ভারতকে আইসিসি কেন কিছু বলতে পারে না

ভারতের একরোখা সিদ্ধান্ত বা একগুঁয়েমি ভাবের সর্বশেষ নাটকটি মঞ্চায়িত হলো এই রবিবাসরীয়তে, মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে।

একটা জানা বিষয় দিয়েই শুরু করা যাক—ফিফা ফুটবলের শাসনকর্তা আর আইসিসি ক্রিকেটের। কিন্তু দুই শাসনকর্তার চরিত্র, ক্ষমতা, পারঙ্গমতায় বিরাট পার্থক্য। ফিফা ফুটবল বিশ্বে যত দৃঢ়তার সঙ্গে সবকিছু সামাল দিতে পারে, আইসিসি তা পারে না। কিন্তু কেন?

প্রশ্ন উঠতে পারে, ফিফা ও আইসিসির পার্থক্যের বিষয়টিই বা উঠল কেন। এর কারণ ক্রিকেট বিশ্বে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ক্রিকেট দলের কিছু একরোখা সিদ্ধান্ত আর চূড়ান্ত একগুঁয়েমি। যেসব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এশিয়া তথা বিশ্ব ক্রিকেটের ভারসাম্য নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু আইসিসি না পারছে এগুলো রুখতে, না পারছে শক্ত হাতে দমন করতে।

ভারতের একরোখা সিদ্ধান্ত বা একগুঁয়েমি ভাবের সর্বশেষ নাটকটি মঞ্চায়িত হলো এই রবিবাসরীয়তে, মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। অভূতপূর্ব, অভাবানীয় বা অদ্ভুত; ভারতের একগুঁয়েমির কারণে রোববার রাতে দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে যে মহানাটকের দৃশ্যায়ন হয়েছে, তা যেন কোনো শব্দেই বোঝানো সম্ভব নয়।

ভারত এশিয়া কাপের শিরোপা জিতলে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট মহসিন নাকভির হাত থেকে বিজয়ের স্মারক পদক আর ট্রফি নেবেন না ভারতের খেলোয়াড়েরা—এমন আভাস তো আগেই দিয়েছিল বিসিসিআই। সেই নাটকের শুরু হলো ফাইনাল শেষের পরপরই। শেষ হলো প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর, ট্রফি ছাড়া বিজয়মঞ্চে ভারতের খেলোয়াড়দের উদ্‌যাপন দিয়ে।

নাকভির হাত থেকে পুরস্কার নেননি ভারতীয় ক্রিকেটাররা
ছবি: রয়টার্স

ভারত এই একগুঁয়েমিটা করেছে মূলত রাজনৈতিক কারণে—এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট মহসিন নাকভি যে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও। যে দেশের সঙ্গে কিছুদিন আগেই যুদ্ধ করেছে ভারত, সে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাত থেকে ট্রফি নেওয়াটাকে সঠিক মনে করেনি ভারতের ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)।

ফাইনালের আগে এবারের এশিয়া কাপে আরও দুবার মুখোমুখি হয়েছিল ভারত—একবার গ্রুপ পর্বে, আরেকবার সুপার ফোরে। ওই দুই ম্যাচের একটিতেও খেলার রীতি মেনে টসের পর বা ম্যাচ শেষে পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের সঙ্গে হাত মেলাননি ভারতের খেলোয়াড়েরা।

আচ্ছা, একই রকম ঘটনা যদি কোনো ফুটবল টুর্নামেন্টে ঘটত, তাহলে কী হতো? ধরুন, ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতালি যদি সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার সেফেরিনের হাত থেকে ট্রফি নেবে না বলে গোঁ ধরত! উয়েফা কি চুপচাপ সেটা হজম করত? সম্ভবত না। কিন্তু আইসিসি কী করল? ঘটনাটা নীরবে হজম করে নিল।

ফিফা ও উয়েফার বর্তমান সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো (বাঁয়ে) ও আলেক্সান্দার সেফেরিন
ছবি: এএফপি

অথচ উয়েফা আর ফিফার দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন, গ্যালারিতে কোনো ক্লাবের সমর্থক বাজে আচরণ করলেই সেই ক্লাবকে শাস্তি পেতে হয়, হয় জরিমানাও। ক্ষেত্রবিশেষে সেই ক্লাবকে অনেক সময় দর্শক ছাড়া মাঠেই খেলতে হয়। দুটো ব্যাপার আলাদা, কিন্তু উদাহরণটা দেওয়া এই কারণে যে ফিফা বা উয়েফা খেলার মর্যাদা যেখানে সবচেয়ে ওপরে রাখে, সেখানে আইসিসি একেবারে ঢিলে।

টেস্ট, ওয়ানডে বা টি–টোয়েন্টি—পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো দ্বিপক্ষীয় ক্রিকেট সিরিজ খেলবে না, এমন সিদ্ধান্ত অনেক আগে থেকেই নিয়েছে ভারত। এ সিদ্ধান্তের ওপরে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর পাকিস্তানের নিরাপত্তা–সমস্যার মোড়ক লাগিয়ে দেওয়ায় অনেকেই বিষয়টি নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না।

আরও পড়ুন

এখন তো পাকিস্তান কোনো টুর্নামেন্টের আয়োজক হলেই বাগড়া দিচ্ছে ভারত। পাকিস্তানে গিয়ে সব বড় দলই খেলতে শুরু করলেও ভারত এখনো দেশটিতে আইসিসির কোনো টুর্নামেন্ট খেলতেও যেতে চায় না। ফলে পাকিস্তান আয়োজক হলেও সেই টুর্নামেন্টগুলো আয়োজন করতে হয় নিরপেক্ষ ভেন্যুতে। সেই ভেন্যুও আবার প্রায় ক্ষেত্রেই ঠিক করে দেয় ভারত!

গত আগস্টে বাংলাদেশ সফরে আসার কথা থাকলেও আসেনি ভারতীয় দল
ছবি: এএফপি

শুধু কি পাকিস্তানের বেলায়ই এমন করছে ভারত? এই তো আগস্ট মাসে বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল ভারতের। কিন্তু তারা সেই সফর স্থগিত করেছে। জানিয়ে দিয়েছে, পরে কখনো আসবে! যদিও আইসিসির ভবিষ্যৎ সফরসূচির কোনো সিরিজ একক সিদ্ধান্তে বাদ দিতে পারার কথা নয় কোনো দেশের বোর্ডের। এরপরও ভারত এটা বারবার করছে!

ভারত ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর বাতিল করার প্রসঙ্গ ধরেই ফিফার একটি বিষয়ে একটু নজর দেওয়া যায়। আগামী নভেম্বরে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ম্যাচ খেলতে আসার কথা ভারত ফুটবল দলের। ওই ম্যাচটি খেলতে না এসে কিন্তু পারবে না তারা!

কারণ, ফিফার কঠিন শাসন। কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়া ওই ম্যাচ খেলতে না এলে কিংবা ম্যাচের আগে–পরে অখেলোয়াড়সুলভ আচরণ করলে ফিফা যে শাস্তি হিসেবে দলটির পয়েন্ট কাটবে, এমনকি টুর্নামেন্ট থেকে বাদ দিতে পারে।

আরও পড়ুন

এবার সেই আসল প্রশ্ন—ফিফা যদি সবকিছু কঠোর হাতে দমন করতে পারে, আইসিসি কেন পারে না! কারণটা মূলত অর্থনৈতিক।

সংগঠন হিসেবে ফিফা জাতিসংঘের চেয়েও বড়। জাতিসংঘের সদস্যসংখ্যা যেখানে ১৯৩টি দেশ, ফিফার ২১১। এত বড় পরিবার নিয়েও ফিফা গোছানোভাবে চলতে পারছে একটা কারণেই—সংগঠনটি এক, দুই, তিন বা দশ–বিশটি সদস্যের আয়ের ওপর নির্ভরশীল নয়।

আইসিসির চেয়ারম্যান জয় শাহ। তিনি ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহর ছেলে
ছবি: লিংকডইন

অন্যদিকে আইসিসির সদস্যসংখ্যা ১০৫টি। এর মধ্যেও ভাগ আছে—পূর্ণ সদস্য যে মাত্র ১২টি। এই ১২ সদস্যের মধ্যে আবার তিন দেশের আয় বেশি। আইসিসি মূলত সেই তিন সদস্যের আয়ের ওপরই নির্ভরশীল।

আইসিসির সেই তিন সদস্য ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। আইসিসির আয়ের বড় উৎস সম্প্রচার স্বত্ব। সেটা বেশি আসে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বাজার থাকা ভারতের কাছ থেকেই। এরপর ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া।

ফলে এই তিন দলের দাপটও বেশি। একবার তো তারা আইসিসিতে ‘তিন মোড়লের’ একটি স্তরও বানাতে চেয়েছিল। যেখানে ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া থাকবে অন্যদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরে সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেছে।

কিন্তু সেটা আইসিসির চাপ বা চোখরাঙানোর কারণে নয়। তিন মোড়ল তত্ত্ব বাস্তবায়ন হয়নি মূলত ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া নিজেরা শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে না পারায়।

উয়েফার কঠোরতার কারণে বড় ক্লাবগুলো ইউরোপিয়ান সুপার লিগকে আলোর মুখ দেখাতে পারেনি
ছবি: রয়টার্স

অথচ ফুটবলেও এমন একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিল ইউরোপের বড় ক্লাবগুলো। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, লিভারপুল, চেলসি, আর্সেনাল, জুভেন্টাস, এসি মিলান, ইন্টার মিলানের মতো ক্লাবগুলো মিলে চালু করতে চেয়েছিল ইউরোপিয়ান সুপার লিগ। যেখানে থাকবে না মাঝারি মানের বা ছোট কোনো ক্লাব।

আরও পড়ুন

কিন্তু উয়েফার কঠোরতা আর দৃঢ় অবস্থানের কারণে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা থাকার পরও এই ক্লাবগুলো সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। খেলতে হচ্ছে আরও বড় পরিসরের চ্যাম্পিয়নস লিগে, যেখানে মাঝারি ও ছোট ক্লাব আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপেও তো ক্লাবের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু এ নিয়ে কোনো বড় ক্লাবেরই টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করার সাহস নেই ফিফার কঠিন শাসনের কারণে।

আইসিসির আয়ের বেশির ভাগই যায় তিন মোড়লের কোষাগারে। এরপর পায় পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো। আর যারা পূর্ণ সদস্য নয়, তাদের ভাগ্যে জোটে খুব সামান্য! কিন্তু ফিফায় চিত্রটা ভিন্ন—সেখানে ক্ষেত্রবিশেষে পিছিয়ে পড়া দলগুলোর জন্য থাকে বেশি বরাদ্দ, যেন তারা এগিয়ে আসতে পারে।

ফিফার আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস আইসিসির মতোই স্পনসর ও সম্প্রচার স্বত্ব। কিন্তু ছোট্ট একটা পার্থক্য আছে—আইসিসির রাজস্ব যেমন দুই–তিনটি দেশের বাজারের ওপর নির্ভর করে, ফিফার তেমন নয়।

সুইজারল্যান্ডের জুরিখে অবস্থিত ফিফার সদর দপ্তর
ছবি: উইকিপিডিয়া

ফিফা নিজেই রাজস্বের মূল উৎস। বিশ্বকাপের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। বিজ্ঞাপন বা স্পনসর থেকে ফিফার আয়টা এতটাই বৈশ্বিক, এখানে নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চল বা দেশ ছড়ি ঘোরাতে পারে না। তাই তো ফিফা হতে পেরেছে এতটা কঠিন আর সুশাসক। আইসিসির বেশির ভাগ স্পনসর প্রতিষ্ঠানই ভারতীয়, এ কারণেই আইসিসিতে ভারতের এত হম্বিতম্বি। ফিফার ক্ষেত্রে তা মোটেই নয়।

এ ছাড়া গঠন আর ক্ষমতার কাঠামো এবং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চিন্তাধারার পার্থক্যের কারণেও ফিফা আর আইসিসির শক্ত ও দুর্বল শাসক হওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। এই যেমন ফিফার সংবিধানে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী। অন্যদিকে আইসিসি হচ্ছে সদস্যদেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একধরনের প্রতিনিধি পরিষদ, যেখানে ‘শক্ত’ সিদ্ধান্ত নিতে গেলে প্রয়োজন সদস্যদের সম্মতি—যা প্রায় অসম্ভব।

আরও পড়ুন

ফিফা কূটনৈতিক বিবেচনায় রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চায়, তাই রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে কঠোর। আইসিসি বরং দেশগুলোর রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনে চলতে চায়।
এসব কারণেই কোনো দেশের ফুটবল ফেডারেশনের ওপর সেখানকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে ফিফা। যেটা আইসিসি পারে না।

আইসিসিতে অনেক সময়ই সংগঠনের চেয়ে ব্যক্তিকে বড় হয়ে উঠতে দেখা যায়। সেটাও আয়ের উৎসের বৈষম্যের কারণে। এই যেমন ২০১৯ বিশ্বকাপে যখন মহেন্দ্র সিং ধোনি গ্লাভসে সেনা প্রতীক লাগিয়ে মাঠে নামেন, তখন আইসিসি সেটা সরানোর ‘অনুরোধ’ করে—আদেশ দেয় না। বিসিসিআই তাতে কান না দিলে, সংস্থাটি আর উচ্চবাচ্য করেনি।

২০১৯ বিশ্বকাপে গ্লাভসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতীক লাগিয়ে খেলতে নামেন মহেন্দ্র সিং ধোনি
ছবি: এএফপি

রোববারের এশিয়া কাপের ফাইনালের পরের আরেকটি বিষয়ও দেখুন। ভারত ফাইনাল জয়ের পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘খেলার মাঠেও অপারেশন সিঁদুর। ফলাফল একই—ভারতের জয়! অভিনন্দন আমাদের ক্রিকেটারদের।’ কিন্তু খেলার মধ্যে যুদ্ধ টেনে আনার জন্য এসিসি বা আইসিসি কিছুই বলল না।

আরও পড়ুন

অথচ ইউক্রেনে দখলদারির জন্য রাশিয়াকে এবং ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার মিত্র পক্ষে থাকায় বেলারুশকে উয়েফা ও ফিফা তাদের সব ধরনের কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ করেছে। এই কঠোর নৈতিক অবস্থানই ফিফাকে অনেক আলাদা করে দিয়েছে আইসিসির চেয়ে।