গোল ঠেকান, শিরোপা জেতান—তবু দোন্নারুম্মা, এদেরসনদের কদর কম কেন
আপনি গোলরক্ষক। তাহলে আপনার মতো দুর্ভাগা আর কে আছে!
কেন এমন বলা, সেটি বোঝার জন্য এবারের দলবদল মৌসুমে একটু চোখ বোলালেই হবে। এবারের গ্রীষ্মকালীন দলবদল আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে—বিশ্বসেরা গোলরক্ষক হলেও দলবদলের বাজারে খুব একটা কদর মেলে না। মাঠের অন্য পজিশনের খেলোয়াড়দের তুলনায় তাঁদের গুরুত্ব নেই বললেই চলে।
সবচেয়ে বড় উদাহরণ পিএসজির জিয়ানলুইজি দোন্নারুম্মা। পাশাপাশি ম্যানচেস্টার সিটির এদেরসন ও এসি মিলানের মাইক মাইনিয়ঁর কথাও বলা যায়। এ তিনজনই নিঃসন্দেহে বিশ্বের সেরা ১০ গোলরক্ষকের মধ্যে পড়েন। অনেকের চোখে আবার সেরা পাঁচেই জায়গা তাঁদের। কিন্তু তাঁরা যদি ফরোয়ার্ড, মিডফিল্ডার বা ডিফেন্ডার হতেন, তাহলে তাঁদের এজেন্টদের ফোন বেজেই চলত। আর তাঁদের ক্লাব চুক্তি নবায়নের জন্য পাগল হয়ে উঠত।
কিন্তু গোলকিপার হওয়ায় তাঁদের বাস্তবতা ভিন্ন। পিএসজি ইতিমধ্যেই লিলের তরুণ গোলরক্ষক লুকাস শেভালিয়েকে নিতে যাচ্ছে (যদিও এখনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়নি)। ম্যানচেস্টার সিটিও বার্নলির জেমস ট্রাফোর্ডকে এনেছে গোলরক্ষকদের জন্য ব্রিটিশ ট্রান্সফার ফি রেকর্ড গড়ে। দোন্নারুম্মার জন্য ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের, এদেরসনের জন্য গালাতাসারাইয়ের, আর মাইনিয়ঁর জন্য চেলসির আগ্রহের কথা শোনা গেলেও কোনো কিছুই এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
দোন্নারুম্মার বয়স মাত্র ২৬। ইতালির অধিনায়ক, ইউরো ও চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী। এদেরসনের বয়স ৩১। পেপ গার্দিওলার আস্থার প্রতীক, সিটির হয়ে জিতেছেন একের পর এক প্রিমিয়ার লিগ ও ইউরোপ–সেরার মুকুট। আর মাইনিয়ঁ তো মাত্রই ৩০ ছুঁয়েছেন, তর্কযোগ্যভাবে সিরি ‘আ’-তে গত চার মৌসুমে সেরা গোলরক্ষক। এখন ফ্রান্সের জাতীয় দলের প্রথম পছন্দ। অথচ তাঁদের যেকোনো একজনকে এই গ্রীষ্মেই কম দামে অথবা এক বছর পর বিনা ফিতে পাওয়া যেতে পারে!
তাঁরা গোলরক্ষক—এ কারণেই এমন অবস্থা!
এ জন্য মাঠে তাঁদের অবস্থান বড় দায়। বিশ্বের সেরা একজন লেফট উইঙ্গার সেই দলে যোগ দিতে পারেন, যে দলে আগে থেকেই বিশ্বমানের আরেকজন লেফট উইঙ্গার আছেন। কোচ দুজনকেই একসঙ্গে খেলানোর উপায় খুঁজে বের করেন। রিয়াল মাদ্রিদ গত মৌসুমে এমবাপ্পে ও ভিনিসিয়ুসকে একসঙ্গে খেলিয়েই তা করে দেখিয়েছে। কিন্তু গোলরক্ষকের পজিশনে সে সুযোগ নেই—একটাই জায়গা, তাতে একাধিক তারকা রাখা মানেই সমস্যা। যদিও এদেরসনের মতো কেউ পায়ে এত দক্ষ হলে হয়তো সেন্টারব্যাক হিসেবেও খেলার যোগ্যতা রাখেন!
তার ওপর এ তিনজনেরই বেতন আকাশছোঁয়া। বিশেষ করে দোন্নারুম্মা, যাঁর বার্ষিক আয় প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। এর ফলে তাঁদের দলে নিতে আগ্রহী ক্লাবের সংখ্যাও হাতে গোনা।
তবে আরেকটা বড় প্রশ্ন রয়ে যায়—ফুটবল কি সত্যিই গোলরক্ষকদের যথাযথ মূল্য দেয়? ‘ট্রান্সফারমার্কেট’-এর হিসাবে দোন্নারুম্মা, পোর্তোর দিয়োগো কস্তা, আর্সেনালের দাভিদ রায়া ও বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের গ্রেগর কোবেল—চারজনেরই মূল্য ধরা হয়েছে ৪ কোটি ইউরো। কিন্তু খেলোয়াড়দের বাজারমূল্যের তালিকায় দোন্নারুম্মার নাম আপনি খুঁজে পাবেন ১৪৭ নম্বরে! মানে এমন ১৪৬ জন খেলোয়াড় আছেন, যাঁদের বাজারমূল্য তাঁর চেয়েও বেশি!
দোন্নারুম্মার প্রয়াত এজেন্ট মিনো রাইওলা একসময় বলেছিলেন, বিশ্বমানের গোলরক্ষকের অবদান একজন হলান্ড কিংবা এমবাপ্পের চেয়ে কম কিছু নয়, তাই তাঁদের বেতনও হওয়া উচিত তেমন। রাইওলাই ১৮ বছর বয়সী দোন্নারুম্মার জন্য ১৪ মিলিয়ন ডলারের চুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। পরে পিএসজির সঙ্গে দোন্নারুম্মার অবিশ্বাস্য অঙ্কের চুক্তিও হয়েছিল তাঁর মধ্যস্থতায়।
তবে পিএসজিতে দোন্নারুম্মার নতুন করে বড় অঙ্কের চুক্তির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শোনা যাচ্ছে, পিএসজি যে প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে সেটি পারফরম্যান্স বোনাসনির্ভর। আগের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি বেতন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
দৃশ্যমান কিছু ব্যাপারও অবশ্য আছে। দোন্নারুম্মা পায়ে খুব ভালো নন—যা লুইস এনরিকে ধরনের কোচদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এদেরসন চোটের কারণে গত দুই মৌসুমেই কিছু ম্যাচ মিস করেছেন, এমনকি গত মৌসুমে গার্দিওলা তাঁকে বাদও দিয়েছিলেন। আর মিলানের ইউরোপায় জায়গা করে নেওয়ার ব্যর্থতা এবং মাইনিয়ঁর ইনজুরি সমস্যা তো আছেই।
কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়—তাঁরা যদি মাঠের অন্য পজিশনের খেলোয়াড় হতেন, তাহলে কি এমন অবহেলার শিকার হতেন? একজন গোলরক্ষক ম্যাচে বল স্পর্শ করেন গড়ে ৩৫-৪০ বার, যেটা অনেক স্ট্রাইকারের ক্ষেত্রেও সত্যি। তাহলে ফারাকটা কোথায়?
সম্ভবত কোচিং ও স্কাউটিং জগৎ এখনো গোলরক্ষকদের মূল্যায়ন করতে শেখেনি। বেশির ভাগ বিশ্লেষক ও কোচই তো সাবেক গোলরক্ষক নন, তাই তাঁরা গোলরক্ষকদের অবদান বুঝতেও ব্যর্থ হন। আবার গোলরক্ষকদের ভুল, গোল হজম—ভুলে যাওয়া কঠিন। অথচ একজন স্ট্রাইকারের মিস কিংবা মিডফিল্ডারের ভুল পাস মানুষ মুহূর্তেই ভুলে যায়।
সব মিলিয়ে ক্লাবগুলো গোলরক্ষকদের সহজেই ‘বদলযোগ্য’ মনে করে। আর তাদের চোখে একজন ‘ভালো’ ও ‘অসাধারণ’ গোলরক্ষকের মধ্যে পার্থক্য বেশি চোখে পড়ে না।