হাথুরুসিংহেই নতুন কোচ—বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো হবে না খারাপ?

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে আবারও ফিরছেন চন্ডিকা হাথুরুসিংহেশামসুল হক

আবারও তাহলে হাথুরু–যুগেই ফিরে যাচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেট? হাথুরু মানে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে। অনেক বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ায় বসতি গড়া শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট কোচ। বাংলাদেশের ক্রিকেট ফিরে যাচ্ছে কথাটাও ঠিক, তবে এভাবে বললে মনে হয় আরও ভালো হয়—আবার ফিরে আসছেন হাথুরুসিংহে। ফিরছেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবেই। বছর পাঁচেক আগে যে দায়িত্বটা তিনি নিজেই ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। সেই যাওয়াটা মোটেই শোভন ছিল না।

হয়তো, সম্ভবত—এসব শব্দ ব্যবহার করে নিরাপদ থাকার বদলে সরাসরি এভাবে লিখে দেওয়ার কারণ, হাথুরুসিংহের ফেরাটা এখন শুধুই আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপার। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা বেশ আগেই শেষ হয়ে গেছে। চূড়ান্ত হয়ে গেছে বেতন–ভাতা ও অন্যান্য বিষয়ও। এখন শুধু চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করাটাই বাকি। চায়ের কাপ আর ঠোঁটের দূরত্বও অনেক সময় অনতিক্রম্য হয়ে যায়। এখানেও তেমন কিছু না হলে এই মাসের শেষেই হাথুরুসিংহেকে বাংলাদেশে দেখা যাবে।

রাসেল ডমিঙ্গো পদত্যাগ করার পর তৎপরতা বেড়েছে, তবে নতুন কোচ খোঁজার কাজটা তলেতলে অনেক দিনই চলছিল। হাথুরুসিংহের সঙ্গে কথাবার্তাও। নতুন কোচ নির্বাচনে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসানের ভূমিকাই প্রধান, হাথুরুসিংহেকে যাঁর খুব পছন্দ। বাংলাদেশে হাথুরুসিংহের প্রথম ইনিংসে খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্কটা মিশ্র হলেও বোর্ড সভাপতির সঙ্গে রসায়ন বরাবরই মধুর ছিল। হাথুরুসিংহের ফিরে আসায় যা অবশ্যই ভূমিকা রাখছে।

দেশের মাটিতে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া এবং কলম্বোতে শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় আছে বাংলাদেশের, হাথুরুসিংহের সময়েই
শামসুল হক

বিসিবির হাতে খুব বেশি বিকল্পও অবশ্য ছিল না। নামী ক্রিকেট কোচদের অনেকেই এখন জাতীয় দলের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব নিতে একটু অনাগ্রহী। আইপিএল আছে, আরও অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ—এসবে কাজ করলে পরিবারকে দেওয়ার জন্য অঢেল সময় পাওয়া যায়। অর্থকড়িও ভালো। যে কারণে জাতীয় দলের কোচ হওয়ার প্রস্তাব পেলে তাঁরা আইপিএলের সময় ছুটির দাবি জানিয়ে রাখেন। কেউ কেউ আবার সারা বছর কাজ করতে চান না। টম মুডিই যেমন বছরে ১০০ দিনের বেশি কাজ না করার শর্ত দেওয়ায় বিসিবির সঙ্গে তাঁর আলোচনা আর এগোয়নি। কোচ হিসেবে বিসিবির পছন্দের সংক্ষিপ্ত তালিকায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র হাথুরুসিংহেকেই সারা বছর পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে। সভাপতির পছন্দের সঙ্গে এটাও যোগ হয়ে শেষ পর্যন্ত তাই আবারও ‘হাথুরু–যুগে’ ফিরে যাওয়া। আরেকটা কারণও আছে। বিসিবির একটা অংশের বিশ্বাস, বাংলাদেশ দলের জন্য ডমিঙ্গোর মতো ‘নরম-সরম’ কোচ দিয়ে কাজ হবে না। এখানে প্রয়োজন হাথুরুসিংহের মতো ‘কড়া হেডমাস্টার’।

বিসিবিতে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা মনে করেন, মাশরাফিকে চাপ দিয়ে আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি থেকে সরিয়ে দিয়ে হাথুরুসিংহে বড় একটা ক্ষতি করেছেন।
প্রথম আলো

ডমিঙ্গোর শেষ সময়ে বাংলাদেশ দলের কোচের দায়িত্বটা লাল বল আর সাদা বলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। শ্রীধরন শ্রীরাম সাদা বলের কোচ হিসেবে যা করেছেন, তাতে বিসিবি সন্তুষ্টই বলা যায়। শ্রীধরন শ্রীরামকেও তাই পেতে চায় বিসিবি, তবে ‘এক কোচই ভালো’ উপলব্ধির কারণে সহকারী কোচ হিসেবে। বকলমে টি–টোয়েন্টি দলের হেড কোচের দায়িত্ব পালন করার পর শ্রীরাম সহকারী কোচ হতে রাজি কি না, তা স্পষ্ট করে বলেননি এখনো। আইপিএলের দল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর সঙ্গে চুক্তি নবায়ন না হলে হয়তো রাজি হয়েও যেতে পারেন।

আরও পড়ুন

হাথুরুসিংহের সঙ্গে শ্রীরাম থাকবেন কি থাকবেন না, এটা পরের আলোচনা। তাহলে এখনকার আলোচনাটা কী? সেটির বিষয় অবশ্যই প্রায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়া হাথুরুসিংহের প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ভালো হচ্ছে না খারাপ। সরাসরি উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে কিছু প্রশ্ন তো তোলাই যায়। কোচের সাফল্য–ব্যর্থতা পরিসংখ্যানেই লেখা থাকে। হাথুরুসিংহেকেও তা দিয়ে বিচার করা যাবে একসময়। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে তাঁর প্রথম দফার সময়টাও যেমন লেখা আছে পরিসংখ্যানে। বেশ কিছু সাফল্যও। ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছে বাংলাদেশ, ২০১৭ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল। ওয়ানডে–সাফল্যের তালিকায় আছে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা তিনটি ওয়ানডে সিরিজ জয়ও। টেস্ট ক্রিকেটেও বলার মতো তিনটি জয়—দেশের মাটিতে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া এবং কলম্বোতে শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কা। গত বছরের শুরুতে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর আগপর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের সেরা তিন জয় হিসেবে এই তিনটিই আসত।

বিসিবিতে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা মনে করেন, মাশরাফিকে চাপ দিয়ে আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি থেকে সরিয়ে দিয়ে হাথুরুসিংহে বড় একটা ক্ষতি করেছেন। যেভাবে বাংলাদেশকে পরিত্যাগ করেছিলেন, তা নিয়ে ক্ষোভ থাকা তো খুবই স্বাভাবিক।

রেকর্ড বিচারে হাথুরুসিংহের সময়টাকে তাই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা বলতেই পারেন কেউ। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের সেই সময়কার দলটাও সম্ভবত ইতিহাসের সেরা। সাকিব তখন সামর্থ্যের চূড়ায়। মাশরাফি বিন মুর্তজা, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহও তা–ই। ওয়ানডে–সাফল্যে হাথুরুসিংহের কোচিং ও পরিকল্পনার অবদান অবশ্যই ছিল, তবে মাশরাফির নেতৃত্বগুণের তার চেয়ে অনেক বেশি। টেস্টে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় দুটিও এসেছিল ভয়াবহ টার্নিং উইকেটের কল্যাণে। দেশের মাটিতে ডিজাইনার পিচ তৈরি করার চলটা হাথুরুসিংহের সময়েই। তাতে তাৎক্ষণিক ফল এলেও দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ক্ষতি হয়েছে কি না, এই প্রশ্ন অবশ্যই তোলা যায়।

আরও পড়ুন

ক্রিকেটের প্রচলিত অনেক নিয়মনীতিই যে বাংলাদেশে ভেঙে পড়েছে, সেটির শুরুও হাথুরুসিংহের সময়েই। বোর্ড সভাপতির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এবং তাঁকে প্রভাবিত করার সুযোগ নিয়ে ক্রিকেট অপারেশন্স ও নির্বাচক কমিটির মিলিত শক্তির চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দল নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা সেই যে জগাখিচুড়ি হয়ে গেল, সেটির জের এখনো চলছে। ক্রিকেটারদের ‘লাইনে’ রাখার ব্যাপারে তাঁর কথিত যে ‘সুনাম’, সেটির পদ্ধতি নিয়েও বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে যথেষ্টই অসন্তোষ ছিল। হাথুরুসিংহের ফিরে আসার খবরে বাংলাদেশের সিনিয়র খেলোয়াড়দের কেউই আনন্দে গদগদ হবেন বলে মনে হয় না। আপত্তি না উঠলেই বরং অবাক হব।

তিন বছরের চুক্তির অর্ধেক পথেই হাথুরুসিংহেকে বিদায় করে দেয় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট
শামসুল হক

বিসিবিতে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা মনে করেন, মাশরাফিকে চাপ দিয়ে আন্তর্জাতিক টি–টোয়েন্টি থেকে সরিয়ে দিয়ে হাথুরুসিংহে বড় একটা ক্ষতি করেছেন। যেভাবে বাংলাদেশকে পরিত্যাগ করেছিলেন, তা নিয়ে ক্ষোভ থাকা তো খুবই স্বাভাবিক। মনে আছে তো আপনার? ২০১৭ সালের নভেম্বরে দল নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়েছিলেন, সেখান থেকেই ই–মেইলে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন হাথুরুসিংহে। কারণটা পরিষ্কার হয়ে যায় পরের মাসেই, যখন শ্রীলঙ্কার নতুন কোচের নাম ঘোষণা করা হয়। কারণটা যে শুধুই নিজের দেশকে কোচিং করানোর স্বপ্নপূরণ নয়, সেটি বুঝতেও বেশি সময় লাগেনি। বাংলাদেশে যা পেতেন, শ্রীলঙ্কায় তার প্রায় দেড় গুণ টাকা—এই কারণেই পেশাদারত্বকে অমন বিসর্জন। টাকার অঙ্কটা শ্রীলঙ্কান ক্রীড়ামন্ত্রীর কল্যাণেই গোপন থাকেনি। ২০১৯ বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর কথায়–কথায় তিনি হাথুরুসিংহের মাসে ৪০ হাজার ডলার বেতন নিয়ে খোঁটা দিতেন। শেষ পর্যন্ত তো তিন বছরের চুক্তির অর্ধেক পথেই হাথুরুসিংহেকে বিদায় করে দেয় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট। এর আগে কিছুদিন ‘ওএসডি’ করেও রাখা হয়েছিল তাঁকে।

নিয়তির এমনই খেলা, যে টাকার জন্য হাথুরুসিংহে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে পরিত্যাগ করেছিলেন, পাঁচ বছর পর সেখানেই ফিরতে হচ্ছে সেই সময়ের চেয়েও কম টাকায়!