আর কবে মাথা খাটাবেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা
সংবাদ সম্মেলনে যাওয়ার তাড়া তখন দুজনেরই। কুশল বিনিময়ের পর লিফটের ভেতরে মাথায় হাত দিয়ে কিছু একটা ইঙ্গিত করলেন পাকিস্তানের সাংবাদিক। বার্ধক্যে পৌঁছে যাওয়া সাদা চুলের ভদ্রলোক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলেন বাংলাদেশের এক তরুণ সাংবাদিকের। এরপর তিনি কথাটা বলেই ফেললেন, ‘বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের কেবল মাথাটা ব্যবহার করতে হতো…।’
দুবাইয়ের বড় মাঠে দৌড়ে এক–দুই রান নেওয়া চার–ছক্কা মারার চেয়ে সহজ। একই ভেন্যুতে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জিতেছে ১৬৯ রান তাড়া করে। সেই আত্মবিশ্বাস নিয়েও ব্যাটসম্যানরা কাল দুবাইয়ে যা করতে ভুলে গেলেন—তা আসলে ‘মাথার’ ব্যবহার। মানে ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ওই অনুযায়ী ব্যাটিং করা।
পাকিস্তানের ১৩৬ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশের এলোমেলো ব্যাটিং দেখে মনে হচ্ছিল, ম্যাচটা তাঁদের জিততে হবে ১৫ থেকে ১৮ ওভারে! সত্যিই তেমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া ছিল কি না, জানতে চাইলে যদিও তা উড়িয়েই দিয়েছেন প্রধান কোচ ফিল সিমন্স। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটিং দেখে এমন কৌতূহল না জেগে আর উপায় কী!
ব্যাটিংয়ে সবার ভেতরই ছিল অদ্ভুত অস্থিরতা। শুরু থেকেই ব্যাটসম্যানদের দেখে মনে হচ্ছিল— জয়ের বিশ্বাসটাই তাঁদের ভেতরে নেই। কোথা থেকে যেন তাঁদের মধ্যে হাজির হয়েছে দ্রুত রান তাড়া করার ‘ভূত’! পারভেজ হোসেনের কথাই ভাবুন। দুটি বল খেলেছেন। একটি প্রায় চোখেই দেখেননি, দ্বিতীয়টিতে ক্যাচ তুলেছেন।
তিনে নামা তাওহিদ হৃদয় অনেক দিন ধরেই বোলারদের ধাঁধা বুঝে উঠতে পারছেন না। অফ সাইডে কাভার ছাড়া প্রায় ‘অন্ধ’ এই ব্যাটসম্যান যদিও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ভালো করার পর ফেসবুকে লিখেছিলেন, চেষ্টাটা তিনি করে যান সব সময়। কোথায় করেন? কালকের ম্যাচে নিজেকে প্রমাণের জন্য বড় উপলক্ষ আর হয়!
ইনিংসটাকে কেবল টেনে নিয়ে যেতে হতো তাঁকে। অন্তত তাঁর ৩০ বলে ৪০ রানের একটা ইনিংসও বদলে দিতে পারত ম্যাচের ভাগ্য। আউট হওয়ার আগের বলেই সাইফ হাসানকে অল্পের জন্য রান আউট করে দিতে দিতেও বেঁচে যান। পরের বলেই লেগ সাইডে উড়িয়ে মারতে গেলেন। শটটা ঠিকঠাক খেলতে না পারায় ব্যাটের আগায় লেগে চলে যায় সায়েম আইয়ুবের হাতে—আউট!
পারভেজকে হারিয়ে ফেলার পর উইকেটে এসে ১০ বল খেলে হৃদয়ের তখন ৫ রান। তাতেও সমস্যা ছিল না, যদি হৃদয় বুঝতে পারতেন এক–দুই রান নিয়ে ম্যাচটা ধীরে ধীরে এগিয়ে নেওয়া গেলে শেষটা করা যাবে অবলীলায়। এখানেই ‘মাথা’ মানে বিবেচনাবোধের প্রশ্ন চলে আসে।
শুধু যে হৃদয় পারেননি, তা নয়। বাংলাদেশে রীতি মেনে একাদশের বাইরে থাকা নুরুল হাসানকে নিয়ে এই ম্যাচের আগেও আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। তাঁকে শুধু একাদশেই সুযোগ দেওয়া হয়নি, তাঁর সামনে সুযোগ এসেছিল নায়ক হয়ে যাওয়ারও।
কিন্তু উইকেটে আসার শুরু থেকেই নুরুল এমন অস্থির হয়ে ওঠলেন, যাঁর ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। কখনো স্কুপ করতে গেলেন, আবার কখনো কী করলেন, সেটির ব্যাখ্যা হয়তো তিনি নিজেও দিতে পারবেন না। তবে মাথা ঠান্ডা রেখে ব্যাট করলে পরিস্থিতিটা তিনি সামলে নিতে পারতেন।
কিন্তু সায়েম আইয়ুবের দুটি বল ডট দেওয়ার পরই নুরুল নিজের উইকেটটা হারিয়ে যেন মুক্তিই পেলেন! সায়েমকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ দেওয়া নুরুল ২১ বলে করেছেন ১৬ রান। তাঁর বিদায়ের পর দায়িত্বটা কাঁধে ওঠে জাকের আলীর।
কোথাও হয়তো একটা আশাও জেগে ওঠে, আজ হয়তো জাকেরই বাঁচিয়ে দেবেন। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের পর তিনি দিয়েছিলেন সেই প্রতিশ্রুতিও। কিন্তু অফ সাইডে প্রায় ‘অন্ধ’ দুজন ব্যাটসম্যান নিয়ে কীভাবে বাংলাদেশ একাদশ সাজিয়েছে—পেশাগত কারণে বাংলাদেশের খেলা দেখা ভিনদেশিদের সেই কৌতূহলের জবাব দেওয়া হয়নি। ৯ বলে ৫ রান করা জাকের সায়েমের অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বলে চালিয়ে খেলতে গিয়ে ক্যাচ তুলেছেন।
অল্প রানের ম্যাচে খেলাটাকে টেনে শেষ দিকে নিয়ে যেতে হয়—তখন হাতে উইকেট থাকলে তাড়া করা দলটাই যে এগিয়ে থাকে। ক্রিকেটারের এই সহজ তত্ত্বটা পুরো দুনিয়া বুঝলেও কেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা বুঝতে পারেন না, তা এক বিরাট প্রশ্নই বটে।
উত্তরে দলের প্রধান কোচ সিমন্স যা বলেছেন, তা ওই প্রশ্নটাই তুলে দেয় আসলে— বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা আর মাথা খাটাতে শিখবেন কবে? নাহ, সিমন্স এভাবে বলেননি। তিনি বলেছেন, ‘ব্যাটিংয়ের সময় আমরা খারাপ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব দলেই এমন দিন আসে। আজ সেটা আমাদেরও হয়েছে— আমরা ভালো সিদ্ধান্ত নেইনি ব্যাটিংয়ে আর আমাদের শট নির্বাচনও ভালো ছিল না।’
কিন্তু কথাটাকে ছোট করে ‘মাথা খাটিয়ে খেলতে পারিনি বলেই হেরেছি’ বললে কি বড় ভুল হবে?