বোথামের দুষ্টুমি: অ্যালসেশিয়ান কুকুর দিয়ে গাভাস্কারকে ফোনবুথে আটকে রাখার গল্প

ক্রিকেটমহলে একটা কথা আছে, আপনি যদি স্যার ইয়ান বোথামের আশপাশে থাকেন, আপনার জীবন কখনো একঘেয়ে বা নীরস হতেই পারে না! ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সেরা অলরাউন্ডার, সম্ভবত সেরা ক্রিকেটার এবং অন্যতম সেরা এই ক্রীড়াবিদ তাঁর বন্ধু ও সতীর্থদের কাছে পরিচিত ‘বিফি’ নামে। মাঠে ও মাঠের বাইরে তাঁর মতো বর্ণাঢ্য চরিত্র ক্রিকেট ইতিহাসেই বিরল। ‘বিফি’স ক্রিকেট টেলস: মাই ফেবারিট স্টোরিস ফ্রম অন অ্যান্ড অফ দ্য ফিল্ড’—বইটাও যেন বোথামের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। বন্ধু, সতীর্থ, প্রতিপক্ষ—সবার গল্প নিয়ে বোথামের পছন্দের এক সংকলন। যে গল্পগুলো পাঠক হিসেবে আপনাকে কখনো হাসাবে, কখনো মনে করিয়ে দেবে—ক্রিকেট মানে শুধু রান আর উইকেট নয়, এর চেয়ে বেশি কিছু।
বইটির আরেকটা বিশেষত্ব হচ্ছে, যিনি গল্প বলছেন, শুরুতে বোথাম তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন নিজের মতো করে। সেটাও বেশ আকর্ষণীয়। বন্ধু, সতীর্থ, প্রতিপক্ষ—কার সম্পর্কে বোথাম কী ভাবেন, সেটা বোঝা যায় সেই পরিচয়পর্বে।

পাঠকদের জন্য আজ থাকছে ‘বিফি’স ক্রিকেট টেলস: মাই ফেবারিট স্টোরিস ফ্রম অন অ্যান্ড অফ দ্য ফিল্ড’ বই থেকে ক্রিকেটের আরেক কিংবদন্তি ও সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কারের কিছু মজার স্মৃতি।

ইয়ান বোথামের চোখে সুনীল গাভাস্কার

ক্রিকেট খেলতে খেলতেই কত যে বন্ধু বানিয়েছি, নাম মনে করতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার দশা। আবার ভাববেন না যে মাথাটা মাঝেমধ্যে ব্যবহার করতে যাই বলেই এ রকম হয়। আসলেই আমার বন্ধুদের সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। তবে একজন বন্ধু, যাকে আমি কখনো ভুলব না, ভুলতে চাইও না, সে হলো সুনীল গাভাস্কার—‘অরিজিনাল লিটল মাস্টার’।
অসাধারণ এক ব্যাটসম্যান। অবিশ্বাস্য টেকনিকের সঙ্গে সাধু-সন্ন্যাসীর মতো ধৈর্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা উইকেটে পড়ে থাকতে পারত, যতক্ষণ না তার দল একটা ভালো অবস্থানে পৌঁছায়।

প্রতিপক্ষ হলেও বোথাম-গাভাস্কার ছিলেন ভালো বন্ধু
উইজডেন ক্রিকেট

গাভাস্কার আর জিওফ বয়কটদের মতো ব্যাটসম্যানরা ছিল বোলারদের প্রিয় বন্ধু! কারণ, তারা যখন ব্যাট করত, তখন আপনি নিশ্চিন্তে পা তুলে বিশ্রাম নিতে পারতেন। তবে সমস্যা হতো যখন আপনি প্রতিপক্ষ দলে থাকতেন। সারা দিন তাদের বল করে যেতে হতো, করেই যেতে হতো।
মাঠের বাইরেও গাভাস্কার একজন চমৎকার মানুষ। যখনই আমাদের দল মুখোমুখি হতো, আমরা অবশ্যই খেলার ফাঁকে সময় বের করে গল্পগুজব করতাম। এখনো করি। আর মুম্বাইয়ের ‘তৃষ্ণা’ রেস্তোরাঁয় সানির (গাভাস্কার) সঙ্গে খেতে যাওয়ার চেয়ে বড় আনন্দ এই দুনিয়ায় আর কিছু নেই। ভারতের সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায় সেখানে।

আরও পড়ুন

গাভাস্কারের মুখে তাঁর মজার কিছু স্মৃতি

ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলাটা মাঝেমধ্যে খুব চাপের। আপনি ব্যাট করতে নামবেন, কোটি কোটি মানুষের প্রত্যাশা আপনার কাঁধে। বিশেষ করে যখন সবকিছু ঠিকঠাক চলে না, তখন এর চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। তবে সৌভাগ্যবশত ভারতীয় দল বছরের পর বছর ধরে অনেক সাফল্য উপভোগ করেছে এবং যখন আপনি সেটার অংশ হবেন, এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। এখনো যখন আমি বর্তমান প্রজন্মকে ভালো খেলতে দেখি এবং মানুষের জীবনে এর কী দারুণ প্রভাব পড়ে, সেটা খেয়াল করি, তখন বুঝতে পারি—এটা শুধুই একটা খেলা নয়।

মাঠে ও মাঠের বাইরে মজা করতে খুব পছন্দ করতেন গাভাস্কার
উইজডেন ক্রিকেট

তবে এসব চাপটাপ ভুলে থাকার একটা জায়গা ছিল—ড্রেসিংরুম। বাইরের উত্তাপ থেকে যেন নিরাপদ আশ্রয়। সে কারণে ওই পরিবেশ আমার খুব ভালো লাগত। পেশাদার ক্রিকেটার হওয়ার আগে আমি একটা সিমেন্ট কোম্পানিতে কাজ করতাম। তাই আমি জানতাম, সাধারণ মানুষের জীবন কেমন হয়। কখনো ভাবিনি যে ক্রিকেটই আমার জীবন হয়ে যাবে এবং সেটার বদৌলতে আমি আমার পরিবারের দেখভাল করতে পারব।

আরও পড়ুন

মাঠে আমি আমার কাজটা যতটা সিরিয়াসলি নিতাম, ততটাই মজা করতেও ভালোবাসতাম। সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতাম ড্রেসিংরুমে। আমার যেকোনো সতীর্থকে জিজ্ঞেস করলেই বলবে, ওদের সঙ্গে আমি অনেক মজা করতাম। আসলে এটাই ছিল আমার টেনশন কমানোর উপায়।
ছোটবেলা থেকেই আমি মুখোশের ভক্ত ছিলাম, বিশেষ করে হ্যালোইনের সময়কার ভয়ংকর সব মুখোশ। একবার নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে এক দোকানে পেয়ে গেলাম দারুণ সব মুখোশ। এর মধ্যে একটা ছিল ভীতিকর—টাক মাথা, পাশ থেকে সাদা চুল—একদম হাল্ক হোগানের মতো! সঙ্গে সঙ্গেই কিনে নিলাম।

টেস্টে ব্যাটিং করছেন গাভাস্কার
বিসিসিআই

আমরা ছিলাম অকল্যান্ডের একটা হোটেলে। প্রতিটি রুমের সঙ্গে একটা করে ব্যালকনি। তবে সেই ব্যালকনিগুলো এত কাছাকাছি ছিল যে সহজেই একটা থেকে অন্যটায় চলে যাওয়া যেত।
তো একদিন বিকেলে অনুশীলনের পর আমি আমার মুখোশটা পরলাম, নিজেকে একটা সাদা চাদরে মুড়িয়ে নিলাম। তারপর ব্যালকনি দিয়ে পাশের রুমে চলে গেলাম। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, আমার এক সতীর্থ শাওয়ার থেকে মাত্র বেরিয়েছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। কোমরে একটা তোয়ালে জড়িয়ে সে খুব খুশি হয়ে নিজের পেশি দেখছিল। ঠিক তখনই আমি জানালায় টোকা দিলাম।

আরও পড়ুন

মুখোশ পরা আর সাদা চাদরে মোড়ানো আমাকে দেখে এতটাই ভয় পেয়ে গেল যে এক দৌড়ে আরেক সতীর্থের রুমে ঢুকে গেল। ভাগ্য ভালো যে তখন আমরা সবাই আমাদের রুমের দরজা খোলা রাখতাম। কারণ, সে দৌড়ানোর সময় তার তোয়ালেটা পড়ে গিয়েছিল এবং সেটা তোলার মতো সাহসও তার ছিল না! নগ্ন ওই সতীর্থকে তখন বোঝাতে হচ্ছিল কেন সে হঠাৎ আরেকজনের রুমে ঢুকে পড়েছে!

আরও পড়ুন

ততক্ষণে আমি ব্যালকনি দিয়ে নিজের রুমে ফিরে মুখোশ আর চাদরটা খুলে ফেললাম। তারপর বাইরে বেরিয়ে জানতে চাইলাম, কী হয়েছে? কিন্তু হাসি চেপে রাখতে না পেরে ধরা পড়ে গেলাম! সেই সতীর্থের নাম বলা যাবে না। কারণ, সে এখন বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্বে আছে; তবে হ্যাঁ, এখনো সে ওই ঘটনার কথা মনে রেখেছে!

মজার শিকার হওয়ার চেয়ে মজা করতে পারাটা সব সময়ই ভালো। তাই আমি নিশ্চিত করতাম যেন নিজে কিছু মজা করতে পারি। তবে ১৯৮০ সালে আমার একমাত্র ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেট মৌসুমে আমিও একটা মজার শিকার হয়েছিলাম। আর সেটা হয়েছিলাম ইয়ান বোথামের কাছে।
ভিভ রিচার্ডস তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ইংল্যান্ড সফরে খেলছিল, তাই আমাকে সমারসেটের হয়ে খেলার জন্য ডাকা হলো। আমিও সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। বোথামও তখন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলছে। তবে জাতীয় দলের হয়ে খেলার ফাঁকে ফাঁকেই সেই কাউন্টির হয়ে দু-একটা ম্যাচ খেলে যেত। এর আগের বছরই আমরা ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিলাম। তখন ‘বিফি’র সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল, আমরা একসঙ্গে বেশ ভালো কিছু সময় কাটিয়েছিলাম। সে আমার চেয়ে বেশি মজা করতে পছন্দ করত।

গাভাস্কারের মতোই মজা করতে পছন্দ করতেন ইয়ান বোথামও
সমারসেট কাউন্টি ক্লাব

ছোটবেলা থেকেই কুকুর আমার অপছন্দ। কোনো খারাপ অভিজ্ঞতার কারণে নয়, এমনিতেই একটু ভয় কাজ করত। এখনো আমার কুকুর খুব একটা ভালো লাগে না। রবি শাস্ত্রীর বাড়িতে ‘বাউন্সার’ ও ‘বিমার’ নামে দুটি কুকুর আছে এবং বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানের মতোই আমি তাদের খুব বেশি পছন্দ করি না! তো গল্প করতে করতেই আমি একবার বিফিকে আমার ‘কুকুরভীতি’র কথা বলেছিলাম। কে জানত, সে তখনই আমার সঙ্গে একটা মজা করার পরিকল্পনা করে রেখেছিল।

আরও পড়ুন

সেই সময় মোবাইল ফোন ছিল না। কোথাও ফোন করতে হলে ক্লাব অফিসের ফোন ব্যবহারের অনুমতি নিতে হতো। নইলে ক্লাবের পেছনে রেড ফোনবুথে যেতে হতো। তো একদিন ম্যাচের বিরতিতে আমি ফোনবুথে গিয়ে কিছু কল করলাম। আমি ভেতরে থাকতেই বিফি তার অ্যালসেশিয়ান কুকুরটাকে নিয়ে এসে ফোন বুথের দরজার বাইরে রেখে চলে গেল!

আমি পড়ে গেলাম ফাঁদে! কুকুরটা দরজায় বসে, আমি বেরোতে পারছি না! কিছুক্ষণ পর তিন-চারজন লোক এসে ফোন ব্যবহারের জন্য লাইনে দাঁড়াল। অপেক্ষা করতে করতে একসময় তারা চিৎকার শুরু করল, ‘বেরিয়ে আসো।’
কিন্তু আমি বের হচ্ছি না। সোজা বলে দিলাম, ‘কুকুরটা না সরালে আমি বের হব না!’ কিন্তু কেউই কুকুর সরাতে রাজি নয়। কারণ, সেটা তাদের না। প্রায় ২০ মিনিট আমি ফোনবুথে আটকে ছিলাম। অবশেষে বিফি এল—হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, ‘কী সমস্যা?’
আমার খুব রাগ হচ্ছিল। বললাম, ‘তোমার কুকুরটা সরাও!’
সে আবার যাওয়ার ভান করতেই আমি কাতর হয়ে বললাম, ‘বিফি! বিফি! প্লিজ!’
সে হেসে বলল, ‘শুরুতে “প্লিজ” বললেই তো হতো!’ তারপর তার কুকুরটাকে সরিয়ে নিয়ে আমাকে বের হতে দিল।

আরও পড়ুন

অন্য কেউ আমার সঙ্গে এ রকম করলে আমি সাধারণত প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ করতাম। কিন্তু লোকটা বিফি। সে এত বড় কুকুরপ্রেমী যে পরেরবার হয়তো আমাকে শায়েস্তা করতে কুকুরের পুরো ব্যাটালিয়ন নিয়ে আসবে।
ওই চিন্তা বাদ দিয়ে তাই বিফির কাছে কৃতজ্ঞ থাকারই সিদ্ধান্ত নিলাম।

আরও পড়ুন