উড়তে থাকা ভারতের সামনে নিউজিল্যান্ড

নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসন ও ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা।এএফপি

গতকাল দুপুরে জুহু বিচের ঐতিহ্যবাহী হোটেলে চেক ইন করলেন লন্ডনপ্রবাসী তরুণ এক ভারতীয় দম্পতি। মাঠে বসে ভারতের সেমিফাইনাল দেখবেন বলে রোমাঞ্চিত। সমস্যা একটাই, ম্যাচের টিকিট নেই। অনেক চেষ্টা করেও টিকিট কিনতে পারেননি। তারপরও এতদূর চলে এসেছেন কোনো একটা ব্যবস্থা হবেই আশা করে। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর বারবার একই অনুরোধ করে যেতে লাগলেন। দুটি টিকিট কি পাওয়া যাবে? যত টাকাই লাগুক, কোনো সমস্যা নেই।

কীভাবে বোঝাই, ‘যত টাকাই লাগুক, সমস্যা নেই’ এমন মানুষে এখন গিজগিজ করছে মুম্বাই। ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের ধারণক্ষমতা ৩৩ হাজারের মতো। আজ যেখানে থাকতে চায় ৩৩ লাখ মানুষ। অবস্থা এমন যে এই সেমিফাইনালের টিকিটকে অনায়াসেই সোনার হরিণের প্রতিশব্দ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।

আরও পড়ুন

সৌভাগ্যবান ওই ৩৩ হাজারে আজ নির্ঘাত নীল সমুদ্রের রূপ নেবে গ্যালারি। মাঠে ভারতীয় দলের সঙ্গে গ্যালারিও তাই নিউজিল্যান্ডের প্রবল প্রতিপক্ষ। টিম মিটিংয়ে কেন উইলিয়ামসন তাঁর দলকে কী বলেছেন, তা অবশ্য অনুমান করা যাচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের যে জনসংখ্যা, তাতে দেশে খেলা না হলে কোথায়ই বা গ্যালারিতে কিউইদের সংখ্যাধিক্য থাকে! ২০১৯ বিশ্বকাপে ওল্ড ট্রাফোর্ড সেমিফাইনালেও গ্যালারির ৮০ শতাংশই ছিল ভারতীয়। উইলিয়ামসন তাই এটাকে অন্যভাবে কাজে লাগাতে চাইছেন। ভারতের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। এই অভিজ্ঞতার কি কোনো তুলনা হয় নাকি! উপভোগ করো, উপভোগ করো।

গতকাল অনুশীলনে নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসন
এএফপি

চার বছর আগের সেই সেমিফাইনালের কথা ঘুরেফিরে আসছে। বৃষ্টির কারণে দুই দিনে শেষ হওয়া সেই ম্যাচ। মার্টিন গাপটিলের সরাসরি থ্রোয়ে মহেন্দ্র সিং ধোনির রান আউটে নিভে যাওয়া ভারতের আশার প্রদীপ। ভারতীয় দল ভুলে থাকতে চাইছে, কিন্তু চাইলেই কি আর তা পারা যায়! নিউজিল্যান্ডাররা যে মনে করিয়ে দিচ্ছে। খেলার এই এক মজা, অতীতের কোনো কিছু নিজেদের পক্ষে থাকলে সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলে। আর পরাজিত দল বলে যায়, অতীত তো অতীতই। এটি নতুন দিন, নতুন খেলা। অতীতের কোনো প্রভাবই এখানে নেই।

আরও পড়ুন

রোহিত শর্মাই যেমন ওই ম্যাচের প্রসঙ্গ ওঠায় দাবি করলেন, ভারতীয় ক্রিকেটারদের মনে নাকি ওই ম্যাচ একবারও উঁকি দিচ্ছে না। তা প্রমাণের চেষ্টা করতে গিয়ে উদাহরণটা কী দিলেন, জানেন? ১৯৮৩ সালে ভারত প্রথম বিশ্বকাপ জেতার সময় এই দলের কারও জন্মই হয়নি। ২০১১ সালে দ্বিতীয়বার জেতার সময় খেলাই শুরু করেনি দলের অর্ধেক খেলোয়াড়। যার মানে এত অতীত নিয়ে এত ঘাঁটাঘাঁটি করার কী আছে! কিন্তু তিনি নিজে বা বিরাট কোহলির মতো যাঁরা ওল্ড ট্রাফোর্ডেও ছিলেন, তাঁদের মনে কি ফিরে আসছে না সেই স্মৃতি? এবারও সেই একই উত্তর। আজ বা আগামীকাল কী হবে, এ নিয়েই শুধু তাঁদের কথা হয়। অতীতের প্রবেশাধিকার সেখানে নিষিদ্ধ।

গতকাল অনুশীলনে ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা
এএফপি

অতীত ফিরিয়ে আনার কাজটা খুব ভালোভাবে করেছেন রস টেলর। ওল্ড ট্রাফোর্ড সেমিফাইনালে খেলা নিউজিল্যান্ডের ব্যাটসম্যান মনে করিয়ে দিয়েছেন, সেবারও পরিস্থিতি এমনই ছিল। ভারত ছিল ইন ফর্ম দল, আর নিউজিল্যান্ডকে সেমিফাইনালে উঠতে নেট রানরেটের লড়াইয়ে নামতে হয়েছিল পাকিস্তানের সঙ্গে। এরপর এমন একটা কথা বলেছেন, যেটির উদ্দেশ্য অবশ্যই ভারতের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করা। এই বিশ্বকাপে কোনো দলকে যদি ভারত সেমিফাইনালে এড়াতে চাইত, সেটি নাকি নিউজিল্যান্ড।

আরও পড়ুন

আইসিসি টুর্নামেন্টে নিউজিল্যান্ডকে অনেক বছর হারাতে না পারার গেরো এই বিশ্বকাপেই খুলেছে ভারত। রাউন্ড রবিন লিগের নয় ম্যাচে এমন খেলেছে যে সব গেরো-টেরোই রীতিমতো উড়ে গেছে। ব্যাটিং-বোলিং দুই বিভাগেই এমন দাপুটে পারফরম্যান্স যে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও কোনো দুর্বলতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাটিং-শক্তিতে তো ভারত বরাবরই বলীয়ান। বোলিংও এবার রীতিমতো বিধ্বংসী। বোলিং–শক্তি বোঝানোর যা যা নিয়ামক আছে, সবকিছুতেই ভারত ১ নম্বরে। সবচেয়ে বেশি উইকেট (৮৫) নেওয়ায় যেমন, তেমনি ইকোনমি রেট (৪.৫), বোলিং গড় (১৯.৬) ও স্ট্রাইক রেটেও (২৬.২)।

এই বিশ্বকাপে দারুণ ফর্মে আছেন ভারতীয় বোলাররা
এএফপি

নিউজিল্যান্ড প্রথমে ব্যাটিং করলে অবশ্য এই বোলিং আক্রমণেরও বড় পরীক্ষা হবে। এই বিশ্বকাপে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের ম্যাচগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটা মঞ্চস্থ হয়ে যাচ্ছে ম্যাচ শুরুর আধঘণ্টা আগেই। প্রথমে ব্যাটিং করলে এখানে সাড়ে তিন শ রান একরকম নিয়ম। ম্যাচ জেতাটাও। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় এক সেঞ্চুরিতে শুধু অস্ট্রেলিয়া-আফগানিস্তান ম্যাচেই যার ব্যতিক্রম হয়েছে। ফ্লাডলাইটের আলোতে বল এমন এদিক-ওদিক করে যে এখানে রান তাড়া করে জেতার মতো কঠিন কাজ আর নেই। তার ওপর ভারতকে এই বিশ্বকাপে ২৭৩ রানের বেশি তাড়াই করতে হয়নি।

আরও পড়ুন

ওয়াংখেড়ে রোহিত শর্মার ঘরের মাঠ। টস নিয়ে কথাবার্তা থামিয়ে দিতে সেটিকেই তিনি বর্ম বানালেন। এই ওয়াংখেড়েকে তাঁর চেয়ে আর কে চেনে! এড়িয়ে যাওয়ার কারণটা অনুমেয়ই। যা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই, তা নিয়ে বেশি কথা বললে সেটি বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। পরে যদি টসে হেরে যান, যদি রান তাড়াই করতে হয়!

রাচিন রবীন্দ্র, ব্যাট হাতে এই বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের চমক
এএফপি

ওয়াংখেড়ে ভারতের ক্রিকেটকে যেমন দিয়েছে। তেমন কেড়েও নিয়েছে। এই মাঠেই ২০১১ বিশ্বকাপের সেই ফাইনাল। জয় এনে দেওয়া ধোনির ছক্কা গ্যালারির যেখানে পড়েছিল, সেটিকে অমর করে রাখার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আবার এই মাঠেই বিশ্বকাপের দুটি সেমিফাইনাল হয়ে আছে ভারতীয় ক্রিকেটের চরম দুঃখের গল্প। একটা ২০১৬ টি-টোয়েন্টির সেমিফাইনাল। এটা ওয়ানডে বিশ্বকাপ বলে যা বেশি প্রাসঙ্গিক নয়। ১৯৮৭ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল এমনই প্রাসঙ্গিক যে ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকায় সেই সেমিফাইনাল নিয়ে বড় একটা লেখাও ছাপা হয়েছে। যে সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের গ্রাহাম গুচ সুইপের পর সুইপ খেলে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দিয়েছিলেন ভারতকে।

ওয়াংখেড়েতে ধোনির ছক্কায় আসা বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দের পাশে গুচের সুইপে স্বপ্নভঙ্গের বেদনাও তাই আছে। আনন্দ-বেদনার পাল্লাটা আজ কোন দিকে ঝুঁকে পড়ে, কে জানে!

আরও পড়ুন