মাত্র তিন দিন একজন মানুষের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য যথেষ্ট নয়। তা–ও খেলাটেলা ছেড়ে দিয়ে তাঁর পরিচয়টা সাবেক ক্রিকেটারই থেকে গেলে একটা কথা ছিল। ইমরান খান পরে ঢুকেছেন রাজনীতিতে, হয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, আর এখন রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির অর্থ তোশাখানায় জমা না দেওয়ার অদ্ভুত এক অভিযোগে আটক হয়ে দিন কাটাচ্ছেন জেলে।
পাকিস্তানের ক্রিকেট বললে যতই তাঁর নাম সবার আগে উচ্চারিত হোক, যতই গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের সুলতান এফ হোসেন মিডিয়া হলের দরজার পাশে শোভা পাক বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে তাঁর ছবি; রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর ইমরান খানকে নিয়ে দুই রকম আলোচনা থাকাটাই স্বাভাবিক।
তবে অস্বাভাবিক হলেও সত্যি—লাহোরে কাটানো তিন দিনে এমন একজন মানুষ পাইনি, যাঁর মুখে ইমরান খানের সমালোচনা শুনেছি। খুঁচিয়ে-টুচিয়েও কারও কাছ থেকে ‘ইমরান খারাপ’ কথাটা শোনা যায়নি। পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জেতানো ইমরান আর পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের ইমরানের মর্যাদা তাঁদের কাছে একই—পাকিস্তানের বীর, ‘দ্য লায়ন’। এখন শুধু অপেক্ষা খাঁচায় বন্দী সিংহের বের হয়ে আসার।
পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জেতানো ইমরান আর পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের ইমরানের মর্যাদা তাঁদের কাছে একই—পাকিস্তানের বীর, ‘দ্য লায়ন’। এখন শুধু অপেক্ষা খাঁচায় বন্দী সিংহের বের হয়ে আসার।
ইমরান খান জেলে গেছেন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে। জেলে তিনি গিয়েছিলেন এর আগেও। প্রতিবাদ-বিক্ষোভে তখন উত্তাল হয়েছিল পাকিস্তান। এবার তত বেশি জ্বালাও-পোড়াও না হলেও প্রতিবাদ কমও হয়নি। আটক হওয়ার পর ইমরান সমর্থকদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাঁরা যেন ঘরে বসে না থাকেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন শান্তিপূর্ণভাবে। কিন্তু গ্রেপ্তার আতঙ্কে তাঁর ডাকে নেতা-কর্মীরা তেমন সাড়া দিতে পারেননি। অনেকেই আছেন পলাতক।
তেহরিক-ই-ইনসাফের নেতা হিসেবে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেও সেটা শেষ পর্যন্ত একটা রাজনৈতিক দলই। এর সমর্থক যেমন থাকবে, প্রতিপক্ষও থাকবে। কিন্তু পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জেতানো যে ইমরান, তাঁর কোনো প্রতিপক্ষ গোটা পাকিস্তানেই আছে বলে মনে হয় না।
লাহোরে যাঁর সঙ্গেই ইমরান খানকে নিয়ে কথা হয়েছে, ইমরানের প্রতি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি তাঁদের কথায়। করাচি থেকে লাহোরে খেলা দেখতে আসা এক ভদ্রলোক ইমরানের গ্রেপ্তার নিয়ে বলছিলেন, ‘তাঁকে কেন আটক করা হয়েছে, সেটা আপনারাও বোঝেন। সামরিক বাহিনীর মন জুগিয়ে চলা লোক নন ইমরান। দেশ নিয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে, ভালোবাসা আছে। সেটাই হয়তো পছন্দ নয় অন্যদের।’
ভদ্রলোক পেশায় একজন শিক্ষক, গুছিয়ে কথা বলতে জানেন। কিন্তু সব সাধারণ মানুষ তো আর সেভাবে বলতে পারেন না। তাঁদের অনেকেরই সহজ–সরল চিন্তা, ইমরান খানকে বেশি দিন আটকে রাখা যাবে না। কারণ, সৃষ্টিকর্তা ভালো মানুষকে সাহায্য করেন। আর ইমরান ভালো মানুষ। কারও ‘ধান্দা’র সঙ্গী হতে চাননি বলেই আজ তিনি জেলে।
ইমরান খান নিজেও লাহোরের মানুষ। লাহোর ক্যানেল লাগোয়া জামান পার্কে তাঁর পৈতৃক বাড়ি, জন্মও সেখানে। বেড়ে ওঠাও। লাহোরের বাইরে থেকে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন দিলবার নামের মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক। ক্রিকেটার ইমরান এবং রাজনীতিক ইমরানের কট্টর সমর্থক। জামান পার্ক কোন দিকে জানতে চাইলে ভদ্রলোক যেভাবে সব বর্ণনা দিতে শুরু করলেন, তাতে মনে হলো ইমরান খান, তাঁর ঘরবাড়ি, তাঁর জীবন—সবই বুঝি দিলবারের চোখের সামনে ভাসছে!
আলোচনাটাকে আরও জীবন্ত করতেই কি না, দিলবার পাঞ্জাবির পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করলেন। তারপর দেখাতে লাগলেন একের পর এক ছবি আর ভিডিও ক্লিপ। সবই ইমরান খানের বাড়ির সামনে প্রতিবাদ, স্লোগান আর মিছিলের।
গ্রেপ্তারের আগে সবাই যখন ইমরানের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায়, তেহরিক-ই-ইনসাফের অনেক সমর্থক দিন-রাত ইমরানকে পাহারা দিতে তাঁর বাড়ির সামনে ভিড় করে থাকতেন। দিলবার তাঁদেরই একজন। নেতার প্রতি এতটাই আস্থা যে ভবিষ্যতে আবারও ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে তাঁর অটল বিশ্বাস, ‘খান সাহেবকে ওরা বেশি দিন আটকে রাখতে পারবে না। আর যদি রাখে, তাতেও সমস্যা নেই। সবাই জানে নির্বাচন দিলে আবার খান সাহেবই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন।’
ইমরান খানের আগে লাহোরের আরেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার আবদুল হাফিজ কারদারও পরে রাজনীতিতে এসেছিলেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতির। হাফিজ কারদার হয়ে পরবর্তী সময়ে সেলিম আলতাফ, ইমরান খান, আবদুল কাদির, ওয়াসিম আকরাম, মোহাম্মদ ইউসুফ, আবদুল রাজ্জাকদের হাত ধরে বর্তমান অধিনায়ক বাবর আজম, ফাহিম আশরাফ, ইমাম-উল–হক, আগা সালমান—সবাই লাহোরের সমৃদ্ধ ক্রিকেট ইতিহাসের সাক্ষী। ইমরানের মতোই গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের দেয়ালে দেয়ালে তাঁদের উপস্থিতি।
তাঁদের মধ্যে প্রবল ব্যতিক্রম ইমরান খান, যাঁর বিরুদ্ধে এখন ‘চুরি’র অভিযোগ। তিনি নাকি রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির অর্থ সরকারের তোশাখানায় জমা দেননি! অভিযোগ সত্যি কি না, বলবে আদালত। তবে পাকিস্তানের মানুষকে ১৯৯২ সালে ইমরান যে উপহারটা এনে দিয়েছিলেন, সেই বিশ্বকাপ ট্রফি এখনো রাখা আছে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের পাশের ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমির জাদুঘরে।
না, বিশ্বকাপ ট্রফিটা অন্তত চুরি করে বেচে দেননি ‘দ্য লায়ন অব পাকিস্তান ক্রিকেট’ ইমরান খান।