মেসি কি সত্যিই বার্সেলোনায় ফিরবেন, কেন ফেরা উচিত
লিওনেল মেসি কি ইন্টার মায়ামি ছাড়বেন নাকি সেখানেই থাকবেন? ২০২৬ বিশ্বকাপ সামনে রেখে কি সিদ্ধান্ত নেবেন আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি?
‘তোমার শান্তিই তোমার শক্তি শেষ করে দিয়েছে। তোমার বিজয়ই তোমাকে হারিয়ে দিয়েছে।’
ক্রিস্টোফার নোলানের ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস’ ছবিতে নায়ক ব্যাটম্যানকে এই কথাগুলো বলেছিলেন বিখ্যাত ভিলেন বেইন। ব্যাটম্যান তখনো পুরো শক্তি দিয়ে লড়াই করছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়েন—আত্মতুষ্টির মারাত্মক ফাঁদে পা দিয়ে।
বেইনের এই সংলাপটা কোথাও না কোথাও এসে যেন লিওনেল মেসির সাম্প্রতিক অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে যায়।
গত সপ্তাহে ক্লাব বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর ম্যাচে ইন্টার মায়ামি যখন পিএসজির সঙ্গে লড়ছিল, ৩৮ বছর বয়সী মেসিকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনিও বুঝি সেই ব্যাটম্যান—লড়ছেন, কিন্তু হার নিশ্চিত। শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা মায়ামি হেরেছিল ৪-০ গোলে।
হ্যাঁ, এখনো কিছু জাদুকরি মুহূর্ত উপহার দিতে পারেন মেসি। ওই ম্যাচেই লুইস সুয়ারেজকে এমনই অসাধারণ একটা পাস দিয়েছিলেন, যা দেখলে মনে হবে, এ-ই তো সেই পুরোনো মেসি! কিন্তু যখন প্রতিপক্ষ ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন, বিশ্বের সবচেয়ে ধারালো আর ফিট দলগুলোর একটি, তখন শুধু মেসির এটুকু ঝলক যথেষ্ট নয়।
সেই ম্যাচ শেষে মেসি বলেছিলেন, ‘ওরা (পিএসজি) দুর্দান্ত দল। ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন। আমরা চেষ্টা করেছি। আশা করি ক্লাব বিশ্বকাপে আমরা একটা ভালো ছাপ রাখতে পেরেছি।’
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু ‘ভালো ছাপ’ রাখা কি এখন মেসির ক্যারিয়ারের লক্ষ্য? মায়ামিতে তিনি হয়তো মানসিক শান্তি পেয়েছেন, জীবনটা ধীরস্থির। কিন্তু সেই পুরোনো আগুনটা, প্রতিদ্বন্দ্বিতার খিদে...সেটা কোথায়?
এই যখন কথা উঠছে, তখন হঠাৎ গুঞ্জন—মেসি কি আবার ইউরোপে ফিরবেন? ইএসপিএন আর্জেন্টিনার সাংবাদিক এস্তেবান এদুল জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের পর যখন ইন্টার মায়ামির সঙ্গে মেসির চুক্তি শেষ হবে, তখন তিনি সম্ভবত ইউরোপের কোনো প্রতিযোগিতামূলক লিগে ফিরতে পারেন, সেটা হতে পারে স্পেনেই, তাঁর পুরোনো ক্লাব বার্সেলোনায়। যাতে বিশ্বকাপের আগে নিজেকে আরও শাণিয়ে নেওয়া যায়।
তবে বাস্তবতা এত সহজ নয়, ঘোলাটে। মেসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আছে স্প্যানিশ ফুটবল সাংবাদিক গিয়েম বালাগের। তিনি বলেছেন, ‘মেসি নিজেই জানেন না, ২০২৬ বিশ্বকাপে তিনি খেলবেন কি না। আপাতত তিনি ধাপে ধাপে এগোচ্ছেন—ম্যাচ ধরে, টুর্নামেন্ট ধরে। সবাই চায় তাঁকে এক বছর পর আমেরিকায় বিশ্বকাপ খেলতে দেখতে। কিন্তু তিনি কাউকে তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানাননি।’
ওদিকে বিবিসি জানিয়েছে, মেসি ইন্টার মায়ামির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করতে রাজি এবং আলোচনা ভালোভাবেই এগোচ্ছে।
তবু, যদি মেসি সত্যিই ছয় নম্বর বিশ্বকাপ খেলতে চান, আর তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চান, তাহলে এমএলএস-এ থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, কারণ এমএলএস এখনো ইউরোপের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক লিগগুলো থেকে অনেক পিছিয়ে।
ক্লাব বিশ্বকাপে মায়ামি গ্রুপ পর্বে দারুণ শুরু করেছিল। মেসির অসাধারণ এক ফ্রি-কিকে তারা পোর্তোকে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে—এই প্রথম কনক্যাকাফের কোনো ক্লাব ইউরোপিয়ান কোনো প্রতিপক্ষকে বিশ্বকাপে হারায়। এরপর মায়ামি আল আহলি আর পালমেইরাসের সঙ্গে ড্র করেও শেষ ষোলোতে ওঠে, যা এমএলএস-এর ইতিহাসেই প্রথম।
কিন্তু পিএসজির বিপক্ষে সেই একেবারে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয় মেসি। প্রথমার্ধেই চার গোল খেয়ে বসে। খেলা দেখে মনে হয়েছে যেন দুই গ্রহের দুই দল খেলছে। মেসি প্রথম শট নেন ম্যাচের ৫০ মিনিটে, তা–ও প্রতিপক্ষের গায়ে লেগে দিক পাল্টানো শট!
সেই ম্যাচে পিএসজি যেন দয়া করে ছেড়ে দিয়েছিল মায়ামিকে। লুইস এনরিকে ৭০ মিনিটের মধ্যেই পাঁচজন খেলোয়াড় বদলে দেন। তবু মায়ামির ভরাডুবি আটকায়নি।
ওই ম্যাচ শেষে মেসির সাবেক সতীর্থ এবং সব সময়ের খেপা কিংবদন্তি জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ বলে ফেলেন, ‘মেসি খেলেছে দশটা মূর্তি সঙ্গে নিয়ে! ওর সতীর্থদের দেখে মনে হয়েছে যেন সবাই সিমেন্টের বস্তা নিয়ে দৌড়াচ্ছে।’
ইব্রা আরও বলেছেন, ‘এ আমার পরিচিত মেসি নয়। যদি তাকে একটা সত্যিকারের দলে রাখা হয়, সে সেরাটা দেবে। এখানে কোনো কোচ নেই, কোনো তারকা নেই, এমনকি এমন খেলোয়াড়ও নেই, যারা পায়ে বল না থাকলে মাঠে কী করতে হয়, তা বোঝে। যদি সে একটা সত্যিকারের দলে থাকত, যেকোনো সেরা দলে, তাহলে আসল সিংহকে দেখা যেত। মেসি খেলছে শুধু ভালোবাসা থেকে, কারণ সে এখনো এমন কিছু করতে পারে, যা ৯৯ শতাংশ খেলোয়াড় পারে না।’
ইন্টার মায়ামির দলে মেসির পুরোনো বন্ধু সুয়ারেজ, জর্দি আলবা, সের্হিও বুস্কেতস আছেন বটে, কোচও হাভিয়ের মাচেরানো। কিন্তু এর বাইরে দলটা একেবারে সাধারণ। পিএসজি সেই দুর্বলতা একেবারে নির্দয়ভাবে দেখিয়ে দিয়েছে।
ইব্রা আসলে ঠিকই বলেছেন। মেসি এখন যেন একটা ছোট পুকুরের বড় মাছ। তাঁকে ঘিরে দলটা যেন শিশুদের মতো। কিন্তু এখনকার ফুটবলে একজন খেলোয়াড় যত বড়ই হোক, তাঁকে সাহায্য করার মতো মানসম্পন্ন সতীর্থ দরকার হয়। একা একা সব ম্যাচ জেতা যায় না!
সুতরাং মেসিকে যদি ‘সিংহ’ রূপে আবার দেখতে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে, সেটা একটা শক্তিশালী, প্রতিযোগিতামূলক দলেই শুধু সম্ভব। যেখানে পাসের পর পাসে খেলাটা গড়ে উঠবে, শুধু মেসির দিকে তাকিয়ে থাকবে না সবাই।
এখন সিদ্ধান্তটা মেসিরই। তিনিই ঠিক করবেন—আত্মতুষ্টি নিয়ে ইন্টার মায়ামির সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করবেন, নাকি ক্যারিয়ারের শেষ পর্যায়ে এসে আবারও একটা চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ঝুঁকি নেবেন!