তড়িঘড়ির বিপিএলে আবারও বিপদের শঙ্কা
প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন আগে দেওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল বিসিবি যেন এবারের বিপিএলকে কলঙ্কমুক্ত রাখার ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু বিসিবি সুযোগটা কাজে লাগায়নি।
বেটিং এজেন্সিগুলোর হিসাবটা চমকে যাওয়ার মতো। ২০২৫ সালে সারা বিশ্বের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগগুলোতে যত সন্দেহজনক (ফ্ল্যাগড) ঘটনা ঘটেছে, তার ৯৬ শতাংশই ঘটেছে এ বছরের শুরুতে হওয়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) একাদশ আসরে! বাজিকরদের কাছে এতটাই লোভনীয় আর সহজলভ্য হয়ে উঠেছে বিপিএল।
একের পর এক ফিক্সিংয়ের সন্দেহজনক ঘটনায় এ বছরের শুরুতে হওয়া সর্বশেষ বিপিএল দেশে–বিদেশে এতটাই বিতর্কিত হয়ে পড়েছিল যে সেসব ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করতে হয়েছিল বিসিবিকে। গত আগস্টে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনও গত ২৮ অক্টোবর বিসিবির কাছে হস্তান্তর করেছে কমিটি। দুটি প্রতিবেদনেই গত বিপিএলের সন্দেহজনক ঘটনার ব্যাপকতার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।
বিসিবি প্রতিবেদনটি তুলে দিয়েছে তাদের দুর্নীতি দমন পরামর্শক অ্যালেক্স মার্শালের হাতে, যিনি এসব ঘটনা নিয়ে অধিকতর তদন্ত করছেন। কিন্তু তদন্তপ্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ না করে এবং তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী অভিযোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার আগপর্যন্ত অভিযুক্তদের খেলা থেকে দূরে সরিয়ে না রেখেই আরেকটি বিপিএল আয়োজনে মাঠে নেমে পড়েছে আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন বিসিবির নতুন পরিচালনা পর্ষদ।
এ বছরের শুরুতে হওয়া একাদশ বিপিএলও বেশ তড়িঘড়ি করে আয়োজন করেছিল ফারুক আহমেদের বোর্ড। ফারুক বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন গত বছরের ২১ আগস্ট, বিপিএল মাঠে গড়িয়েছিল ৩০ ডিসেম্বর। পরিণতি—অব্যবস্থাপনা আর ফিক্সিং বিতর্কে টুর্নামেন্টটির জর্জরিত হয়ে পড়া।
এবার আরও কম সময়ের মধ্যে আরও বেশি তড়িঘড়ি করে দ্বাদশ বিপিএল আয়োজনের পথে বিসিবির নতুন পরিচালনা পর্ষদ, যাঁরা দায়িত্ব নিয়েছেন গত ৬ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বোর্ড নির্বাচনের পর। গতবারের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর এত অল্প সময়ের প্রস্তুতিতে শুরু হতে যাওয়া দ্বাদশ বিপিএল নিয়ে আগের চেয়ে বেশি বিতর্ক আর অঘটনেরই শঙ্কা ক্রিকেট–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার পর কী ঘটবে, সেটি তখনই বোঝা যাবে। তবে আসন্ন বিপিএল এরই মধ্যে বিতর্কিত হয়ে পড়ছে। কারণ, তদন্ত রিপোর্টে অভিযুক্ত হিসেবে নাম আসা ক্রিকেটারদের খেলার সুযোগ রেখেই বিসিবি টুর্নামেন্টটি আয়োজন করতে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে বিসিবির সর্বশেষ অবস্থান—অভিযোগ পুরোপুরি প্রমাণিত না হলে তারা কাউকে খেলতে বাধা দেবে না। অথচ এর আগে বলা হয়েছিল, অভিযুক্তদের দলে না নিতে ফ্র্যাঞ্চাইজিদের অলিখিতভাবে নির্দেশনা দেবে গভর্নিং কাউন্সিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক ক্রিকেটার এ বিষয়ে প্রথম আলোকে কাল বলেছেন, ‘বিসিবি তো অন্তত জানে কারা এসবে ছিল। যেকোনোভাবেই হোক বিসিবির উচিত অভিযুক্ত ক্রিকেটারদের খেলতে না দেওয়া। নইলে বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটের শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে বার্তা যাবে যে বিপিএলে দুর্নীতি করেও পার পাওয়া যায়, বিপিএল দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। একইভাবে যারা এসব অনৈতিক কাজে জড়িত, তাদের জন্য এটা হবে খুশির বার্তা। তারা ধরে নেবে, বিপিএলে এসব করাই যায়।’
প্রশ্ন হলো, এত অল্প সময়ের মধ্যে ৯০০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই–বাছাই করে অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব কি না? তবে জানা গেছে, ৯টি চ্যাপ্টারে লেখা তদন্ত প্রতিবেদনটি মোট ৯০০ পৃষ্ঠার হলেও এর বেশির ভাগজুড়েই আছে বিভিন্ন ঘটনার বিচার–বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে সুপারিশ।
গত বিপিএলের অভিযোগগুলো সম্পর্কে চ্যাপ্টার–২ এ–ই সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে, যার পৃষ্ঠাসংখ্যা আনুমানিক ৩০০। গত আগস্টে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর এই সময়ের মধ্যে বিসিবি চাইলে চ্যাপ্টার–২ এর আলোকেই অভিযুক্তদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারত। তা ছাড়া প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন আগে দেওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল বিসিবি যেন এবারের বিপিএলকে কলঙ্কমুক্ত রাখার ব্যবস্থা নিতে পারে।
কিন্তু বিসিবি সুযোগটা কাজে লাগায়নি। অভিযুক্ত ক্রিকেটারদের তাই খেলার সুযোগ দিতে হচ্ছে এবারও। আর এখন তো ১৯ ডিসেম্বর টুর্নামেন্ট শুরু করতে গিয়ে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই পারছে না গভর্নিং কাউন্সিল। নতুন করে ফ্র্যাঞ্চাইজি নিতে হয়েছে। তার ওপর আমিনুলের নতুন ও অনভিজ্ঞ পরিচালনা পর্ষদেও এমন অনেকে আছেন, যাঁরা বিপিএলের মতো বড় টুর্নামেন্ট আয়োজন দূরে থাক, আগে কখনো একটা ছোট টুর্নামেন্টও আয়োজন করেননি।
এসবের ফলাফল—ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্তদের ব্যাপারে উদাসীনতাও ফ্র্যাঞ্চাইজি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত। আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগ এরই মধ্যে গভর্নিং কাউন্সিলকে জানিয়েছে, এবারের বিপিএলের পাঁচটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মধ্যে দুটির মালিকপক্ষে থাকা দুজন ব্যক্তি তাঁদের সন্দেহভাজনদের তালিকায় আছেন।
এ ছাড়া গত বিপিএলের মোট ৩৬টি সন্দেহজনক ঘটনার ১৩টি অভিযোগই একটি নির্দিষ্ট ফ্র্যাঞ্চাইজির বিরুদ্ধে, যারা আছে এবারের বিপিএলেও।
বিসিবি এর আগে জানিয়েছিল, নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি নেওয়ার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষের আর্থিক সামর্থ্য ও ব্যবসায়িক সুনামকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হবে। অথচ বিসিবি যাদের নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি দিয়েছে, তার কোনোটিই খুব সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান নয়।
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখেন, দেশের এমন একজন ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব বলেছেন, ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া উচিত—প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সামর্থ্য, তাদের ক্রিকেটে আসার উদ্দেশ্য বা অনুপ্রেরণা এবং অভিজ্ঞতা। এগুলোতে যাদের ঘাটতি ছিল, তারাই অতীতে দুর্নীতিতে জড়িয়েছে। আর্থিক সামর্থ্য ও খেলাটার প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল না তাদের। কোনো কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি প্লেয়ার্স পেমেন্টের টাকাও জোগাড় করেছে অনৈতিক কাজ করে।’
ওই ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের মতে, তাড়াহুড়া না করে সবকিছু শুধরেই বিপিএল আয়োজন করা উচিত। নইলে এবারের বিপিএলও নতুন কোনো সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে দেশের ক্রিকেটে।
এসব বিষয়ে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের অবস্থান জানতে কাউন্সিলের সদস্যসচিব ও বিসিবির পরিচালক ইফতেখার রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
