‘মরোক্কান গার্দিওলা’য় মারাক্কেশ রূপকথা
৪৭ বছর বয়সী কোচ রেগরাগুইকে বলা হয় ‘মরোক্কান গার্দিওলা’, যাঁর অধীনে আফ্রিকান ফুটবলের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লিখছে মরক্কো।
সেটা ১৯৮৪ সালের কথা। লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতে দেশে ফিরলেন সাঈদ আউয়িতা ও নাওয়াল এল মুতাওয়াক্কেল। মরক্কোর রাজা দ্বিতীয় হাসান তখন বলেছিলেন, এই দুই অ্যাথলেট দেশকে পৃথিবীর মানচিত্রে তুলে এনেছেন। শুধু কি তা–ই, রাজা দ্বিতীয় হাসান নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই বছরের বাকি সময়ে মরক্কোয় যত কন্যাসন্তান জন্ম নেবে, সবার নাম যেন ‘নাওয়াল’ রাখা হয়। যেহেতু ৪০০ মিটার হার্ডলার তখন মরক্কোর প্রতিটি ঘরে নারীদের প্রেরণা।
২৮ বছর পর মরক্কোর হর্তাকর্তাদের ঠিক একই পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন ওয়ালিদ রেগরাগুই। মরক্কোর কোচ বিশ্বকাপ থেকে যখন দেশে ফিরবেন, তাঁর জন্য নিশ্চয়ই এমন কিছুই করা হবে!
না, মরক্কো এখনো বিশ্বকাপ জেতেনি। আজ ফ্রান্সকে হারিয়ে ফাইনালে উঠবে কি না, সেটাও সময় হলেই জানা যাবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত, বিশ্বকাপের মানচিত্রে মরক্কোর জায়গাটা এখন আলাদা। আফ্রিকার মানচিত্রেও। বিশ্বকাপে এই মহাদেশ থেকে সেমিফাইনালে ওঠা প্রথম দলও যে মরক্কো। আর এই ‘মারাক্কেশ রূপকথা’র পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন যে ব্যক্তি—কোচ রেগরাগুই—তাঁর গল্পটাও কিন্তু অন্য রকম।
২০০৪ সালে আফ্রিকান কাপ অব নেশনসের ফাইনালে উঠেছিল মরক্কো। তিউনিসিয়ার কাছে হারের পর মরক্কোর রাইটব্যাক রেগরাগুই পণ করেছিলেন, একদিন জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব নিয়ে দেশকে বিশ্বকাপে তুলবেন। এমন নয় যে মরক্কো তার আগে বিশ্বকাপে খেলেনি। তিনবার খেলে একবার শেষ ষোলোয় (১৯৮৬) উঠেছে। সেটাই ছিল সেরা সাফল্য। কাতার বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র তিন মাস আগে তাঁর ডাক পড়ে। মরক্কোর আটজন ফুটবলার ছিলেন, যাঁরা ইউরোপে খেলেননি, বেড়ে উঠেছেন দেশের আলো-বাতাসে, খেলাও শিখেছেন দেশের একাডেমি ও ক্লাবে। এমন এক দলকেও তিনি তুলেছেন বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে।
রেগরাগুইয়ের এই সাহস কী বার্তা দেয়? ২০০৪ নেশনস কাপে মরক্কোর গোলকিপার খালিদ ফৌহামি এবং তাঁর সে সময়ের সতীর্থই বলে দিলেন সে কথা, ‘ওয়ালিদের এই কীর্তিতে মরক্কোর কোচরা এত বছরের পরিশ্রমের প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু পাবে।’ ছোট দলগুলোও যে বিশ্বকাপের মতো ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এ ঘরোয়া খেলোয়াড়দের নিয়েও বড় কিছুর স্বপ্ন দেখতে পারে, সেই প্রমাণও রাখলেন রেগরাগুই।
৪৭ বছর বয়সী এই কোচকে বলা হয় ‘মরোক্কান গার্দিওলা’। জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার আগে দেশের ক্লাব ওয়েদাদকে জেতান আফ্রিকান চ্যাম্পিয়নস লিগ। টানা দুবারের চ্যাম্পিয়ন আল-আহলিকে হারানোর পর রেগরাগুই সবার নজরে চলে আসেন।
বেশি দিন আগের কথা নয়, বছরখানেক আগে এফএ কাপের ফাইনাল নিয়ে ট্যাকটিকসের সেমিনার আয়োজন করেছিলেন আর্সেনাল কোচ মিকেল আরতেতা। রেগরাগুই সেই সেমিনারে ছিলেন ছাত্রের ভূমিকায়। এই যে পরিশ্রম, এই যে শেখার ইচ্ছা, এই যে নিবেদন—এসবই তো সাফল্যের পূর্বশর্ত। রেগরাগুই সেসব শর্ত পূরণ করেই এখন ‘আটলাস পর্বত’–এর চূড়ায় ওঠা থেকে মাত্র দুই ধাপ দূরত্বে।
শুনলে অবাক হবেন, রেগরাগুই সেমিফাইনালে ওঠাকে এখনো সাফল্য হিসেবে দেখছেন না। শুনুন তাঁর মুখেই, ‘আমি মানসিকতার পরিবর্তন চাইছি। সেমিফাইনালে উঠেই যদি আমরা সন্তুষ্ট হয়ে পড়ি, তাহলে এই (সন্তুষ্টির) সীমানাটা ভাঙা যাবে না। আমরা বিশ্বকাপ জিততে এসেছি। পাগল ঠাওরাতে পারেন, কিন্তু লক্ষ্য এটাই।’
মরক্কোকে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে তোলা কোচকে কেউ পাগল ঠাওরাবে, সে–ই তো বড় পাগল!