রোনালদোর সম্মান না অপমান?

ক্যারিয়ারের খারাপ সময় পার করছেন রোনালদোছবি: রয়টার্স

‘এই মণিহার আমায় নাহি সাজে
এরে পরতে গেলে লাগে
এরে ছিঁড়তে গেলে বাজে’

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বর্তমান অবস্থা রবি ঠাকুরের এ গানকেই মনে করিয়ে দেয়। কীভাবে এ গান রোনালদোর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক, সে আলাপে আরেকটু পরে আসা যাবে। তাঁর আগে গত এক দশকে ইউনাইটেড ও রোনালদোর অর্জনগুলোতে একবার চোখ ফেরানো যাক।

৪টি ব্যালন ডি’অর, ৩টি চ্যাম্পিয়নস লিগ, ৪টি লিগ শিরোপা—এসব গত এক দশকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর অর্জন। এ সময়ে রোনালদোর ব্যক্তিগত অর্জন তাঁর বর্তমান ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চেয়ে ঢের বেশি।

ইউনাইটেডের অর্জন বলতে কেবল একটি লিগ শিরোপা, একটি এফএ কাপ, একটি লিগ কাপ এবং একটি ইউরোপা লিগ। গত এক দশকে রোনালদো নিজেকে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বিপরীতে এ সময়ে ইউনাইটেড নিজেদের ইতিহাসের অন্যতম খারাপ সময় পার করেছে।

একাদশে জায়গা হচ্ছে না রোনালদোর
ছবি: এএফপি

স্যার আলেক্স ফার্গুসনের বিদায়ের পর সেই যে পতনের গান শুরু হয়েছিল, তাঁর সুর এখনো কান পাতলে বাতাসে শোনা যাবে। এর মধ্যে রোনালদোও নিজের সেরা সময় পার করে গোধূলিলগ্নে পৌঁছেছেন। চক্র পূরণে এক মৌসুম আগে পুরোনো ক্লাবেই তরি ভিড়িয়েছেন তিনি। ভিড়িয়েছেন না বলে অবশ্য ভেড়াতে বাধ্য হয়েছেন বললেই বোধ হয় ভালো।

জুভেন্টাস ছেড়ে রোনালদো যখন অন্য কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ইউনাইটেড তখন তাঁর প্রথম গন্তব্য ছিলই না। গতকাল বেঞ্চে বসে যে ম্যানচেস্টার সিটির কাছে ইউনাইটেডের গুঁড়িয়ে যাওয়া দেখলেন, সিটির সেই দলে থাকতে পারতেন তিনি নিজেও। স্যার ফার্গিই বলা যায় হতে দেননি।

ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপই রোনালদোকে ম্যানচেস্টারের নীল অংশে মিশে যাওয়া থেকে আটকান ফার্গি। গুরুর নির্দেশ অমান্য করতে পারেননি রোনালদোও। তবে সে সময় রোনালদোর ইউনাইটেডে যোগ দেওয়া কোনো কৌশলগত সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনার অংশ ছিল না।

জাতীয় দলেও ভালো করতে পারছেন না রোনালদো
ছবি: টুইটার

ইউনাইটেডের সেই সিদ্ধান্তের মূলে ছিল নিজেদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়টিকে নগরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে যাওয়া থেকে আটকানো। আরও সহজে বললে রোনালদোকে নিয়ে আসার পেছনে মূল কারণ ছিল ইউনাইটেডের ‘ইগো’।

রোনালদো যে পরিকল্পনার বাইরে থেকেই ‘রেড ডেভিল’দের ডেরায় এসেছেন, তা স্পষ্ট হতেও সময় লাগেনি। তবে সেই বোঝা থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগটা গ্রীষ্মের দলবদলে ইউনাইটেডকে রোনালদো নিজেই দিয়েছিলেন। তবে যতক্ষণে ওল্ড ট্রাফোর্ডের দলটি রোনালদোকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, ততক্ষণে পরিস্থিতি আর তাদের নিয়ন্ত্রণেও ছিল না।

রোনালদো চাননি, ইউনাইটেডও চায়নি, তবু রোনালদোর থেকে যেতে হলো, যার ফলাফল রোনালদোর ঠাঁই হয়েছে বেঞ্চে। সর্বশেষ গতকাল রাতে পেপ গার্দিওলার ম্যান সিটি যখন ম্যানইউর ওপর তাণ্ডব চালাচ্ছিল, পুরো দৃশ্যটা দর্শকের ভূমিকায় তাকিয়ে দেখেছেন।

টেন হাগের দলে ব্রাত্য হয়ে পড়েছেন রোনালদো
ছবি: রয়টার্স

পাননি দলের ভাগ্য বদলানোর কোনো সুযোগও। পরে রোনালদোর সম্মান রক্ষার্থেই তাঁকে মাঠে না নামানোর কথা বলেন ইউনাইটেডের ডাচ কোচ এরিক টেন হাগ।

এ কেমন সম্মান? এমন প্রশ্ন চাইলে কেউ তুলতেই পারে। একজন ফুটবলারের জন্য মাঠে থাকাটাই সম্মানের, দলের পরিস্থিতি যেমনই হোক।

রোনালদোকে না নামিয়ে তাঁকে অপমানের হাত থেকে বাঁচানো নিয়ে টেন হাগ যা বলেছেন, তাতে রোনালদোর যা হয়েছে, সেটাই বরং বড় অপমান। প্রথমত, দলের খেলোয়াড় হিসেবে একটি হারের যন্ত্রণা মাঠে থাকা খেলোয়াড়ের যেমন থাকে, মাঠের বাইরে থাকা খেলোয়াড়েরও তা-ই। অপমানের মাত্রায় এখানে কোনো তারতম্য হওয়ার কথা না। তাই এ হারের দাগে বেঞ্চ গরম করা রোনালদোর নামও সমানভাবে লেখা থাকবে।

আরও পড়ুন

দ্বিতীয়ত, একজন খেলোয়াড়ের মান সেখানেই, যখন তিনি মাঠে নেমে লড়তে পারবেন। ইতিহাদের সিটির কাছে ইউনাইটেড যখন প্রথমার্ধেই ৪-০ গোলে পিছিয়ে, তখন টেন হাগের হারানোর আর কিছুই ছিল না। এমন পরিস্থিতে রোনালদোকে একটি সুযোগ চাইলে তিনি দিতেই পারতেন। হয়তো পুরোনো ধার এখন নেই, বয়সও পক্ষে নেই। তবে এমন পরিস্থিতি যদি বদলানোর সামর্থ্য কারও থাকে, তবে সেই অল্পসংখ্যক মানুষের একজন রোনালদোই।

অসংখ্যবার দলকে এমন অবস্থা থেকে রোনালদো উদ্ধার করেছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগে ম্যাচের পর গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বদলে দিয়েছেন পাশার দান। আর সেই মানুষেরই সম্মান রক্ষা করতে হলো এভাবে, মাঠে না নামিয়ে! এমন সম্মান রোনালদোর সইবে তো!

আরও পড়ুন

৫ বারের ব্যালন ডি’অরজয়ী এই তারকা এখনো নিজের মান-অপমান নিয়ে কিছু বলেননি। তবে দলটিরই সাবেক অধিনায়ক রয় কিন রোনালদোর এভাবে বেঞ্চ গরম করাতে স্পষ্ট অপমানই দেখছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইউনাইটেড রোনালদোকে অপমান ছাড়া কিছুই করেনি।’

মৌসুম শুরুর আগেই রোনালদো চেয়েছিলেন ক্লাব বদলাতে। চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি তিনি। তবে একের পর এক ক্লাব ফিরিয়ে দিয়েছে। পিএসজি, চেলসি, বায়ার্ন মিউনিখ, এমনকি আতলেতিকো মাদ্রিদও রোনালদোর জন্য দুয়ার এঁটে দেয়।

তবে এর কারণ যে শুধু রোনালদোর বয়স ও ছন্দ, তা নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্লাবগুলোর পরিকল্পনা, কৌশল এবং বড় খেলোয়াড় সামলানোর দক্ষতা না থাকাও ভূমিকা রেখেছে। আর ঠিক এ ব্যাপারই রোনালদোকে কেনার সময় বুঝতে পারেনি ইউনাইটেড কিংবা তারা বুঝতে চায়নি। আর মৌসুমের শেষ ভাগে রোনালদোকে ইউনাইটেড যখন যাওয়ার মৌন সম্মতি দেয়, তখন বেরোনোর আর কোনো পথই খোলা ছিল না। আর টেন হাগের কৌশলে যে তিনি নেই, তা তো মৌসুমের ৮ ম্যাচ শেষেই স্পষ্ট। প্রিমিয়ার লিগে একটি ম্যাচেই ছিলেন শুরুর একাদশে। সব মিলিয়ে খেলেছেন ২০৭ মিনিট।

ম্যানচেস্টার ডার্বিতে হতাশা নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে ইউনাইটেড খেলোয়াড়দের
ছবি: এএফপি

ফার্গুসন যাওয়ার পর থেকেই দল গঠনে হাঁসফাঁস করেছে ম্যানইউ। একের পর এক কোচ বদলেও আসেনি সাফল্য। আসার পর এখন পর্যন্ত তিন কোচের অধীন খেলেছেন। ওলে গুনার সুলশার দিয়ে শুরু করেছিলেন, এরপর বিদায় নেন রালফ রাংনিকও। অন্তর্বর্তীকালীন কোচ মাইকেল ক্যারিককে বিবেচনায় নিলে সংখ্যাটি হবে ৪ জনের।

এমন একটি ক্লাবে রোনালদোর মতো খেলোয়াড় কখনোই আশীর্বাদ নন। উচ্চ বেতন, চাহিদা ও তারকাখ্যাতি বিবেচনায় নিলে রোনালদোকে সামলাতেই হিমশিম খাওয়ার কথা দলটির। সেটাই হয়েছে। পৃথিবীর বুকেই আকাশের উজ্জ্বল তারা লুব্ধক নেমে এলে যেমনটা হতো, রোনালদোও ইউনাইটেডে তা-ই। আলোর ঝলকানিতেই সব ঝলসে গেছে।

আর এখানেই রবি ঠাকুরের সেই গানটা আমাদের মনে পড়ে, ‘এই মণিহার আমায় নাহি সাজে/এরে পরতে গেলে লাগে/ এরে ছিঁড়তে গেলে বাজে।’ ইউনাইটেডে রোনালদো এখন তেমনই, নিজেদের তৈরি করা তারার ভারই ক্লাবটি নিতে পারছে না।

আরও পড়ুন

নিঃসন্দেহে রোনালদো এখন ক্যারিয়ারে খারাপ সময় পার করছেন। মাঠের পারফরম্যান্সে কিছু করার সুযোগ পাচ্ছেন না, পছন্দের কোনো ক্লাব খুঁজে পাননি, তার আগে সন্তান হারিয়েছেন, অভিযুক্ত হয়েছেন ভক্তের ফোন ভেঙে। এমন পরিস্থিতিতে পেশাদার মনোবিদের শরণাপন্ন হয়েছেন। ইস্পাতদৃঢ় মানুষও যে ঘটনাচক্রে পায়ের নিচে মাটি হারিয়ে ফেলেন, রোনালদো তারই উদাহরণও।

আমাদের জানা নেই, রোনালদো আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ পড়েছেন কি না। বইটিতে হেমিংওয়ে বলেছিলেন, ‘মানুষ বিধ্বস্ত হতে পারে, কখনো হারতে পারে না।’ রোনালদো চাইলে শেষবেলায় হার না মানা মানুষের উদাহরণ হয়েও ফিরতে পারেন। হার না মেনেই যে তাঁর এত দূর আসা।

আরও পড়ুন