‘মাঝে মাঝে মনে হয়, মুশফিক ভাইয়ের জীবনটা খুবই একঘেয়ে’

বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে আগামীকাল ১০০তম টেস্ট খেলতে নামবেন মুশফিকুর রহিম। ১ থেকে ১০০—এই পথচলায় মুশফিককে কাছ থেকে দেখেছেন তাঁর অনেক বর্তমান ও সাবেক সতীর্থ এবং কোচ। ক্রিকইনফোতে তাঁরা বলেছেন মুশফিককে নিয়ে তাঁদের মুগ্ধতার কথা—

মুশফিককে কখনো ক্লান্ত হতে দেখিনি

তামিম ইকবাল, জাতীয় দলের সাবেক ওপেনার ও অধিনায়ক

তামিম ইকবাল, জাতীয় দলের সাবেক ওপেনার ও অধিনায়ক
প্রথম আলো

মুশফিকের জন্য এ বিশাল এক অর্জন। সে এমন একজন, যে সত্যিই বাংলাদেশের হয়ে ১০০ টেস্ট খেলার যোগ্য। তার পরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া অনেক ক্রিকেটার ১০০ টেস্ট খেলে অবসরও নিয়ে ফেলেছে। একটা সময় তো এমন ছিল যে বাংলাদেশ বছর-দুই বছরে কয়েকটা মাত্র টেস্ট খেলত।
এত টেস্ট খেলতে হলে বড় ক্যারিয়ার লাগে। সঙ্গে লাগে শৃঙ্খলা, কঠোর পরিশ্রম আর দূরদৃষ্টি। এ অর্জন দেশের প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমীর উদ্‌যাপন করার মতো। এই টেস্ট ম্যাচজুড়ে মুশফিকের প্রশংসা করা উচিত, তাকে নিয়ে উল্লাস করা উচিত। এই ম্যাচে সে ২০ রান করুক বা ২০০, কোনো রকম বিচার-বিবেচনার ঊর্ধ্বে রাখা হোক তাকে।
আমি ১৭–১৮ বছর তার সঙ্গে খেলেছি। তাকে বড় রান করতে দেখেছি। কিন্তু দীর্ঘ ইনিংস খেলার পর তাকে কখনো ক্লান্ত হতে দেখিনি। অন্য অনেক ক্রিকেটারকে দেখেছি বড় সেঞ্চুরি করার পর কেমন হাঁপিয়ে যায়, কিন্তু মুশফিক কখনো নয়। তার প্রস্তুতি, তার ক্ষুধা—এসব যেন জন্মগত অথবা সে নিজেকে ওই ভাবেই তৈরি করে নিয়েছে। আমার মনে হয় ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত তার এ ক্ষুধা থাকবে।

আরও পড়ুন

মাঝে মাঝে মনে হয়, মুশফিক ভাইয়ের জীবনটা খুবই একঘেয়ে

মুমিনুল হক, জাতীয় দলের ব্যাটসম্যান

মুমিনুল হক, জাতীয় দলের ব্যাটসম্যান
প্রথম আলো

আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে বাংলাদেশ দলের কেউ ২০ বছর ধরে খেলছেন, আর ১০০ টেস্ট খেলতে যাচ্ছেন! এত বছর ধরে এমন একজন কিংবদন্তির সঙ্গে ড্রেসিংরুম ভাগ করে নিতে পেরে আমি দারুণ খুশি।

মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, মুশফিক ভাইয়ের জীবনটা খুবই একঘেয়ে। একজন মানুষ ক্রিকেটের প্রতি এত নিয়মানুবর্তি আর নিবেদিতপ্রাণ হয় কী করে? আমরা তো কখনোই তাঁর মতো হতে পারলাম না! মাঠের বাইরে তিনি খুবই শান্ত। তাঁর খাবার, ঘুম—সবকিছুতে খুব শৃঙ্খলা। আমার মনে হয় না, ভবিষ্যতে আমরা এমন নিবেদিত ও নিয়মানুবর্তি ক্রিকেটার আর কখনো পাব।

তিনি ছোট ছোট কাজও খুব নিখুঁতভাবে করেন। দারুণ দূরদর্শী মানুষ, খুবই গোছানো। মুশফিক ভাই খুব ভালো করে জানেন, তিনি কী করতে চান। যেমন এই টেস্ট সিরিজ শেষ হওয়ার পরই; আমি নিশ্চিত, তিনি পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণের ওপর কাজ শুরু করে দেবেন। যদিও সেই সিরিজ আসতে এখনো তিন মাস বাকি! আমার মনে হয়, সেরা খেলোয়াড়েরা অনেক আগে থেকেই এমন পরিকল্পনা করে রাখেন। খুঁটিনাটি বিষয়ের দিকে তাঁর মনোযোগ অসাধারণ।

আরও পড়ুন

মুশফিকের স্লগ-সুইপ তো কিংবদন্তি

ডেভ হোয়াটমোর, জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক কোচ

ডেভ হোয়াটমোর, জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক কোচ
প্রথম আলো

মুশফিক শুরু থেকেই জানত, সে কী চায়। আর সেটা অর্জন করতে সে নিজেকে কঠোরভাবে শৃঙ্খলায় বেঁধেছে। নিজেই নিজেকে প্রেরণা দিয়েছে। তাকে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে দেখে আমি খুব খুশি। সাফল্য-ব্যর্থতা, চোট—সবকিছুর মধ্যেই সে এগিয়ে গেছে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ ছাড়ার পরও আমি নিয়মিতই তার অগ্রগতি অনুসরণ করেছি। সাকিব (আল হাসান) ও পরে তামিমকে (ইকবাল) নিয়ে সে দেশকে গর্বিত করে গেছে এবং ৫০ ওভারের ক্রিকেটেও দারুণ করেছে। তার স্লগ-সুইপ তো কিংবদন্তি।

আরও পড়ুন

মুশফিকের প্রভাব পরিসংখ্যানের চেয়েও অনেক গভীরে

চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক কোচ

চন্ডিকা হাথুরুসিংহে, বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক কোচ
প্রথম আলো

মুশফিকুর রহিম যখন বাংলাদেশের হয়ে শততম টেস্ট খেলতে নামছে, তখন বাংলাদেশ আসলে শুধু একটি সংখ্যা নয়, একজন মানুষকে উদ্‌যাপন করছে, যার প্রভাব পরিসংখ্যানের চেয়েও অনেক গভীরে।

বাংলাদেশে দুটি ভিন্ন সময়ে—প্রথমবার ২০১৪ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত, আর দ্বিতীয়বার ২০২৩ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত—মুশফিককে কোচিং করানোর সুযোগ আমার হয়েছে। দুই সময়েই যা অপরিবর্তিত ছিল, তা হলো তার পেশাদারত্ব, প্রতিশ্রুতি আর নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা।

আমি যত ক্রিকেটারের সঙ্গে কাজ করেছি, তাদের মধ্যে মুশফিক সবচেয়ে নিখুঁতদের একজন। তার প্রস্তুতি বিশ্বমানের। প্রতিদিনই একই শৃঙ্খলা, একই লক্ষ্য। ঘরের মাঠ মিরপুর হোক বা বিদেশের কোনো কঠিন কন্ডিশন, মুশফিক কখনো মান নামতে দেয়নি। মাঠে সবার আগে আসে। কন্ডিশন দেখে নেয়। প্রতিটি সেশন যেন উদ্দেশ্যপূর্ণ হয়, সেটাও নিশ্চিত করে। তরুণ ক্রিকেটাররা শুধু তাকে দেখলেই সত্যিকারের পেশাদারত্বের শিক্ষা পেয়ে যাবে।

দক্ষতা আর মানসিক দৃঢ়তার বাইরে যে জিনিসটা সবচেয়ে চোখে পড়ে, সেটা তার চরিত্র। আমি বিশ্বে যত দলে কোচিং করিয়েছি, মুশফিক তাদের মধ্যে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও খাঁটি নেতাদের একজন। সে শুধু কথায় নয়, কাজের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেয়। সে যখন কথা বলে, খেলোয়াড়েরা মনোযোগ দিয়ে শোনে। কারণ, তারা জানে, তার প্রতিটি কথা দলের জন্যই।

যেকোনো ক্রিকেটারের জীবনে ১০০ টেস্ট বিশাল অর্জন। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা এমন গর্বিত ও বিনয়ী কারও জন্য এটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। মুশফিকুর রহিম গভীর ভালোবাসা, শৃঙ্খলা আর অটল নিষ্ঠার সঙ্গে একটি জাতির স্বপ্নকে বয়ে নিয়ে চলেছে। তার এ পথচলা শুধু প্রতিভার প্রমাণ নয়, এটি অক্লান্ত পরিশ্রম আর খেলার প্রতি গভীর ভালোবাসার এক গল্প।

এ ঐতিহাসিক দিনে তাকে অভিনন্দন জানাই। শুধু একজন সাবেক কোচ হিসেবে নয়; বরং একজন পেশাদার ও মানুষ হিসেবে তার প্রতি আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা থেকেও। বাংলাদেশ ক্রিকেট তাকে পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। তার রেখে যাওয়া কীর্তি আরও বহু প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। অভিনন্দন, মুশফিক। তুমি এই প্রতিটি মুহূর্তের যোগ্য।

আরও পড়ুন

মুশফিক আমাদের ‘মিস্টার ক্রিকেট’, আমাদের মাইক হাসি

হাবিবুল বাশার, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক

হাবিবুল বাশার, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক
প্রথম আলো

মুশফিক সত্যিকারের এক কিংবদন্তি। তার জন্য আমি খুবই, খুবই গর্বিত। সে দারুণ কাজ করেছে। এটা অনেক বড় ব্যাপার। ১০০ টেস্ট খেলতে হলে পারফর্ম করতে হয়। দীর্ঘ সময় ধরে সেই কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়। একটা সময় আসে যখন মন চায় না, শরীরও আর চলতে চায় না। নিজেকে বলতে ইচ্ছা হয়, ‘আর না, যথেষ্ট হয়েছে।’ আমার মনে হয় না, মুশফিকুর রহিমের অভিধানে ‘আর না’ বা ‘যথেষ্ট হয়েছে’—এই শব্দগুলোর কোনো অস্তিত্ব আছে। সে আমাদের ‘মিস্টার ক্রিকেট’, আমাদের মাইক হাসি।

আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে ইংল্যান্ড, ভারত বা অস্ট্রেলিয়ার মতো বাংলাদেশ তত বেশি টেস্ট খেলার সুযোগ পায় না। তবু এত দীর্ঘ সময় ধরে নিজের আগ্রহ আর নিবেদন ধরে রাখা—এটাও এক বড় অর্জন। তার আবেগ, তার ভালোবাসা—এসবই তাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দিয়েছে। আমি চাই, সে আরও অনেক দিন খেলুক।

আরও পড়ুন