ক্রিকেট সুন্দর জেমাইমাদের প্রেমে পড়লে

জেমাইমা রদ্রিগেজপ্রথম আলো গ্রাফিকস

ক্রিকেট সুন্দর। এই সৌন্দর্যের সঠিক ব্যাখ্যা হয় না। ঠিক যেভাবে বুকের ভেতরে শান্তি শান্তি ভাবটা ভাষায় পুরোপুরি প্রকাশ করা যায় না, তেমনি সেই শান্তি কখনো কখনো জলের আকৃতি নিয়ে চোখ বেয়ে নেমে এলে তার চেয়ে সুন্দর দৃশ্যও বোধ হয় আর হয় না।

কাল রাতে জেমাইমা রদ্রিগেজের চোখে চোখ রাখলে আপনি টের পেতেন, পৃথিবীতে এমন সব সুখের কান্না আছে, যা দিঘির টলটলে জলের চেয়েও সুন্দর। কেমন শান্তি শান্তি লাগে। মনে হতে পারে জেমাইমারা আছেন বলেই ক্রিকেট সুন্দর।

এই সুন্দরের আসলেই কোনো ব্যাখ্যা হয় না। যেমন হয় না ওয়ানডেতে ৫১টি সেঞ্চুরি করা বিরাট কোহলি যখন টানা দুই শূন্যের পর এক রান করে ব্যাট তোলেন—সেই সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা। ১৪১ কিলোমিটার গতির ইয়র্কারের আঘাতে হাঁটতে না পারা শামার জোসেফ যখন ৭ উইকেট নিয়ে দলকে জেতান, তখন সেই সৌন্দর্যকে কী বলবেন? রক্তাক্ত আঙুলে তানপুরায় তোলা সুর? তবু কি এতটুকু বলে আশ মেটে? রেশ থেকে যাওয়া সেই চিরকালীন অতৃপ্তিটুকুর জন্যই ভেতরে–ভেতরে প্রচুর বদহজমের শিকার হয়েও মনে হতে পারে, ক্রিকেটকে ভালোবেসে আপনি ভুল করেননি।

অতি ক্রিকেটের বদহজম

এত ভালোবাসার ক্রিকেট আসলে ভুগছে বদহজমে। কারণ, অতিশয় মাত্রার ক্রিকেট। ভুল করেও টেলিভিশন চ্যানেল পরিবর্তন করলে খেলা চলে আসে। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের যেন কোনো শেষ নেই!  বিগ ব্যাশ, বিপিএল শেষে আইপিএল, পিএসএল। এরপর জিএসএল থেকে সিপিএল, এমএলসি আরও কত কী। এত কিছু দেখার পর আবার শুনতে হয়, আসছে ইন্ডিয়ান হ্যাভেন লিগ! সেখানে আবার খেলবেন সাকিব আল হাসান। চোখ না রেখে উপায় কী! সব মিলিয়ে আপনার পরম ভালোবাসার এই খেলাটা এত বেশি হচ্ছে যে কখনো কখনো বদহজমও হচ্ছে। কারণটা আপনি খুঁজে নিতে পারেন ‘শিকাগো’ ব্যান্ডের গানের দু–একটি লাইনে, ‘এভরিবডি নিডস আ লিটল টাইম অ্যাওয়ে...ইভেন লাভারস নিড আ হলিডে।’

এক বাংলাদেশি সমর্থকের দুঃখ

বাংলাদেশি ক্রিকেটপ্রেমী হলে সমবেদনা, সহমর্মিতা এবং এমন আরও যা যা শব্দ আছে, তার সবই আপনার জন্য। কারণ, আপনি জানেন, প্রেম যত গভীরই হোক ছ্যাঁকা খেতেই হবে! নস্টালজিক হলে তো কথাই নেই। কারণ, পৃথিবী সামনে এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কখনো কখনো আপনাকে ফেলে আসা পথে হাঁটাবে। ভুল করে ভেবে বসতে হয়, এটা ২০০৫ সাল না তো!

মিরপুরের কালো মাটিতে কিছুদিন আগে শেষ হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের ওয়ানডে সিরিজের কথা ধরুন। প্রথম দুই ওয়ানডেতে যেভাবে ৩০-৩২ ওভারে দুই দল কষ্ট করে ১০০ রান তুলল, তা অনেককেই ২০-৩০ বছর আগের ক্রিকেটে ফিরিয়ে নিয়েছে। কিংবা চলমান টি–টোয়েন্টি সিরিজ, যেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ যেভাবে ১৫০ রান করতে ব্যর্থ হলো, তাতে ভেবে অবাক লাগতে পারে যে সালটা ২০২৫! এখন বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগেই ১০ ওভারে ১৫০ রান দেখা যায়।

২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনাল বাংলাদেশের ক্রিকেটের দুঃখ হয়েই আছে
ফাইল ছবি

কিন্তু ভালোবাসা অন্ধ। বাংলাদেশের খুব জনপ্রিয় এক সিনেমার একটি গানের লাইনই সেই সাক্ষ্য দেয়, ‘ভালোবাসা অন্ধ এ কথাই বলে সবাই/আমি নিজেকে অন্ধ করে সারাটা জীবন ধরে/তোমার... ঘরে রয়ে যেতে চাই।’ আপনি কিংবা আমরা হয়তো এভাবেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের ঘরে থেকে যেতে চাই, তাতে ঘরের চাল–বেড়া থাকুক বা না থাকুক। কারণ, দলকে ভালোবাসেন। ক্রিকেটারদের প্রতিও ভালোবাসাটা নিঃশর্ত। আর খেলোয়াড়দের ভুলভাল শট খেলায় মনে ঝড় উঠলেও দলা পাকানো কষ্টগুলো বেরিয়ে আসে খুব কমই।

২০১৫ ক্রিকেট বিশ্বকাপে রুবেল হোসেনের এই নো বল নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক বছর
ফাইল ছবি

তবে কষ্ট ভোলার পথও আছে। সেটা ভিন্ন পথ। ধরুন, বাংলাদেশের বিপক্ষে কোনো আম্পায়ার যদি ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েই ফেলেন, তাহলেই কেল্লা ফতে! কমপক্ষে পাঁচ বছর এই অজুহাতে চলা যায়। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে ঘটলে বছরসংখ্যা আরও বাড়তে পারে। প্রতিটি ম্যাচই যে নতুন, ওসব কে ভাবে! কথার শুরুই হতে পারে এভাবে, ‘আরে, সেই দিন যদি আম্পায়ার....!’ কিন্তু অজুহাতের পর অজুহাতে যখন মনের সিলিং ছুঁয়ে যায়, তখন ক্লান্ত লাগে। তখন কি ক্রিকেট আর ভালো লাগে? লাগে না।

আরও পড়ুন

হঠাৎ একদিন...

ওয়ানডে বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের ২৯২ রানের লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়ার ৯২ রানেই ৭ উইকেট পড়বে। মাংসপেশিতে টান লেগে হাঁটতে না পারা গ্লেন ম্যাক্সওয়েল সেখান থেকে এক পায়ে দাঁড়িয়ে ডাবল সেঞ্চুরি করে দলকে জেতাবেন। ১০ ছক্কা ও ২১ চারে ১২৮ বলে অপরাজিত ২০১ রান করে অকল্পনীয় সব ব্যাপার ঘটাবেন অবলীলায়। আর তা–ই দেখে আপনি বলতে বাধ্য হবেন, ‘ক্রিকেট, ইউ ব্লাডি বিউটিফুল!’

ম্যাক্সওয়েল যেদিন অকল্পনীয় সব ব্যাপার ঘটিয়েছেন অবলীলায়
এএফপি

আপনি আরও দেখবেন ব্রিসবেনে শামার জোসেফের উত্থান। মিচেল স্টার্কের গোলার আঘাতে জোসেফ মাঠ ছাড়বেন দুজনের কাঁধে ভর করে। ব্রিসবেন টেস্টে কি তিনি আর খেলবেন? প্রশ্নই আসে না। তাতে স্টার্কের ঘণ্টায় ১৪১ কিলোমিটারের ‘গোলা’র মান থাকে।

কিন্তু জোসেফ মাঠে ফিরবেন। যেখানে সংশয় থাকবে একটা বলও করতে পারবেন কি না, জোসেফ সেখানে করবেন টানা ১১.৫ ওভার। ফল? ৬৮ রানে ৭ উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ২৭ বছর পর জয় এনে দেবেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। আপনি আবারও বলতে বাধ্য হবেন, ‘ক্রিকেট—তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না!’

সেই শামার জোসেফ
এএফপি

পারবেন কীভাবে? কারণ, বিরাট কোহলিদের মতো মানুষেরা যে এই খেলাটা খেলেন। কোহলি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরবেন ২২৩ দিন পর। ফেরার পর প্রথম দুই ম্যাচেই করবেন শূন্য। তৃতীয় ম্যাচে এক রান করতেই সিডনি স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শক দাঁড়িয়ে করতালি দেবেন। কোহলিও তুলবেন ব্যাট। আহ, ৫১ সেঞ্চুরি করা এক ক্রিকেটারের কাছেও একটা রানের কী মর্যাদা! সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে আপনি শিখবেন, জীবনে যত বড় মহিরুহই হয়ে উঠুন না কেন, একটু খারাপ সময়ে খুব ছোট ছোট সাফল্যও আসলে কত মূল্যবান!

আরও পড়ুন

তারপর একদিন আপনার জীবনে প্রেম আসতে পারে। সেই প্রেমের নাম হতে পারে জেমাইমা রদ্রিগেজ। পাশের দেশের মেয়েটি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার ৩৩৮ রানের পাহাড় টপকে যাবেন অবিশ্বাস্য সেঞ্চুরিতে। আপনি দুচোখে মায়াঞ্জন মেখে দেখবেন, যে দলটি এর আগে (নারী) বিশ্বকাপে কখনো ২০০ রানও তাড়া করে জিততে পারেনি, সেই দলটাই কেমন ‘দৈত্য সংহার’ করল এক অভয়ার কঠিন–কোমল হাতে!

ভারতকে জেতানোর পর জেমাইমা
আইসিসি

আপনি টিভিতে দেখবেন, নিজের দেশের হাজারো সমর্থকের সামনে ওই রকম এক কাণ্ড ঘটিয়ে মেয়েটি কেমন কেঁদে ফেলল। গ্যালারিতে তাঁর বাবা–মায়ের চোখেও জল। আর আপনার? চোখে হয়তো কিছু পড়তে পারে, কে জানে! তবে ততক্ষণে আপনি বুঝে গেছেন, এই এমন অবিশ্বাস্য সব খেলোয়াড় গোটা পৃথিবীতে—তাঁদের ভালোবাসাটাই আসলে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা।

জেমাইমার নিবেদন ছিল তাঁর দলের প্রতি। আর আপনার ক্রিকেটের প্রতি। জেমাইমার ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর তাড়না। আর আপনি চেয়েছিলেন প্রায় প্রতিদিনই হেরে যাওয়ার জীবনে কাউকে দেখে একটু পিঠ সোজা করে বাঁচার চেষ্টা করা। খাড়া পাহাড় বেয়ে ওঠার পর কেমন লাগে, সেটাও আপনি জেনে নিতে পারেন ভারতকে ফাইনালে তোলার পর জেমাইমার কথা শুনে, ‘আমি আমার মা, বাবা, কোচ এবং প্রতিটি মানুষকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, যাঁরা আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। গত একটি মাস সত্যিই খুব কঠিন ছিল; মনে হচ্ছে যেন একটা স্বপ্ন, এখনো পুরোটা বুঝে উঠতে পারছি না।’

জেমাইমা বলে যাবেন আর আপনি শুনবেন তন্ময় হয়ে, ‘গত বছর আমাকে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। একের পর এক ঘটনা ঘটছিল, কিছুই আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এই সফরে প্রায় প্রতিদিনই কেঁদেছি। মানসিকভাবে ভালো ছিলাম না। কিন্তু জানতাম আমাকে মাঠে নামতেই হবে, বাকিটা সৃষ্টিকর্তা সামলে নিয়েছেন।’

জেমাইমা কথাগুলো বলার পর আপনি হঠাৎ টের পেতে পারেন, আরে ক্রিকেট তো আসলে জীবনেরই প্রতিরূপ। আপনি চেষ্টা না করলে যেমন ভাগ্যকে (সৃষ্টিকর্তা) পাশে পাবেন না, ক্রিকেটেও ঠিক তা–ই। পেছনে ফেলে আসা পথে স্টার্ক, জোসেফ, কোহলি ও জেমাইমাদের ঘটনাগুলো ঠিক এই শিক্ষাই দেয়। তাহলে বলুন তো, ক্রিকেটকে ভালো না বেসে, জেমাইমাদের প্রেমে না পড়ে উপায় আছে!

আরও পড়ুন