩ উইকেটে ৮৭ (৮.৭ রান রেট)। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১৬৯ তাড়া করতে নেমে এই একই পর্যায়ে তাঁরা তুলেছে ২ উইকেটে ৭৫ (৭.৫ রান রেট)। মাঝের ওভারে রান একটু কম ওঠায় ১৭তম ওভার থেকে ১৮.৪ ওভারে জয়ের আগ পর্যন্ত তাঁরা তুলেছে ৪৩ রান! অর্থাৎ শেষ দিকে পুষিয়ে নেওয়ার মতো ব্যাটসম্যান আছে শ্রীলঙ্কার।
সর্বশেষ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে এ পর্যন্ত হিসাব করলে ২০ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার মিডল অর্ডার (৩ থেকে ৭ নম্বর) ১২৮.২৫ স্ট্রাইক রেটে ২০ ম্যাচে ১৩৮৯ রান করেছে। বাংলাদেশের মিডল অর্ডারও (৩ থেকে ৭ নম্বর) এ সময়ে ২৪ ম্যাচে ১২২.৭০ স্ট্রাইকরেটে ১৯৪০ রান করেছে। পার্থক্য তেমন একটা নেই। তবে এশিয়া কাপে নিজেদের শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার মিডল অর্ডার জ্বলে ওঠায় বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই দুশ্চিন্তার জায়গা আছে।
দুশ্চিন্তার জায়গা আছে আরও একটি। সেটি অবশ্য পুরোনো রোগ—ফিনিশিং মানে শেষ ৪–৫ ওভারে ভালোভাবে শেষ করা। আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের সর্বশেষ ম্যাচে এই দায়িত্বে হতাশ করেছেন জাকের আলী। ১৩ বলে ১২ রানে অপরাজিত ছিলেন। ইনিংসে শেষ ১১ বলে যে পাঁচটি ‘ডট’ গিয়েছিল, তার মধ্যে চারটি ‘ডট’ তাঁর। ১১০–এর একটু বেশি স্ট্রাইক রেট নিয়ে ব্যাট করছেন এশিয়া কাপে। একই পজিশনে নামা শ্রীলঙ্কার কামিন্দু মেন্ডিসের স্ট্রাইক রেট ১৭২.২২।
শুধু তা–ই নয়, জাকেরকে নিয়ে আরও একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি মনে আছে তো? ৩৪ বলে ৪১ রানে অপরাজিত ছিলেন জাকের। আপাতদৃষ্টে বাংলাদেশের সামর্থ্য বিবেচনায় ইনিংসটিকে ভালো মনে হওয়াই স্বাভাবিক এবং সেটা সঠিকও। কিন্তু সেই ইনিংসে একটি দুশ্চিন্তার বার্তাও ছিল, যেটা প্রকটভাবে বোঝা গেছে পরে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে। বল ভালোভাবে মারতে জাকের একটু চেস্ট ওপেন করে দাঁড়ানোয় শ্রীলঙ্কার দুই পেসার দুষ্মন্ত চামিরা ও নুয়ান তুষারা অফ স্টাম্পের বাইরে বেশ কয়েকটি ইয়র্কার মেরে জাকেরকে আটকে রেখেছিলেন। অর্থাৎ ওই পজিশনে দাঁড়ানোর দুর্বলতা ধরে ফেলে ঠিক সেই জায়গাতেই বল করেছেন দুই পেসার, যেটা করে সফল হয়েছেন আফগানিস্তানের বোলাররাও।
জাকেরকে তাই মারার জন্য সব সময় একই স্টান্সে দাঁড়ানো নিয়ে ভাবতে হতে পারে।
তবে ভোগলে আরও একটি বিষয় মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘লিটন রান পেলে বাংলাদেশ কিন্তু অন্য দল।’ সহ–বিশ্লেষক রোহান গাভাস্কারও তাতে সায় দিয়ে বলেছেন, ‘লিটনের কাছে রান পাওনা আছে বাংলাদেশের।’ এ পর্যন্ত ৩ ইনিংসে ১২৬.৩১ স্ট্রাইক রেটে ৯৬ রান করেছেন লিটন। রানে বাংলাদেশ অধিনায়কের বাকির খাতাটা তাই বন্ধ করার সময়ও আজই।
ভারতীয় কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কারের ছেলে ও সাবেক ক্রিকেটার রোহান আরও একটি বিষয় মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘শেষ কয়েকটি ম্যাচে পারভেজ হোসেনের স্ট্রাইক রেট ১৫০–এর বেশি।’ আগের ম্যাচে দলে তাঁর সুযোগ হয়নি, কিন্তু ১৫০ স্ট্রাইক রেটের ব্যাটসম্যানকে সুপার ফোরে বাংলাদেশ বসিয়ে রাখবে না বলে বিশ্বাস রোহানের।